বঙ্গবন্ধু ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ
হারুন হাবীব
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মুক্তিযুদ্ধ সবে সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এর বিপিআই, অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের ছোট্ট সংবাদ সংস্থাটায় যোগ দিয়েছি রিপোর্টার হিসাবে। অফিসটি ছিল ব্যক্তি মালিকানার সাবেক পাকিস্তানি সংবাদ সংস্থার ঢাকা ব্যুরো অফিস।
যেদিন যোগ দিলাম, সেদিন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। ঘটনাচক্রে সে দিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সোজা লন্ডন- নতুন দিল্লি হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছলেন। ঘটনাচক্রে নবীন সংবাদকর্মী হয়েও আমার পেশাগত জীবনের প্রথম ‘রিপোটিং অ্যাসানইমেন্ট’ও, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহের কাজ দিয়ে।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে পিআইএ’র বিশেষ ফ্লাইট ৬৩৫- এ চেপে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছলেন। উঠলেন লন্ডনের ক্লেরিজেস হোটেলে। এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দিলেন রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে চেপে ঢাকার পথে যাত্রা করলেন বিজয়ী মহানায়ক। ১০ জানুয়ারি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রা বিরতি করলেন। রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জাতির পিতাকে অবিস্মরণীয় অভ্যর্থনা জানালেন। একুশবার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হলো, ওড়ানো হলো বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হল দুই দেশের জাতীয় সংগীত। ঘণ্টাকয়েক বাদে ঢাকায় পৌঁছলেন মহানায়ক।
কারাগারে বন্দি থেকেও যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে স্বাধীন দেশে স্বাগত জানাল লাখো মানুষ। দেখলাম, সব রকমের নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছে বিমানবন্দরে। রয়াল এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর ঘিরে রাখল উদ্বেলিত জনতা, যা দেখার সৌভাগ্য হলো আমার মতো অনেক সংবাদকর্মীর।
স্বদেশের মাটিতে পা রাখার আগে বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে বিমানের জানালা দিয়ে তার প্রাণপ্রিয় ‘সোনার বাংলা’ দেখলেন, যাকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গোটা মুজিবনগর মন্ত্রিসভা, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব, শীর্ষ ছাত্র নেতারাসহ লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বদেশের মাটিতে আবেগময় অভ্যর্থনা জানালেন। নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী তাকে অভিবাদন জানাল। সম্মান জানালেন ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের শীর্ষ কূটনীতিক। এরপর ধীর গতিতে এগিয়ে চলল বঙ্গবন্ধুর মোটর শোভাযাত্রা। সড়কের দুই পাশে হাজারো-লাখো উদ্বেলিত মানুষ, সবাই একনজর দেখতে চায় বঙ্গবন্ধুকে অসীম আবেগ ও ভালোবাসায়। জাতির পিতা পৌঁছলেন রমনা রেসকোর্সে।
সেই ইতিহাসের রমনা রেসকোর্স, যেখানে অসামান্য এক ভাষণ রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, যা গোটা জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ আরও বললেন- ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’
উল্লেখ্য, দেশে ফেরার একদিন পর, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২, রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন।
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে আগস্ট ১৫, ১৯৭৫। সময়টা নবীন বাংলাদেশের এমন এক সময়, যা আমাদের মতো নবীন সংবাদকর্মীদের আবেগে উচ্ছ্বসিত করেছে, আবার ভয়ংকর সব ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। পেশাগত জীবনের অনুষ্ঠানিক শুরু যেহেতু বিপিআই নামের ক্ষুদ্রায়তনের বার্তা সংস্থায়, সেহেতু নবীন রিপোর্টার হয়েও বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর লেখার সুযোগ হয়েছে আমার- হয়তো বয়োজ্যেষ্ঠদের তুলনায় সামান্যই।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন। অধিবেশন বসে তেজগাঁওয়ের পুরনো পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি ভবনে। আগে যেখানে ৩০০ সদস্যের বসার ব্যবস্থা ছিল, সেখানে গণপরিষদের ৪৫০ সদস্যকে বসতে হয়েছে। মনে পড়ে, এ সংকটের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘যদি এই অ্যাসেম্বলি ভবনও না থাকত, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেন- এ সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি।’
