বঙ্গবন্ধুর আদর্শ : বৈষম্যহীন অর্থনীতি
ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখে বাঙালি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার পটভূমি তৈরি হয় পূর্ববর্তী ২৩ বছরে পরিচালিত ঔপনিবেশিক কায়দায় সামরিক ছত্রছায়ায় পাকিস্তানি শাসনামলে। পটভূমির কারিগর বঙ্গবন্ধু। পটভূমির তৈরির ক্ষেত্রে দুটো মোটাদাগের উপাদান নিয়ামক শক্তির ভূমিকা পালন করেছিল : এক. জাতীয়তাবাদী চেতনা; দুই. পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা, মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে ঔপনিবেশিক কায়দায় তাদের শাসনব্যবস্থার ছকটি তৈরি করে শুরু থেকেই। কারণ তারা জানত যে, কোনো জাতিকে দাবিয়ে রাখতে হলে তাদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে হবে, তাদের পরনির্ভরশীল করতে হবে। এ শিক্ষাটা তারা পেয়েছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করার পর ব্রিটিশরা কী করেছিল প্রসঙ্গক্রমে সেটা একটু দেখে নেয়া যাক।
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় করমুক্ত রপ্তানি বাণিজ্য করার অনুমতি পায় ১৭১৭ সালে। কিন্তু পরে তারা নানা কৌশলে কর দেয়ার শর্তে আমদানি বাণিজ্যও শুরু করে এবং এ পথ ধরেই ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করে নিজেদের উপনিবেশভুক্ত করে। তাদের শোষণনীতিতে অল্প সময়ের মধ্যেই এক সময়কার সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংসের প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। একদিকে তারা জোর-জুলুম করে কর আদায় করত অন্যদিকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া বাজার তৈরি করে এ দেশের ছোট-বড় শিল্পগুলোকেও একে একে ধ্বংস করে ফেলে। নবাবী আমলেও তারা কর দিত কিন্তু তাদের পেশার স্বাধীনতা ছিল, শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ও অনুমোদন ছিল। কিন্তু ইংরেজ আমলে এসে এর সবকিছুতেই এ দেশের মানুষ তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়। ঐতিহাসিক রমেশ দত্ত নবাবী ও কোম্পানি আমলের একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন:
কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যনীতি এবং শাসনযন্ত্রের দমননীতির যুগপৎ কুপ্রভাবে দেশীয় বাণিজ্য ও শিল্প ধ্বংস হয়ে গেল। শুরুতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা তাদের কর্মচারীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন কিন্তু সময়ের আবর্তনে তারা নিজেরাই এখন কোম্পানির দমননীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের উৎপাদিত কাপড় এক সময় ইংল্যান্ডে রফতানি হতো কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের বাজার তৈরি করার কুমতলবে দেশীয় তাঁতিদের কুনজরে দেখতে শুরু করে। তাদের প্রাপ্ত রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগে দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করার সুচিন্তিত পথ বের করে যাতে দেশীয় উৎপাদকরা নিরুৎসাহিত হয় এবং এই ফাঁকে ব্রিটিশদের উৎপাদন ব্যবস্থা সুসংহত হয়। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চে লেখা এক পত্রে কোম্পানির কর্তারা এ আশাবাদ ব্যক্ত করে যে, বাংলাদেশে শুধু রেশমের কাঁচামাল উৎপাদিত হবে এবং রেশম থেকে কোনো কাপড় এখানে তৈরি হবে না। শুধু তাই নয়, তারা এটাও অনুমোদন করে যে, রেশম উৎপাদনকারীরা কোম্পানির কুঠিতে এসে কাজ করবে, তারা ঘরে বসে কোনো কাজ করতে পারবে না। [রমেশ দত্ত, The Economic
History of India, লন্ডন ১৯০৮, পৃ. ২]
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করত এ দেশের মানুষকে নামমাত্র মজুরি দিয়ে আর ফিনিশড গুডস্ তৈরি করে এনে এ দেশে বিক্রি করত- এ দ্বিমুখী অর্থনৈতিক ও পেশাগত ক্ষতির মুখে পড়ে পলাশী যুদ্ধের মাত্র দেড়যুগের মধ্যে দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মুর্শিদাবাদে কোম্পানি-কুঠির অধ্যক্ষ বেকার এক চিঠিতে বলেন-
