Logo
Logo
×

২২ বছরে যুগান্তর

করোনায় বিপর্যস্ত বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থা

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

করোনায় বিপর্যস্ত বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থা

মেরুদণ্ডে ব্যথা নিয়ে কেউ যেমন তার শারীরিক সুস্থতার দাবি করতে পারে না, একইভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করে কোনো দেশ উন্নত হতে পারে না। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা করোনা আসার আগে থেকেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। বিচিত্র পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষাদান পদ্ধতি- সর্বত্রই ছিল শৃঙ্খলা ও মানের অবনমন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও কোনো লাভ হয়নি। বাড়েনি বাজেটে শিক্ষাখাতে প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্দ। সম্ভব হয়নি মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ও তাদেরকে প্রশিক্ষিত করার উপযোগী ব্যবস্থা।

শিক্ষায় ছড়িয়ে পড়েছে বণিকবৃত্তির প্রভাব এবং রাজনীতি। ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী এবং কূটনীতিকরাও জড়িত হয়ে পড়েন শিক্ষা ব্যবসায়। এ ব্যাপারে সুশৃঙ্খল সরকারি নিয়ন্ত্রণ লক্ষিত হয়নি। ভাষা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য সর্বস্থরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যাপারটি ভেস্তে গেছে অনেক আগেই। বাড়ছে ইংরেজি, আধা-ইংরেজি ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা। শিক্ষায় বাংলা ভাষা হয়েছে অবহেলিত। নব্য টাকাওয়ালা অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে খুশি হচ্ছেন। রাস্তার মোড়ে চিপা গলির মধ্যে গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ স্কুল। এসব স্কুলের সব যে খারাপ আমি তা বলছি না। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক স্কুলে ছেলেমেয়েরা না শিখতে পারছে ইংরেজি না শিখতে পারছে বাংলা। আবার এর মধ্যে রয়েছে চার-পাঁচ রকম মাদ্রাসা। আলিয়া, কওমি, ফোরকানিয়া, হাফিজিয়া, ক্যাডেটসহ আরও নানা রকমের। আবার রয়েছে কিছু মিশনারি স্কুল ও এনজিও পরিচালিত স্কুল। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে এমন নৈরাজ্য।

এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করে রাজনীতিবিদরা আশা করেন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা কি এতই সহজ? বাংলা মিডিয়ামে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর মানসিকতা কি এক রকম হবে? যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে আর যে বাংলা মিডিয়ামে পড়বে- তাদের দু’জনের মধ্যে তো একই রকম চিন্তা-ভাবনা গড়ে উঠবে না। যে শিক্ষার্থী ক্যাডেট কলেজে পড়বে, আর যে শিক্ষার্থী মিশনারি স্কুলে বা এনজিও পরিচালিত স্কুলে পড়বে তাদের মানসিকতা অবশ্যই এক রকম হবে না। বিভিন্ন সরকার ও ওইসব সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা অনেকবার শুনেছি যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় একরূপত্ব সৃষ্টি করা হবে। এদের ঘোষিত ‘একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা’ পদবাচ্যটি আমরা অনেকবার শুনেছি। কিন্তু তা কার্যকরী হতে দেখিনি। শুনেছি সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কথা, তাও ব্যর্থ হয়েছে। নিম্ন পর্যায়ে সুযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব না হওয়ায় সুযোগ্য ছাত্র তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় যেসব ছাত্র পাচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন হচ্ছেন না।