উদ্বোধনী দিনে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপনকালে বঙ্গবন্ধু একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্র্বভৌম গণপরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারছি, সে সুযোগ এ দেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেকদিন থেকে শুরু হয়। জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, তিরিশ লক্ষ ভাই বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নিশ্চয়ই তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখবো।’
১৯৭২ সালের ১ মে (মে দিবস)। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা কয়েকজন মিলে বিভিন্ন আঙ্গিকে খবর লিখে চলেছি সংবাদ সংস্থা থেকে। সে দিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা, স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলার মেহনতি মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এ দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করেছে, এ জন্যে দেশ ও জাতি আজ গর্বিত।’ শ্রমজীবী মানুষের জন্য, সাম্যবাদী সমাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর আবেগ ও দায়বদ্ধতা সে সময়কার প্রতিটি ভাষণ ও বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল।
এরই মধ্যে আসে দেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ। অনেকদিন ধরে অ্যাসেম্বলি অধিবেশনে খসড়া সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলে। অধিবেশনে উপস্থিত থাকেন বঙ্গবন্ধু। মনোযোগ দিয়ে সবার বক্তব্য শোনেন। নোট নেন। রিপোর্টার হিসাবে আমরাও অধিবেশনে যাই। ১২ অক্টোবর ১৯৭২ খসড়া সংবিধানের রূপরেখা বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বক্তৃতা করলেন। শুরুতেই বললেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব : সংবিধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজ আমার সামনে দুটি জিনিস ভেসে ওঠে। একদিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন, অপরদিকে আমার মনে আনন্দ। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন এই জন্য বলি যে, আপনারা জানেন, জনাব স্পিকার সাহেবও জানেন, কারণ আপনি আমার সঙ্গে বিশ বছর রাজনীতি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস আপনার জানা আছে। বিশ বছর পর্যন্ত দেশের জনসাধারণ সংবিধানের জন্য সংগ্রাম করেছে। অনেক উত্থান পতন হয়েছে, অনেক ঝড়-ঝাঞ্ঝা বয়ে গেছে। অনেক রক্তের খেলা হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ মাতৃহারা পুত্রহারার আর্তনাদ। লাখ লাখ বোন আজ বিধবা। কত রক্ত বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে, সে কথা চিন্তা করলে বক্তৃতা করতে আমি পারি না।’
এরপর তিনি তুলে ধরেন সেই ইতিহাস, ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে যে ইতিহাস ১৯৭১ পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়েছে। বলেন, ‘২৫ শে মার্চ প্রথম আমি বলেছিলাম, যে জাতি মরতে শিখেছে, তাকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। তাই আজ রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। গুদামে খাবার ছিল না। ২৭৮টি রেল ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। সমস্ত রাস্তার ব্রিজ, প্রায় ২৭০টার মতো, ধ্বংস করে দিয়েছিল। চাউলের প্রায় সব গুদামই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্যাংকে পয়সা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কলকারখানাগুলো বন্ধ ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। গ্রামের স্কুলগুলোর ফার্নিচার জ্বালিয়ে রুটি বানিয়ে খেয়েছিল। তারা গর্ব করে বলে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের লোক, জয়বাংলা স্বাধীন হবে, কিন্তু এমন ধ্বংস করে দিয়ে যাব, এই দেশের মানুষ আর যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, এবং দুর্ভিক্ষে যেন লাখ লাখ লোক মারা যায়।’
আমাদের প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের সৌভাগ্য যে, আমরা অনেকেই সেদিন প্রেস গ্যালারিতে বসে সংবিধান প্রণয়নের বিতর্ক শুনেছিলাম এবং অংশবিশেষ লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। একই সঙ্গে এটিও আমাদের প্রজন্মের দুর্ভাগ্য যে, সেই সংবিধানকে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান যেভাবে ছিন্নভিন্ন করেছিলেন, সেটিও আমাদের দেখতে হয়েছে!