আমি এই দেশটির একদার সমৃদ্ধ অবস্থার কথা বেশ ভালোভাবে স্মরণ করতে পারি। এখানে এক সময় দেশীয় লোকেদের বাণিজ্য করার অধিকার ছিল মুক্ত, সে সময় দেশটি সমৃদ্ধ ছিল; কিন্তু আমি এখন দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে দেশটির বর্তমান ধ্বংসাত্মক অবস্থার জন্য আমাদের একচেটিয়া বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি দায়ী, যার সঙ্গে আমিও যুক্ত। কোম্পানি দেশটির দখল নেয়ার পর যে একচেটিয়া বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে তাতেই এ দেশের এ অবস্থা হয়েছে। আমরা যদি তাদের দেশীয় লোকেদের মুক্তভাবে বাণিজ্য করতে দিই তাহলে দেশটিকে তারা এ ভগ্নদশা থেকে উদ্ধার করতে পারবে, রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে কোম্পানির বিনিয়োগ ও বাণিজ্য দুটোই সম্প্রসারিত হবে।’ [Edward Thompson and G. T. Garratt, Rise and Fullfillment of British Rule in India, লন্ডন ১৯৩৫, পৃ. ১০২]।
বেকার এ চিঠিটি লিখেছিলেন ১৭৬৯ সালে অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের মাত্র ১১ বছর পর। এ প্রসঙ্গে বেকার আরও বলেন-
কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর এ দেশের যে হাল হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক এবং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এই দেশের অবস্থা এখন দুর্দশাপূর্ণ- বিষয়টি একজন ইংরেজের জন্য খুবই বেদনাদায়ক বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি এবং এই নিশ্চিত সত্যটি শুধু বেদনাদায়ক নয়, এটা ভয়েরও কারণ।’ [ঐ, পৃ. ১০৯]
১৮৩৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষিত মুসলমানরা সরকারি দফতরে চাকরিতে নিয়োজিত থাকতে পেরেছিল কিন্তু ‘১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা এবং ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আদালতেও ইংরেজি ভাষা চালু হওয়ার পর’ [নূহ-উল-আলম লেনিন, রাজনৈতিক ইসলামের বিশ্বায়ন ও জঙ্গিবাদের উত্থান, ঢাকা ২০১৮, পৃ. ৯৯-১০০] শিক্ষিত মুসলমান বেকার হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের মূলে ইংরেজ সরকারের গৃহীত অনেক নীতির মধ্যে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই বিশেষভাবে দায়ী করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে বাংলার কৃষক শ্রেণি (বেশিরভাগই মুসলমান) যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা এর আগে জমিদার আমলেও হতে দেখা যায়নি। বাংলার মুসলমান কৃষিজীবীদের অবস্থা সম্পর্কে হান্টার বলেন :
তাদের অতীত গৌরব ও সমৃদ্ধি ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসল। প্রতিবেশী হিন্দু উচ্চবিত্তের সমানে টিকে থাকার মতো কোনো জোরালো অবস্থা তাদের আর থাকল না।... গত ১৭০ বছরের মধ্যে এটা অসম্ভব ছিল যে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সে পুনরায় দরিদ্র হয়ে গেছে কিন্তু এখন এটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে যে কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলমান অর্থবিত্তে তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারবে।’ [উইলিয়াম হান্টার, The Indian Musalmans, লন্ডন ১৮৭৬, পৃ. ১৫৮]
বস্তুত, ইংরেজ আমলে বাঙালির, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের দুর্দশা ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। তারা ইংরেজি না জানার কারণে চাকরি হারায়। চাকরি হারিয়ে কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অন্য কৃষিজীবীদের মতো কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট নতুন ভূমিব্যবস্থায় সুবিধা করতে পারে না। অর্থাৎ ‘কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পরও মুসলমানদের আগের কর্মস্থল বহাল ছিল কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রাজস্ব ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন কোম্পানি কর্তৃক সাধিত হয় সেখানে মুসলমানদের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে এবং এক সময় তারা শাসনযন্ত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ [আজিজুর রহমান মল্লিক, British Policy and the Muslims of
Bengal, দ্বিতীয় সংস্করণ ঢাকা ১৯৭৭, পৃ. ৩২-৩৩]
ঔপনিবেশিক আমলের বৈষম্যপূর্ণ শাসননীতির কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্র প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হল এ কারণে যে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর হিন্দুস্তান-পাকিস্তান নামের দুটো রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় এবং বাংলাদেশ (তখন পূর্ববাংলা এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধান বলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলা নামটি পরিবর্তন করে পূর্বপাকিস্তান নামকরণ করে) যে একই কায়দায় বৈষম্যপূর্ণ শাসন-শোষণের শিকার হয় তার একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার প্রয়াসে।