উচ্চশিক্ষার অবস্থা যে আরও খারাপ তা না বললেও চলে। ১৫-২০ বছর আগেও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে লেখাপড়া করতে কিছু শিক্ষার্থী আসত। এখন এ দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা সেসব দেশে শিক্ষার জন্য যায়। কারণ- ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যতটা উন্নত করতে পেরেছে বাংলাদেশ তা পারেনি। এ কারণেই বিদেশি শিক্ষার্থীদের এ দেশে আসার সংখ্যা কমে গেছে। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে যেখানে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে এসেছিলেন ৮০৪ জন, সেখানে ২০১৯ সালে সে সংখ্যা কমে এসে ৪৮২ জনে। দেশের ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা অধ্যয়ন করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে বিদেশি ছাত্র কমে যাওয়ার কারণ কী? একজন বর্ণহীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমার মূল্যায়নে এর অন্যতম কারণ হল রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক ইমেজ হারিয়ে এর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি প্রকট করে তুলেছে। বড় সরকারি চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ১৯৭৩-এর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ/আইন কর্তৃক। পদে পদে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ আইনকে লঙ্ঘন করছে। এ আইন অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হবেন সিনেট সদস্যরা কর্তৃক নির্বাচিত তিন সদস্যের প্যানেল থেকে আচার্য কর্তৃক। কিন্তু এ চর্চা লক্ষিত হয় না। সরকার তার গুডবুকে থাকা কোনো শিক্ষককে সরাসরি ভিসি নিয়োগ করে দেন। যে দল সরকারে থাকে সে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বর্ণধারী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো সিদ্ধান্তগ্রহণে প্রভাব বিস্তার করেন। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব রকম কাজে এ রাজনীতির প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে পেশাদারিত্ব নষ্ট করে।

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতি ও আর্থিক লেনদেনের চর্চার বিষয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর একটি গবেষণায় ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার নিয়োগের তথ্য জরিপ করে দেখিয়েছে, ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার নিয়োগে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে উচ্চশিক্ষার জন্য এর চেয়ে মারাত্মক সংবাদ আর কি হতে পারে! শিক্ষক যদি মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত না হয়ে আর্থিক লেনদেন ও রাজনীতির প্রভাবে নিযুক্ত হন, তাহলে তিনি শিক্ষার্থীকে কি শিখাবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থাও ত্রুটিপূর্ণ। একজন প্রাইমারি স্কুল বা হাই স্কুলের শিক্ষক হতে হলেও যেখানে লিখিত নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করতে হয়, তারপর অনেকক্ষেত্রেই ক্লাস প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, পরে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতায় ভালো করতে পারলে তারপর তিনি শিক্ষক হতে পারেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগে কোনো লিখিত পরীক্ষা ও ক্লাস প্রেজেন্টেশন ছাড়াই একটি নামকাওয়াস্তের সংক্ষিপ্ত মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে প্রভাষক নিয়োগ করা হয়। ফলে এখানে মেধার মূল্যায়ন হয় না। প্রকৃত বাস্তবতা হল, কাকে নিয়োগ দেয়া হবে সে সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রাখা হয়। মৌখিক পরীক্ষার মেলোড্রামা হয় অধিকাংশক্ষেত্রে লোক দেখানোর জন্য।

আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে তাদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স ও উন্নত গবেষণা কাজ আশা করি তাহলে তা কেমন করে সম্ভব? এসব শিক্ষকের অনেকেই নিজের মূল দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সান্ধ্যকালীন কোর্সে পড়াতে অধিক আগ্রহী। এদের কিছুসংখ্যক আবার একাডেমিক কাজের চেয়ে বেশি আগ্রহী রাজনৈতিক কাজে। আর তাদের এ আগ্রহ বাড়ে সরকারের দ্বিমুখী ভূমিকার কারণে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মাননীয় মন্ত্রীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাজ হল লেখাপড়া ও গবেষণা করা। রাজনীতি করা তাদের কাজ নয়। কিন্তু ডেপুটেশনে কোনো বড় পদে কোনো শিক্ষককে নিয়োগ দিতে গেলে তখন দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে বেশি করে দেখা হয় তার রাজনৈতিক বর্ণ পরিচয় ও আনুগত্য। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি করার প্রবণতা বাড়ে। তাদের অনেকের মধ্যে গবেষণা করার প্রবণতা সক্রিয় দেখা যায় না। ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই সময়ের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই বছর একটিও গবেষণা কাজ প্রকাশিত হয়নি। যেখানে নতুন প্রজন্মের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ১,৭৩৯টি, সেখানে দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা হয়েছে মাত্র ৪৭২টি (যুগান্তর : ১১-০১-২০২১)। নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নেশা নেই। তাদের মধ্যে যে দু’চারজন গবেষণা করছেন, তা তারা করছেন পদোন্নতির জন্য।