গণপরিষদের পূর্ণ অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন লাভ করে ৪ নভেম্বর ১৯৭২, দেশ স্বাধীনের মাত্র ১০ মাসের মাথায়- যা এক অসামান্য কৃতিত্ব জাতির পিতার। রাষ্ট্র নায়কোচিত গাম্ভীর্যতায় তার বক্তব্য দিলেন সেদিন বঙ্গবন্ধু। আমরা সেদিন তার কণ্ঠে ইতিহাস পড়তে দেখেছিলাম। এমন এক ইতিহাস- যা যৌথ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিককে ২৩ বছর ধরে বারবার আঘাত হেনেছে, বারবার আশাহত করেছে। আর সেই আঘাতের পথকে প্রশস্ত করেছে কিছু ক্ষমতালোভী বাংলা ভাষাভাষী রাজনীতিবিদ!
তোপখানা রোডের পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব বাংলাদেশের জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিণত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ঢাকার মাটিতে যেদিন পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমরা নবীনেরা তখনো ক্লাবের সদস্য হইনি, যদিও সিনিয়রদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সুবাদে ব্রিটিশ আমলের লাল বিল্ডিংটাতে গিয়ে চা-পুরি খেয়ে আসার ঘটনা অবাধেই চলে আমাদের।
এদিকে স্বাধীনতার পরক্ষণে নতুন উদ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক আজাদ ও বাংলার বাণী। এরই মধ্যে দৈনিক পাকিস্তান দৈনিক বাংলা হয়েছে ; পাকিস্তান অবজারভার হয়েছে বাংলাদেশ অবজারভার। এ ছাড়া আছে মর্নিং নিউজ, পূর্বদেশসহ বেশ কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। পাকিস্তান আমলের ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান’ -এপিপি হয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)। আগের ‘ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি’ও কাজ শুরু করেছে। দেশের যে সংবাদপত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর তাণ্ডবে অবরুদ্ধ ছিল, কঠোর সেন্সরশিপের কারণে মন খুলে কিছু লিখতে পারেনি, তারা মন খুলে নতুন দেশ ও নতুন সরকারকে স্বাগত জানাতে থাকে। একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের বাঙালি দোসরদের দেশজুড়ে নিষ্ঠুরতার বিস্তারিত বিবরণ ছাপতে থাকে। প্রকাশ হতে থাকে একের পর এক বাংলাদেশকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদানের খবর।
মনে পড়ে, জাতির পিতা প্রথম জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসেন ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই। সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেসনে বক্তব্য দেন। ক্লাবে ঢুকেই তিনি পুরনো কর্মচারীদের সঙ্গে করমর্দন করেন, কারও কারও সঙ্গে বুক মেলান হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে। তার সেদিনের ভাষণটি ছিল স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাংবাদিকতা ও বিদ্যমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যময় একটি ভাষণ। জাতির পিতা সেদিন অকপটে এমন কিছু সত্য তুলে ধরেন - যা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর সে দিনের ভাষণটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস নির্মাণ ও যুদ্ধ পরবর্তীকালের সমাজ বাস্তবতা অনুধাবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। কারণ সদ্য-স্বাধীন দেশের অনেক রূঢ় বাস্তবতার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন সেদিন।
ভাষণ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেদিন এভাবে : ‘আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তারা আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। আমি অনেকদিন তাদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। এবারের সংগ্রামে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারা আজ আমাদের মধ্যে নাই। তেমনি নাই ৩০ লক্ষ লোক, যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তাদের কথা চিরদিন আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে এবং যে আদর্শের জন্য তারা জীবন দিয়েছেন, সে আদর্শে যদি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়, তাহলে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।’