এবার পাকিস্তান আমলে বাঙালির ভাগ্য বিপর্যয়ের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যাক। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যেসব বৈষম্যনীতি তারা অবলম্বন করে সে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হলেও আলোচনার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা এড়িয়ে যাওয়া হল। শুধু অর্থনৈতিকভাবে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপতৎপরতার কিছু নমুনার দিকে আলো ফেলার চেষ্টা করছি। কারণ বাঙালির মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে বঙ্গবন্ধু গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামনে যেসব উপাদান তুলে ধরেন তার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়।
বহু বিদেশি পর্যবেক্ষক দেশ বিভাগের সময় পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা পশ্চিম-পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরবর্তী দুই দশকে পশ্চিম-পাকিস্তানের বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে পূর্ববাংলার মানুষের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে থাকে। অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণে কতগুলো বিষয় চিহ্নিত হয়েছে :
ক. ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ববাংলার জনগণের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ৬১ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
খ. ১৯৫০-৫৫ সালে পূর্বপাকিস্তান উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ২০ শতাংশ গ্রহণ করে। ১৯৬৫-৭০ সালে এ পরিমাণ মাত্র ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়। উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৪ ভাগ।
গ. পশ্চিম-পাকিস্তানের মোট রফতানি পণ্যের শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পূর্বপাকিস্তানের স্থায়ী বাজারে বিক্রয় করা হয়। নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে যেসব কাপড় পশ্চিম-পাকিস্তানে উৎপাদিত হয় সেগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয় পূর্বপাকিস্তানে।
ঘ. পূর্বপাকিস্তান থেকে রফতানিযোগ্য আয়ের বর্ধিতাংশ কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম-পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে পূর্বপাকিস্তানের অর্থনীতির উৎসমূলটি ক্রমে ক্ষয়ে যেতে থাকে।
ঙ. পূর্বপাকিস্তানে আয় বৃদ্ধির হার ক্রমে নিম্নগতির দিকে যায়, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পশ্চিম-পাকিস্তানের তুলনায় বাড়তে থাকে। [দ্রষ্টব্য- এন্থনি ম্যাসকারেনহাস প্রণীত দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ, পৃ. ২০]
এ দ্বিমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হন। প্রথমে তিনি প্রতিবাদের আকারে স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দেন পরে সেই আন্দোলনই স্বাধীনতার আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। এহেন কোনো খাত ছিল না যেখানে পশ্চিম-পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সুবিধা ভোগ করেনি। ক্রমে তাদের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫০-৭০ সাল পর্যন্ত তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন ব্যয়ের বৈষম্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে ছিল পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে যথাক্রমে (টাকার হিসেবে) ১৯৯৮০ মিলিয়ন ও ৯৫০০ মিলিয়ন এবং ২৪৪৪০ ও ৩১৬৩০ মিলিয়ন। শুধু তাই নয়, কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই শেষের দুটো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পশ্চিম-পাকিস্তান অতিরিক্ত ৫৯১০ মিলিয়ন গ্রহণ করে বিপরীতে পূর্বপাকিস্তানকে দেয়া হয় মাত্র ৪৫০ মিলিয়ন। [নেহাল করিম, The Emergence of Nationalism in
Bangladesh, অধুনা, ঢাকা ২০০৪, পৃ. ১০৫]
