অনলাইনে কোরবানির পশু কিনতে বিড়ম্বনা এড়ান
করোনার মহামারীর কারণে এবার অনলাইনে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। কোরবানির ঈদে পশু কেনা ও পশু পছন্দ করতে হাটে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। অনলাইনে পশু কেনার ক্ষেত্রে সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে নানা রকম ঝুঁকি। অযথা বিড়ম্বনা এড়াতে অনলাইনে পশু কিনতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। লিখেছেন-
সাইফ আহমাদ
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যে কারণে ডিজিটাল হাটে পশু কিনবেন
করোনা মহামারীর প্রভাব এড়াতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ সময়ে পশুর হাটে গিয়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে কেনাকাটায় রয়েছে ভীষণ স্বাস্থ্যঝুঁকি। করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ নিয়ে যারা হাটে যাবেন তারা করোনার জন্য সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ করবেন বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। অন্যদিকে গরু-ছাগল নিয়ে করোনা সংক্রমণের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কয়েকদিন হাটে অবস্থান করা, বিক্রির টাকার নিরাপত্তাসহ রয়েছে বিক্রেতাদের নানা সমস্যা। করোনাপরিস্থিতি বিবেচনায় এবং সংক্রমণের প্রবল ঝুঁকি এড়াতে এবার কোরবানির হাট মাঠে নয়, অনলাইনে করার আহ্বান জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। আবার সাধারণ হাটের মতো কোরবানির পশুর ভার্চুয়াল হাটে নেই দালালদের দৌরাত্ম্য। ঘরে বসে ওয়েবসাইটে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেছে বেছে, দরদাম করে কেনার সুযোগ রয়েছে অনলাইনে। পশুর বয়স, ওজনসহ ছবি, ভিডিও দেখে রয়েছে কেনাকাটার সুবিধা। এছাড়া অনলাইন হাট থেকে কোরবানির গরু বাছাই এবং অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে কেনার সুবিধা পাওয়া যাবে। ফলে প্রবাসীরাও নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রিয়জনের জন্য বিদেশ থেকে কোরবানির গরু অর্ডার করতে পারবেন। অর্ডার দিলেই বাসায় পৌঁছে যাবে কোরবানির পশু।
যেভাবে অনলাইনে গরু কেনা যাবে
করোনা মহামারীর কারণে জনসাধারণের সুবিধার জন্য অনলাইনে পশু কেনার সুযোগ দিচ্ছে কয়েকটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে রয়েছে- জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিক্রয় ডটকম, প্রিয়শপ ডটকম, দেশি গরু বিডিডট কমসহ আরও অনেক ভার্চুয়াল কোরবানির পশুর হাট। এছাড়া ঈদুল আজহায় খামারি ও ক্রেতাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ফুড ফর নেশন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে জনসাধারণের জন্য ঘরে বসে কোরবানির পশু ক্রয়ের সুবিধার্থে ‘ডিজিটাল হাট’ নামক প্ল্যাটফরমটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে।
ই-কমার্স সাইট প্রিয়শপ ডটকমের সিইও আশিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে ক্রেতারা বিভিন্ন আকারের ও দামের গরুর ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে পছন্দ করতে পারবেন। ওয়েবসাইটে পশুর ছবিসহ দাম, উচ্চতা ও ওজন দেয়া আছে। ক্রেতারা গরু পছন্দ করার পর বিকাশ, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ডিপোজিট, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মূল্যে পরিশোধ করে তা নিশ্চিত করতে পারবেন। প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিকুল আলম বলেন, গরুর ওজন অনুযায়ী কেজিপ্রতি দামের ভিত্তিতে ‘ফিক্সড প্রাইসে’ গরু বিক্রি করা হবে। কোরবানির পশু কেনামাত্র ক্রেতাকে এসএমএস দিয়ে নিশ্চিত করা হবে। আর যারা বুকিং দিচ্ছেন, ঈদের এক-দু’দিন আগে তাদের বাসায় গরু পৌঁছে দেয়া হবে।
ঝুঁকি ও বিড়ম্বনা
ডিজিটাল বা অনলাইনে পশু কেনার ক্ষেত্রে খরচ অর্ধ লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধু ছবি দেখে, অনলাইনের মাধ্যমে গরু অর্ডার দেয়া কতটা নিরাপদ সেটিও ভাবার বিষয়। অনেক ক্রেতা হাট এড়িয়ে অনলাইনে গরু কেনার ক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন যুগান্তরকে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গরু কেনার পর, প্রতিশ্রুতিমাফিক কাঙ্ক্ষিত গরু না পাওয়া, দাম বেশি, দাম পরিশোধে ঝক্কিসহ অন্যান্য বিষয়ে অভিযোগ করেছেন গ্রাহক। পোশাক খাতে চাকরি করেন যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাখাওয়াত সোহাগ। তিনি বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু কেনার জন্য অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইটে খুঁজেছি; কিন্তু সাধারণ হাটের তুলনায় মনে হচ্ছে দাম একটু বেশিই। তিনি অভিযোগ করেন, অনলাইনে লাইভ হাটের চেয়ে দাম কম হওয়ার কথা।
সাখাওয়াত আরও বলেন, অনলাইনে যে গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা, সেই গরু হাট থেকে কিনতে ৩০ বা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা লাগবে। তাই আমি সিদ্ধান্তহীনতায় আছি; বেশি দাম দিয়ে অনলাইনে গরু কিনব নাকি হাটে যাব।
আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাটিকাটার বাসিন্দা পারভেজ খান বলেন, ‘আমি যে ওয়েবসাইট থেকে গরু কিনেছি, তাদের বলেছিলাম যেন আমাকে ভিডিওকলের মাধ্যমে গরুটি দেখানো হয়। তারা আমাকে দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। তারপর আমি অর্ডার দিয়েছি।’ গরু এখনও বিক্রেতার কাছেই রয়েছে। ঈদের ২-১ দিন আগে হোম ডেলিভারি দিয়ে যাবে।
তবে বেশি দামের অভিযোগ নাকচ করে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘দাম বেশি রাখার কোনো সুযোগ নেই, খুব কম লাভে ই-কমার্স সাইটগুলো গরু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে।’ আমরা ইতোমধ্যে গরুর সর্বোচ্চ দাম ধরে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্রেতারা জ্যান্ত গরুর ক্ষেত্রে (লাইভ গরু) ৪০০ কেজির নিচে প্রতি কেজি ৩৭৫ টাকা, ৪০০ থেকে ৫০০ কেজির মধ্যে প্রতি কেজি ৪২৫ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি বা তার বেশি ওজনের গরুর জন্য ৪৭৫ টাকা কেজি দরে কিনবেন। এটি সর্বোচ্চ দাম, এর ওপরে যাবে না।
এছাড়া ‘ডিজিটাল হাটে যেসব সদস্য অংশ নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব আমাদের সংগঠন নিচ্ছে। কারণ এখানে সব জেনুইন খামার ও গরুই বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। ফলে তাদের পেমেন্ট এবং ডেলিভারির গ্যারান্টি আমাদের অ্যাসোসিয়েশন নিচ্ছে।
সতর্ক থাকতে হবে
প্রিয়শপ ডটকমের সিইও আশিকুল আলম খান পরামর্শ দিচ্ছেন, ফেসবুকভিত্তিক বা অপরিচিত ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনার আগে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে নেয়া উচিত। বিশেষ করে তারা যেন বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনেন।
কোনো ওয়েবসাইট থেকে কেনার আগে সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে দেখা উচিত। প্রয়োজনে আগের ক্রেতাদের রিভিউ দেখা যেতে পারে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কিনা সেটাও দেখা উচিত। ই-ক্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যদের কাছ থেকে কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলছেন জনাব খান।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, পেমেন্ট করার আগে শর্তগুলো ভালো করে দেখা উচিত, বুঝে নেয়া উচিত যে, তারা সুস্থ গরু পাবেন কিনা। প্রয়োজনে বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমনকি ভিডিওকল দিয়ে পশুর রং ও অবস্থা দেখে নিশ্চিত হয়ে তবেই কেনা উচিত। আবার কী শর্তে কীভাবে গরু সরবরাহ করা হবে, সেগুলো বিশেষভাবে বুঝে নেয়া উচিত। প্রয়োজনে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ই-ক্যাবভুক্ত কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সে ক্ষেত্রে তাদের অ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু ই-ক্যাবভুক্ত নয়, এরকম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাদের করার কিছু থাকবে না।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান গরু সরবরাহের ক্ষেত্রে আলাদা ডেলিভারি চার্জ ধরে থাকে। আগেই সে বিষয়ে কথা বলে নেয়া ভালো।
প্রথমবারের মতো জমজমাট হয়ে ওঠা ভার্চুয়াল পশুর হাটে যাতে কোনো প্রতারণার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে অনলাইনে ভুয়া ব্যবসায়ী ও প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছেন ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে ক্রেতাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