তিনি বলেছিলেন : ‘সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার কয়েকটা স্পষ্ট আরজ আছে। আপনারা জানেন, বিপ্লবের মাধ্যমে এ স্বাধীনতা এসেছে এবং সে বিপ্লব ছিল রক্তক্ষয়ী। এমন বিপ্লবের পর কোনো দেশ কোনো যুগে এতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এ জন্য আপনাদের কোনো কাজে কখনো কোনো রকম হস্তক্ষেপ করি নাই। নতুন বাংলাদেশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ, আমাদের তাই নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। শুধু মুক্তিবাহিনীর ভাইয়েরাই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করে নাই। জনগণকেও লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী যাওয়ার সময় আমাদের স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গেছে। আমাদের কাছে এর দলিল আছে। শত্রুদের বিচারের সময় আপনারা সেসব দলিল দেখতে পাবেন।’
দেশ স্বাধীনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় নতুন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গতিপথ ব্যাখ্যা করেন জাতির পিতা। বলেন : ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এ চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি এবং এসব আদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, এটাও আপনারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন। আমরা এ চারটি আদর্শের ভিত্তিতেই দেশের শাসনতন্ত্র তৈরি করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্রের একটা মূলনীতি আছে। গণতন্ত্রের অর্থ পরের ধন চুরি, খুন-জখম, লুঠতরাজ বা পরের অধিকার হরণ করা নয়। তার জনকল্যাণমূলক একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও এমনি একটা নীতিমালা আছে। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যারা সামরিক চক্রের হীন কাজে সহায়তা করেছেন। তারাই ধরিয়ে দিয়েছেন সেসব সাংবাদিককে, যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। এ তথাকথিত সাংবাদিকদের একজন কোনো দৈনিক কাগজে সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করতেন। তিনি আল-বদরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। এমন সাংবাদিকও আছেন, যাদের এই ধৃষ্টতামূলক কাজের নজির আমাদের কাছে আছে। তারা হানাদার বাহিনীকে সংবাদ সরবরাহ করতেন। কিছু কিছু সাংবাদিক নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করতেন, কিন্তু তারা স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্টে খবর সরবরাহ করেছেন। আপনারা কি বলবেন যে, তাদের গায়ে হাত দিলে গণতন্ত্র এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর আঘাত করা হবে?’
বঙ্গবন্ধু সেদিন আরও স্পষ্ট করে বলেন : “যিনি একদিন দৈনিক ‘পয়গাম’ চালাতেন, তিনি যদি আয় উপার্জনহীন কোনো ব্যক্তির আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি একখানি দৈনিক কাগজ বের করেন, তা হলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এ মালিকের টাকা কোত্থেকে এলো? এরপর আবার এ রাতারাতি গজিয়ে-ওঠা মালিক-সাংবাদিক সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখতে আরম্ভ করলেন। ...রাতারাতি একটা কাগজ বের করে বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে কেউ যদি বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা সহ্য করবেন না। কারণ, তা আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করবে। ‘ওভারসিজ পাকিস্তান’ নামে কোনো সংস্থা যদি এখান থেকে খবরের কাগজ প্রকাশ করে, তাহলে আমাকে কী করতে হবে? আপনারা সামান্য কিছু লোকের স্বার্থ দেখবেন, না সাড়ে সাত কোটি লোকের স্বার্থ, যে ৩০ লাখ লোক রক্ত দিয়েছে, তাদের স্বার্থ দেখবেন?”