এসব গবেষণার মধ্যে আবার রয়েছে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ। অন্যের লেখা নিজের বলে প্রকাশ করার অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। এসব নিয়ে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। এসব কমিটি অনেকক্ষেত্রে নকল করে প্রবন্ধ লেখার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। এ ছাড়া যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে অযোগ্য প্রার্থীদের অবৈধভাবে চাকরি দেয়ায় তাদের ক্লাস পারফরম্যান্স ভালো হয় না। শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় শিখতে পারেন না। ছাত্রছাত্রী কর্তৃক শিক্ষকতার মূল্যায়ন ব্যবস্থা (স্টুডেন্ট ইভালুয়েশন) না থাকায় এসব শিক্ষক অবসরগ্রহণ পর্যন্ত চাকরিতে টিকে থাকতে পারেন। তুলনামূলকভাবে অযোগ্য হওয়ায় এরা নিজেদের পদোন্নতির জন্য গবেষণা প্রকাশনায় পিছিয়ে পড়েন। তবে কেউ কেউ আবার দলবাজ সিনিয়র শিক্ষকদের স্মরণাপন্ন হয়ে এবং তাদের চাটুকারিতা করে তাদেরকে দিয়ে নিজের নামে প্রকাশনা করিয়ে নেন। বিনিময়ে এসব সুবিধাভোগী জুনিয়র শিক্ষকরা ন্যায় ও সত্যের পথ পরিহার করে ওইসব সিনিয়র শিক্ষকদের ক্লায়েন্টে পরিণত হন। এভাবে অনেক সিনিয়র শিক্ষক নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক জুনিয়র শিক্ষকের একাডেমিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেন। তাদেরকে একাডেমিকভাবে পঙ্গু করে ফেলেন।

দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার যখন এমন করুণ চিত্র, তার মধ্যে ২০২০ সাল থেকে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনমনের গতি অধিকতর বেগবান হয়। প্রথমদিকে ‘সাট ডাউন’ আর ‘লক ডাউন’ শুরু হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ আর নিস্তব্ধ। বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস আর পরীক্ষা। প্রথম মাসছয়েক যাওয়ার পর একটু ভয় কমলে ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করে। কারণ, এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র ভর্তি করতে না পারলে তাদের মুনাফা অর্জন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরে ধীরে সময় নিয়ে কিছু অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এসব ব্যাপারে আবার তরুণ প্রজন্মের শিক্ষকরা যতটা পারদর্শী, বয়স্ক শিক্ষকরা ততটা অভিজ্ঞ নন। তাছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই অসচ্ছল পরিবার থেকে আগত। তাদের অনেকেরই ল্যাপটপ নেই। নেই অ্যানড্রয়েড ফোন। ফলে অনলাইন ক্লাস নিলেই তারা যে সেসব ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে এমন ভাবা যায় না।

অনলাইন লেখাপড়ার আরও অনেক অসুবিধা আছে। এতে ক্লাস পার্টিসিপেশন কম হয়। কে কখন ক্লাসে ঢুকছে, আবার কখন বের হয়ে যাচ্ছে তা নির্ণয় করা কঠিন। ক্লাস পার্টিসিপেশন নিশ্চিত করাও দুরূহ। তাছাড়া শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আই কন্টাক্টের ব্যাপার ঘটে না। কঠিন বিষয়গুলো ব্লাকবোর্ডে লিখে ব্যাখ্যা করা যায় না। পরীক্ষা গ্রহণ, টিউটোরিয়াল, ল্যাব ওয়ার্ক, খাতা মার্কিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তার পরও কেবল ভার্চুয়াল ক্লাস সম্পর্কে আরও একটি বিষয় বলতে বাকি থেকে যায়। বিষয়টি হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কেবল বই পড়ে শিখেন না। তারা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ করেও অনেক কিছু শেখেন। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চায়ের আড্ডা থেকেও শেখেন বিস্তর। ভার্চুয়াল ক্লাস-নির্ভর লেখাপড়ায় শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় শিক্ষকের বডি ল্যাংগুয়েজ ও তার সান্নিধ্য থেকে।

করোনাভাইরাসের মধ্যে এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিষ্প্রাণ ক্যাম্পাসে চলছে শিক্ষা ব্যবস্থা। ক্লাস না হয় চলল, কিন্তু পরীক্ষার কি হবে? আমার নিজের বিভাগে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর করোনার কারণে আটকে ছিল। অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সে দুটি বর্ষের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। বিভাগ থেকে প্রতি শিক্ষার্থীকে মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। এক্সাম হলের দরজায় লিখে দেয়া হয়েছে ‘নো মাস্ক নো এক্সাম।’ তবে এভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাভাবিকতা আনা যায় না। ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল পরিপূর্ণভাবে না খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিকতা আনা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এ ব্যাপারে সরকারি দিকনির্দেশনা অবহেলা করে না। সরকারের করোনা পলিসির মধ্যে অনেকে কিছুটা রাজনীতি খুঁজে পান। সরকারের কাছে তো সব মানুষের জীবনের মূল্য একই রকম হওয়া উচিত। জীবনের ঝুঁকি আছে মনে করে সরকার যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় না খুলেন তা মেনে নেয়া যায়। তাহলে কোন যুক্তিতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো লেখাপড়া জানা সচেতন লোকজনের পরিবর্তে অশিক্ষিত, শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত লোকজনের সমাগম হয় এমন প্রতিষ্ঠান সিভিল কোর্ট খুলে দিয়েছেন? সেখানে বিচারপ্রার্থীদের ভিড়ে কি করোনার ঝুঁকি নেই? এ কারণে অনেকে সন্দেহ করছেন, শীতকালের আন্দোলনের মৌসুম শেষ হলে সরকার হয়তো বৃষ্টি শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে চাইবে।

করোনায় বা করোনাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্পন্ন করতে হলে নতুন পরিকল্পনা করে একে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে মেধার মূল্যায়ন না করে আর্থিক লেনদেন ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দুর্নীতি করলে তাদেরকে কেবল পদ থেকে সরিয়ে না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক নয় একাডেমিক চর্চার গতি বেগবান করতে হবে। যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং কমিশনে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে মঞ্জুরি কমিশন যেসব নির্দেশনা দেয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেসব নির্দেশনা পালন করে না। কয়েক মাস হল ইউজিসি নির্দেশ দিয়েছে যে, কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য ও কোষাদক্ষ পদ খালি রাখা যাবে না। এখনও সে নির্দেশনা সব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করেনি। এভাবে শিক্ষাঙ্গনকে একাডেমিকভাবে প্রাণবন্ত করতে হলে শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি কমিয়ে এর একাডেমিক ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সম্মানিত শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, তিনি রাজনীতি করতে চাইলে যে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে রাজনীতির ময়দানে নামার তার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির চর্চা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের অবনমন ঘটানোর তার কোনো অধিকার নেই। শিক্ষার্থীদেরও উচিত সারা বিশ্বের মতো শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি চর্চা না করে তাদের একাডেমিক স্বার্থ নিয়ে কথা বলা। এভাবে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, শিক্ষক, ছাত্র এবং অভিভাবক- সবাই সতর্ক হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করলে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও মানসম্পন্ন হয়ে উঠবে। বর্তমানের বিপর্যস্ত করোনাকবলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এ ভাইরাসের তিরোধানের পর আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

করোনা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম