Logo
Logo
×

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা

বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ

Icon

ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হয়। এরপর বাংলাদেশের সামনে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আর তা হলো যত দ্রুত সম্ভব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় করা এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করা। এ কাজে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি জানতেন, বাংলাদেশের মাটিতে যতদিন ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি থাকবে ততদিন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বিলম্বিত হবে; কেননা পাকিস্তান ও এর সমর্থক রাষ্ট্রগুলো ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির অজুহাতে নিজেরা তো স্বীকৃতি দেবেই না উপরন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রকে বিশেষ করে মুসলিম ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে স্বীকৃতি প্রদানে নিরুৎসাহিত করবে। এজন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগেই সুকৌশলে ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে ১৯৭২ মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন। তার এ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে ১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ ৩২টি দেশের স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়। আরও অধিক সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন কিন্তু মূলত চীনের ভেটোর কারণে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে বিলম্ব ঘটে।

আন্তর্জাতিক সমাজে যখন কোনো একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে তখন এর স্বীকৃতির প্রশ্নটি সামনে চলে আসে কেননা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। জার্মান দার্শনিক হেগেলের Constitutive Theory মতে, রাষ্ট্রসত্তায় পরিণত হওয়ার জন্য স্বীকৃতি অপরিহার্য। আবার হল্যান্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওপেনহেইমও মনে করেন, স্বীকৃতি ছাড়া কোনো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়বস্তু হতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল গভর্নেন্স’-এর যে ধারণা বিকশিত হয় তাতে রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যেমন প্রয়োজন হয়ে পড়ে তেমনি আবার এই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যের সর্বসম্মত সমর্থন লাভ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য বেশকিছু নীতি-কৌশল গ্রহণ করেন যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। এগুলোর অন্যতম ছিল-

ক) সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হিসাবে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি সংযোজন;

খ) সংবিধানে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে পাশাপাশি স্থান দেয়া;

গ) মার্কিন ও সোভিয়েতক্স কোনো বলয়ে যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দেয়া;

ঘ) তিনি একদিকে ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের নিরাপত্তা ও মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন; অপরদিকে ওআইসি’র সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য লাহোরে গমন এবং আরব-ইসরাইল যুদ্ধে জোরালোভাবে আরবীয়দের সমর্থন প্রদান;

ঙ) সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রচলন।

স্নায়ুযুদ্ধের প্রবল উত্তেজনাময় সময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে এবং এ সময় কোনো ছোট রাষ্ট্রের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নক্স এই দুই পরাশক্তি প্রভাব বলয়ের বাইরে অবস্থান করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা সে সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে নীতিটি প্রবল ছিল তা হলো : If you are not with us, then you are against us. বাংলাদেশ যেহেতু সমাজতান্ত্রিক বলয়ের নেতৃত্বে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করে সেহেতু পুঁজিবাদী বিশ্বের আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধু হয়তো দেশে সমাজতন্ত্র চালু করবেন এবং সোভিয়েত বলয়ে যোগ দেবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা না করে তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে জওহরলাল নেহেরুর মতোই ঝুঁকি গ্রহণ করেন এবং এই দুই পরাশক্তির কোনোটির বলয়ে যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দেন। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, তিনি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সুইজারল্যান্ডে পরিণত করতে চান। তার এ বক্তব্য বাংলাদেশবিরোধী রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করে এবং বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়। একদিকে গণতন্ত্রের পথগ্রহণ অপরদিকে সোভিয়েত বলয়ে যোগ না দেয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আশ্বস্ত হয় এবং এ কারণে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির আবেদনের বিরোধিতা করা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র রাষ্ট্রগুলো সরে আসে। আবার ওআইসি’র সম্মেলনে যোগদান এবং আরবীয়দের পক্ষে জোরালো অবস্থানের ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর ভ্রান্তি দূর হয়। ফলে পাকিস্তানও বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় সুবিধা করতে পারেনি।

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল সেই সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ নেয়ার পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৭ এপ্রিল শপথ নেয়ার পরপরই বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “Pakistan is

now dead and buried under a mountain of corpse...We now appeal to the nations of the world

for recognition and assistance both material and moral in our struggle for nationhoodxd.” কিন্তু শুরুতে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাজনক। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করা তো দূরের কথা, বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই জাতিসংঘে হতে পারেনি। অথচ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা নিবৃত্তি ও শান্তি বিষয়ক সনদ গ্রহণ করেছিল। তবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো জাতিসংঘ সনদের ২(৭) ধারাকে সামনে নিয়ে আসে। এ ধারায় কোনো রাষ্ট্রের জনগণের মানবাধিকার বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নীতির মধ্যে সীমারেখা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষায় ছিল বদ্ধপরিকর। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, পোল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্র পাকিস্তানের বর্বরতা ও গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। এ সময় জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন মিয়ানমারের (তৎকালিন বার্মা) সাবেক কূটনীতিক উ থান্ট এবং মিয়ানমার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে কোনো আলোচনায় অগ্রসর হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার জন্য অত্যন্ত বিচক্ষণ কূটনীতিকের মতোই অগ্রসর হন। এজন্য প্রথমেই তিনি দক্ষ কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুনর্বাসন করেন এবং এদের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশের পক্ষে আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন। তার এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচায়ক। কেননা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোর সময় বাংলাদেশের পক্ষে দেন-দরবার করতে গিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন লবিগ্রুপে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার নিয়োগকে জাতিসংঘসংশ্লিষ্ট সবাই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে যা বাংলাদেশের কূটনীতির পথকে প্রশস্ত করে দেয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে গলব্লাডার স্টোন অপারেশন করার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডন গমন করেন। যাত্রাপথেই তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার প্রধানদের কাছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভে সমর্থনদানের আবেদন জানিয়ে পত্র লেখেন।