বিনিয়োগের ক্ষেত্র, আমদানি-রফতানির লাইসেন্স প্রদান, শিল্প-কারখানার ওপর কর্তৃত্ব, বরাদ্দকৃত ঋণ, বৈদেশিক সাহায্য ব্যয়, রাজস্ব ব্যয়, কৃষিক্ষেত্র, বন্যা ও সেচপ্রকল্প ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে পশ্চিম-পাকিস্তান অধিকহারে অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামের পোস্টারে পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি চূড়ান্ত চিত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়- পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানে যথাক্রমে রাজস্ব ব্যয় (কোটি টাকা হিসেবে) ১,৫০০-৫,০০০; উন্নয়ন ব্যয় ৩,০০০-৬,০০০; বৈদেশিক সাহায্য ২০ শতাংশ-৮০ শতাংশ; আমদানি ২৫ শতাংশ-৭৫ শতাংশ; কেন্দ্রীয় সরকারের সেবা ১৫ শতাংশ-৮৫ শতাংশ; সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ ১০ শতাংশ-৯০ শতাংশ; চাল প্রতি মণ ৫০ টাকা-১৫ টাকা; আটা প্রতি মণ ৩০ টাকা-১৫ টাকা; সরিষার তেল প্রতি সের ৫ টাকা-২ টাকা; স্বর্ণ প্রতি ভরি ১৭৫ টাকা-১৩৫ টাকা। [নেহাল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২১]
এটা জানা কথা যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কোনো জাতির সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নে নিয়ামক শক্তির ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনে বিজয়ী বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি সরকার সুকৌশলে ২৪ বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে বাঙালিকে শোষণ করে চলে। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় অবস্থানকালেই তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দ্বারা এটা বুঝে নিয়েছিলেন যে, মুসলিম লীগ সরকার বাঙালির জীবনমান উন্নয়নের কোনো পথই সুগম রাখবে না। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এসে তিনি বাংলার মানুষকে নয়া-ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকল থেকে মুক্ত করার পথ খুঁজতে থাকেন। প্রথমে তিনি গঠন করেন পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পরে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে জেলে থাকা অবস্থায়ই দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদই তাকে ক্রমে দলের নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছতে সহায়ক হয়। নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগ আর দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে আওয়ামী লীগকে তিনি বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির ছায়াতল করে তোলেন; তিনি নিজে হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি তাদের এ আপনজনকে তাদের ভাগ্যোন্নয়ের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেও যখন ক্ষমতায় যেতে পারে না পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রে তখনই তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে উত্থাপিত ৬-দফা স্বাধীনতার এক দফায় পরিণত হয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিকে আহ্বান করেন তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। তারই ফল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মৃত্যুর দুয়ার থেকে দেশে ফিরে এসে ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। আজীবন তিনি যে আদর্শ লালন করে এসেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে তিনি সেই আদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি নিয়োজিত ছিলেন পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই। রাজনৈতিক বক্তৃতায় কিংবা সংসদে দেয়া বক্তৃতার সবটা জুড়েই ছিল বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সোনার বাংলা শ্মশান হয়েছিল পাকিস্তানি আমলে, তিনি সেই শ্মশান বাংলাকে আবার সোনার বাংলায় রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ যাতে আর কোনো দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। সংবিধানের চার মূলনীতিই প্রমাণ করে তিনি ভেদ-বৈষম্যহীন একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কতটা আন্তরিক ছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রথম এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর দিকে নজর দিলেই এই সাক্ষ্য মেলে যে তিনি একটি সুষম, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই একটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলতে কতটা আন্তরিক ছিলেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো ছিল নিম্নরূপ-
(১) দারিদ্র্য দূরীকরণ। বেকারদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, কম মজুরিতে নিযুক্তদের মজুরি বৃদ্ধি, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সমতাভিত্তিক আইন ব্যবস্থা।
(২) পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা। কৃষি ও শিল্প খাতসহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে উৎপাদন সামর্থ্য ও সময়োপযোগী মাত্রায় বৃদ্ধি করা।
(৩) বাৎসরিক জিডিপি অন্তত ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি (বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩.৩ শতাংশ হারকে অতিক্রম করা) সার্বক্ষণিক চাকরির সংখ্যা ৪১ হাজারে উন্নীতকরণ, অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তিকে সংগঠিত করা, উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
(৪) খাদ্য, বস্ত্র, ভোজ্যতেল, কেরোসিন এবং চিনির মতো অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর প্রাপ্তি ও স্বল্পমূল্য নিশ্চিত করা।
(৫) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি (যা বিগত বছর থেকে বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে) রোধ করা এবং অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে মূল্য কমানো।
(৬) মাথাপ্রতি বাৎসরিক আয় অন্তত ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। এমনভাবে গতি-নির্ধারণ করা, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পদের তুলনায় অধিক হারে বাৎসরিক আয় ভোগ করতে পারে। আয় এবং সম্পদের ওপর সিলিং ধার্য করে এবং আদায়কৃত রাজস্বের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা করা হবে।
(৭) সমাজতন্ত্রে রূপান্তর প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে সমন্বিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সমাজতন্ত্রমুখী করা এবং এতোদ্দেশ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করা।
(৮) দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে পরনির্ভরতা কমিয়ে আনা। রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতার সঙ্গে আমদানি বিকল্প খুঁজে বের করার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিময়ের ভারসাম্যহীনতা রোধ করা।
(৯) খাদ্য-শস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন, কৃষি ক্ষেত্রে সুযোগ সম্প্রসারণ এবং শহরমুখী শ্রমিক স্রোত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরিভিত্তিক কৃষি-ভিত্তি গড়ে তোলা।
(১০) জনসংখ্যা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের একটি উচ্চাভিলাষী গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পাদন করা; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতির অঙ্গীকার ও সামাজিক সচেতনতা নিশ্চিত করা; জনসংখ্যা পরিকল্পনার জন্য একটি যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টি; অনবরত ও নিবিড় মূল্যায়ন ও গবেষণার ব্যবস্থাসম্পন্ন পরিবার-পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাৎসরিক জনবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে কমিয়ে আনা।
(১১) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ গৃহায়ণ এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে চিরাচরিতভাবে অবহেলিত সামাজিক ও মানবসম্পদের উন্নয়ন সাধন।
(১২) সমগ্র দেশে, ভৌগোলিক অঞ্চল নির্বিশেষে সমহারে আয় ও কর্মের সুযোগ সম্প্রসারিত করা, অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারিত অঞ্চলে শ্রমিকের গমনাগমন উৎসাহিত করা। [মুনায়েম সরকার সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ২০০৮, পৃ. ৬৪৬-৪৭]
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সবটুকু জায়গাজুড়ে ছিল শুকনো মুখ, হাড় জিরজিরে, ঘোলা চোখে পথ দেখে চলা মানুষেরা- বাংলার এ গণমানুষই বঙ্গবন্ধুর মানসপটে একটা স্বপ্ন খোদাই করে দিয়েছিল, ঘিরে দিয়েছিল তার স্বপ্নের ফসলভূমি। স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি। সেই সময় তাকে দেয়া হয়নি। আবহমান বাংলার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটা টেকসই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার যে বাস্তবানুগ পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেই ভিত্তির ওপরই আজকের বাংলাদেশে সমৃদ্ধ অর্থনীতির ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