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সদ্য স্বাধীন দেশের অনেক রূঢ় বাস্তবতা উঠে এসেছিল। তিনি বলেছিলেন : ‘আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন। আমিও বলি। কিন্তু কোনো কোনো খবরের কাগজে এমন কথাও লেখা হয়, যা সাম্প্রদায়িকতার চরম। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চব্বিশটি বছর প্রগতিশীল সাংবাদিকরা সংগ্রাম করেছেন। আমরা সংগ্রাম করেছি, বাংলার মানুষ সংগ্রাম করেছে। আমাদের ছেলেরা, কর্মীরা জান দিয়েছে, জেল খেটেছে। সে নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো সাংবাদিক লেখেন তাহলে আপনারা কী করবেন? এটাও আপনাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। একখানা কাগজে লেখা হয়েছে, ‘গণহত্যা চলছে।’ গণহত্যার কথাই যদি বলেন, তবে আমি আপনাদের বলব যে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় বহু আওয়ামী লীগ কর্মী আর প্রগতিশীল কর্মী মারা গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে গণহত্যা হয় নাই। এ জন্য দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এত বড় বিপ্লবের পর, হানাদারদের দ্বারা সংঘটিত এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরও যে আর একটা হত্যাকাণ্ড হয় নাই, তার জন্য বাংলার মানুষ ও প্রগতিশীল কর্মীদের আপনারা নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাবেন। অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলে থাকেন। যারা আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করেছে তারা নাকি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখবার চেষ্টা করছে। এ ধরনের কথা বলা কি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা? এর নাম কি গণতন্ত্র?’
তিনি আরও বলেন : ‘অনেক কাগজের শিরোনাম আমার কাছে আছে। এ কাগজগুলো ফরমান আলী খানের দয়ায় ঢাকায় বসে নয় মাস কাজ করেছে, কিন্তু তাদের আজও ছোঁয়া হয় নাই। অনেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক মা-বোন-বউ ঘরে ফেলে অকূল পাথারে ভেসে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ফরমান আলীর অনুগ্রহভাজনরা এখানে বসে আরামে খবরের কাগজ চালান এবং হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এরপর স্বাধীনতা পেয়ে তারা রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে গেছেন। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে লেখেন। তাদের সরকার ক্ষমা করতে পারে, জনগণ ক্ষমা করবে কিনা সন্দেহ আছে।’
বিপ্লবোত্তর দেশের সাংবাদিকতার নীতি ও আদর্শের নিরিখে নিজের সুচিন্তিত মনোভাবও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। সদ্য স্বাধীন দেশে যেভাবে একটি শ্রেণির হাতে দেশবিরোধী তৎপরতা চলে আসছিল, মূলত সেদিকেই তিনি আলোকপাত করেন। ‘সরকারের যেমন স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আছে, তেমনি নীতি পালনের দায়িত্ব আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও আছে। আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোন কাগজে লেখা হয়েছে, ‘মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও’। যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চান তা হলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন?’
দৃশ্যতই বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যর্থ করতে পরিকল্পিত প্রয়াস চলছিল তখন। স্বাধীনতার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সরকারের সমালোচনা তুঙ্গে তোলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য। এ ছাড়া পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করা হচ্ছিল ক্রমাগতভাবে।
বিস্তারিত উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেন : ‘অনুগ্রহ করে একটু নিজেদেরও স্ক্রিনিং করুন। একটু বলুন, এই লোকগুলো এই কাজ করেছে। আমরা তা মেনে নেব। আর যদি নিজেরা কিছু না করেন আমাকে বলবেন। আমি করব। আমাকে করতেই হবে। কারণ, পাকিস্তানের নামে পয়সা নিয়ে এসে যদি কেউ রাতারাতি খবরের কাগজ বের করে আর মানুষের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সব নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করবার চেষ্টা করে, এখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াবার চেষ্টা করে, জাতির আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সেটাকে স্বাধীনতা বলা যায় না। সে স্বাধীনতা কোনো সরকার, কোনো জনগণ, কোনো প্রগতিশীল দল কোনোদিন সমর্থন করতে পারে না।’
তিনি বলেছিলেন : “আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা, আমি চেষ্টা করে দেখছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমার আন্দোলন। সেই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আমাদের আদর্শ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। রাজাকার, আল-বদররা এখন কিছু কিছু বড় বড় প্রগতিশীল নেতার আশ্রয় নিয়ে ‘প্রগতিশীল’ বনে গেছে। আসলে তারা খুনের মামলার আসামি। তাদের নামে হুলিয়া রয়েছে। -এ ক্ষেত্রে আমার কর্তব্য কী, আপনারাই বলুন ?”
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে অগাস্ট ১৫, ১৯৭৫। সময়টা নবীন বাংলাদেশের এমন এক সময়, যা আমাদের মতো নবীন সংবাদকর্মীদের একদিকে আবেগে উচ্ছ্বসিত করেছে, আবার ভয়ংকর সব ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছি। ওই সময় এ রকমই একটা ধারণা নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাকিরা লুকিয়ে আত্মরক্ষা করছে, আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াবে না, দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু এ বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম হয়েছিলাম যে, যুদ্ধে হেরে আত্মসমর্পণ করেছে কেবল পাকিস্তানি সৈন্যরাই, তাদের দেশীয় অনুচররা নয়। এই ‘পাকিস্তানি ছিটমহল’গুলো কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, সব অঙ্গনেই বিরাজ করেছিল।
অতএব, প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেদিন পরিস্থিতির গভীরতা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম বৈকি। একদিকে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, মুক্ত তথ্য প্রবাহের স্বাভাবিক দাবি, অন্যদিকে সেই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলার ভয়ংকর সব পরিকল্পিত প্রয়াস! সংকট অনুভব করতে পারলেও আমাদের মতো নবীণদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘটনার বয়ান শুনে আমরা নবীণরাও ভাবতে শুরু করেছিলাম - যে কোনো মূল্যে এ সর্বনাশ প্রতিহত করা উচিত।
সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারকে আঘাত করতে আরও যে অস্ত্রটির ব্যবহার করা হয়েছিল- তা ভারত প্রসঙ্গ। যে ভারতের সর্বাত্মক সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই ভারতকে ঘিরেই পরিকল্পিত কুট প্রচারণা চালানো হয়েছে। বলা হচ্ছিল, ভারতীয় মিত্র বাহিনী, যারা মুক্তি বাহিনীর হাতে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, অনেকে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের মাটি থেকে আর কখনোই নিজ দেশে ফিরে যাবে না। আরও বলা হচ্ছিল- ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চায়, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়, সত্যিকারভাবে স্বাধীন হতে দিতে চায় না।
কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন বলেই এসব অপপ্রচার হালে পানি পায়নি। মাত্র দুই মাসের মাথায় ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটি থেকে নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। ঢাকা স্টেডিয়ামটির অবস্থান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ঘেঁষে, আমাদের বিপিআই সংস্থা অফিস থেকে হেঁটে গেলে মাত্র দুই মিনিটের পথ। অতএব, গিয়ে পৌঁছলাম আমি। একজন গেরিলা যোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টরে রণাঙ্গন সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেছি বলে ঘটনাচক্রে তিনটি অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ হয় আমার। প্রথমটি স্টেনগান, দ্বিতীয়টি ক্যামেরা এবং আরেকটি কলম। ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল আবু তাহেরের দেওয়া ক্যামরাটা তখনো আমার কাছে। সেটি নিয়েই বসে পড়লাম স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। গোটা স্টেডিয়াম লোকারণ্য। এক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন, তাকে স্যালুট জানালেন মিত্র বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং তার বাহিনীর সদস্যরা। এরপর ঘটল সংক্ষিপ্ত সামরিক কুচকাওয়াজ। উল্লেখ্য, তার মাত্র চার দিনের মাথায়, ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি, যার অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজ ২০২১ সালে এসে যখন পেছনের দিকে তাকাই, ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকাই, তখন কেবলই মনে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ বছরের পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিয়ে কেবল একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মই দিতে চাননি, সেই রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে, একটি শোষণমুক্ত দেশ হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে স্বপ্ন পূরণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন, এমনকি তার দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছিল। এ ষড়যন্ত্র কেবল লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছ থেকেই আসেনি, এসেছিল ‘অতিবিপ্লবী’ কিছু মহল থেকেও।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