বঙ্গবন্ধুর জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসের আগেই নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে ১১টি রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ৫টি সদস্যের মধ্যে একমাত্র চীন ব্যতীত অপর ৪টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের অপর ৪টি রাষ্ট্রের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপিত হয় এবং সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আগস্ট মাসের ৮ তারিখ বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করে যাতে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি উত্থাপন ও সুরাহা করা সম্ভব হয়। তিনটি প্রক্রিয়ায় এ আবেদন প্রেরণ করা হয় : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কূর্ট ওয়ান্ডহেইমের কাছে সরাসরি তারবার্তা প্রেরণের মাধ্যমে, ঢাকাস্থ জাতিসংঘ প্রতিনিধি ড. উমব্রিখটের মাধ্যমে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস.এ. করিমের মাধ্যমে। জাতিসংঘের সদস্য সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের সদস্যপদলাভে সমর্থনদানের জন্য চিঠি প্রেরণসহ কূটনৈতিক চ্যানেলেও যোগাযোগ করা হয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদলাভের সব শর্ত পূরণ করায় স্বাভাবিকভাবেই সদস্যপদ পেতে পারত। কিন্তু পাকিস্তানের প্ররোচনায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এবং চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশের বিরোধিতা করে। এমনকি একমাত্র ভারত ও ভুটান ব্যতীত অন্য সব দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোও বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ৮৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে যদিও জোটনিরপেক্ষ ৫৫টি দেশের মধ্যে ৩১টি দেশ তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১০ আগস্ট বাংলাদেশের আবেদনটি নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১১ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদের এ সংক্রান্ত ভোটে চীন ব্যতীত ১১টি রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভোট প্রদান করে এবং সোমালিয়া, সুদান ও গিনি ভোটদানে বিরত থাকে। এভাবে নিরাপত্তা পরিষদে আবেদনটি গৃহীত হওয়ার পর তা অন্তর্ভুক্তি কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদেশের স্বীকৃতি লাভ করায় ধারণা করা হয়েছিল যে চীন ভেটো দিলেও দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ করা সম্ভব হবে। চীন বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রদানের বিরোধিতার কারণ হিসাবে বাংলাদেশের কাছে আটক পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যের মুক্তির বিষয়টিকে সামনে আনে। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে চীন ও পাকিস্তান বাংলাদেশের বিপক্ষে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করে। ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৭তম অধিবেশন শুরু হয় এবং সে পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৯১টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৩টি দেশ যৌথভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির প্রস্তাব করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীনের বিরোধিতার কারণে এই অধিবেশনে বাংলাদেশ সদস্যপদ পেল না। তবে এই তৎপরতার ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়।

বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, পাকিস্তানের প্ররোচনায় চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি রোধ করতে ভেটো প্রদান অব্যাহত রাখবে। কিন্তু তিনি হতাশও হলেন না এবং নিশ্চেষ্ট হয়েও থাকলেন না। তিনি ‘নীরব কূটনীতি’র আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি রাষ্ট্রদূত কে. এম. কায়সার (যিনি ইতোপূর্বে চীনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছিলেন)-কে চীন প্রেরণ করেন। জনাব কায়সার তার পূর্ববর্তী কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ‘নীরব কূটনীতি’ কৌশল প্রয়োগ করে পাকিস্তানকে অন্ধকারে রেখে, চীনের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। এর ফলে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে সক্ষম হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চীন শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দিলেও নিজে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। যতদিন বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতায় ছিল ততদিন চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার আততায়ীর হাতে নিহত হলে ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর! এ থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তানের প্ররোচনায় চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তি প্রতিরোধ করার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছে। প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক কূটনীতির মাধ্যমে চীনের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। যখন দেখলেন যে এ প্রক্রিয়ায় সফল হওয়া যাবে না তখন তিনি নীরব কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সফল হন। বঙ্গবন্ধু তার ক্যারিসমেটিক ব্যক্তিত্বের দ্বারা তার জীবদ্দশায় ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হন।

বঙ্গবন্ধু যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি উদার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরবর্তী সরকারগুলো কূটনৈতিক তৎপরতায় পরিবর্তন আনে। এ সময় তারা ভারতবিরোধিতাসহ মার্কিনঘেঁষা নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সরকারগুলো স্বাবলম্বী হওয়ার পরিবর্তে বৈদেশিক ত্রাণ ও ঋণনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ঘটায়। তারা রাষ্ট্রের চরিত্রও বদলে ফেলে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে খুশি করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে বাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়, সমাজতন্ত্রকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে এর ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। কখনো ‘লুক ইস্ট পলিসি’ আবার কখনো ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ গ্রহণ করা হয়। এভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হয়ে পড়ে নতজানু। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবার বঙ্গবন্ধুর উদার পররাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণ করতে শুরু করে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে আজ বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

লেখক : সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম