চতুর্থ পর্ব : সাহিত্য সংস্কৃতি
বঙ্গবন্ধু, শিল্পাচার্য ও বাংলাদেশের সংবিধান
হাশেম খান
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতর পর মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন দেশকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসে অর্থনৈতিক ভিতকে শক্ত করে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন।
বিদ্যমান শত শত সমস্যার দ্রুত নিরসনে মনোযোগী হয়ে প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যেই সে সব সমস্যা উত্তরণে ও দেশের বিভিন্নমুখী উন্নয়নে পরিকল্পনা করে দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে লাগলেন। মাত্র আট মাসের মধ্যেই ১৯৭২ সালে দেশের আইনশৃঙ্খলার সংস্কার ও জনগণের জীবনযাত্রাকে স্থবিরতা থেকে মুক্ত করে সচল করার লক্ষ্যে সংবিধান রচনা করে ফেললেন। একটা নতুন দেশে এত দ্রুত সংবিধান দেওয়া একটি বিস্ময়কর ঘটনা। যেটা বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।
এ সংবিধান গ্রন্থটি স্বাভাবিকভাবে মুদ্রিত হলেই চলত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরেকটি অভাবনীয় ঘটনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘটিয়ে ফেললেন। সাধারণভাবে মুদ্রণ নয়। সংবিধান গ্রন্থটি শৈল্পিকভাবে বা নান্দনিক রূপে জনগণের হাতে হাতে তুলে দেবেন। এটির শৈল্পিক রূপ দিতেই শরণাপন্ন হলেন শিল্পাচার্য জয়লুন আবেদিনের।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
তিনবার তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। খুব কাছে থেকে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়েছিল। আর যে মানুষটির কারণে প্রথবার বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে পেরেছিলাম তার নাম নূরুল ইসলাম। নূরুল ইসলাম তার কিশোর বয়স থেকে, সেই পঞ্চাশের দশক (১৯৫০) থেকে আওয়ামী লীগের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী, বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন, অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রচার কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পোস্টার তৈরি করা, লিফলেট, পুস্তিকা ও বিভিন্ন রকম প্রচার কাজ, মুদ্রণ, বিলি ও সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি সুচারুরূপে সমাধা করার জন্য একজন পারদর্শী ও সাহসী ব্যক্তিত্ব এই নূরুল ইসলাম। স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে যে সাড়া জাগানো পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ শিরনামে প্রকাশিত হয়েছিল- তার রূপকার ছিলেন এই নূরুল ইসলাম। প্রচার কাজে তার নিষ্ঠা ও কর্মোদ্দীপনার কারণে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা অনেকেই তাকে সম্বোধন করতেন ‘পোস্টার নূরুল ইসলাম’ নামে। যদিও এই ‘পোস্টার’ নামে তিনি পরিচিতি হতে পছন্দ করতেন না।
১৯৬৬ সালের এক সন্ধ্যায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন তিনি আমার ঠিকানায়, ২৫ গোপীবাগ ৩য় গলির বাড়িতে। বললেন, আওয়ামী লীগের ৬ দফার লোগো, পতাকা, প্রচার পুস্তিকা, প্রচ্ছদ ও পোস্টার ইত্যাদি করতে হবে। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এসেছি তিনিই আপনাকে দিয়ে সব কিছু আঁকিয়ে নিতে বলেছেন।
নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার মুখোমুখি কোনো পরিচয় ছিল না তবে ছাত্রলীগের অনেকের সঙ্গেই তৎকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পোস্টার, ফেস্টুন ডিজাইন করা, ছবি আঁকা ইত্যাদির কারণে পরিচয় ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাদের যেমন- শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রব, আবদুর রাজ্জাক, শামসুজ্জামান খান, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, আবদুল আজিজ বাগমার, মাযহারুল ইসলাম বাকী প্রমুখ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য পোস্টার এঁকেছি, তৈরি করেছি। পোস্টার আঁকা, পুস্তিকার প্রচ্ছদ কিংবা কোনো সভা বা অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা ইত্যাদি কারণে জনাব নূরুল ইসলাম যখন তখন আমাকে কাজে লাগাতেন। হয়তো আন্দোলনের কাজে আমার আগ্রহ দেখে প্রচার কাজের বিভিন্ন শিল্পকর্মে তিনি আমাকে আস্থাভাজন মনে করতেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ফরমায়েশ অনুযায়ী নূরুল ইসলামসহ, তার সঙ্গে মিলেমিশে সেই ষাটের দশকে কত পোস্টার, ফেস্টুন যে এঁকেছি, ছবি এঁকেছি, প্রচার পুস্তিকার প্রচ্ছদ এঁকেছি আজ তার হিসাব মেলানো কঠিন কাজ।
যা হোক, তৎকালীন (১৯৫৮ সাল থেকে এক দশকের বেশি সময়) পাকিস্তানের সামরিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং তার থেকে মুক্তি পাওয়ার সনদ আওয়ামী লীগের ছয় দফা যা শিগগিরই ঘোষণা করতে যাচ্ছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফার লোগো, পতাকার নকশা ইত্যাদি কাজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আমার মতো এক তরুণ শিল্পকর্মীকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, আমি খুবই ভাবনায় পড়ি। নূরুল ইসলামকে বলেই ফেলি অনেক বড় বড় ও অভিজ্ঞ শিল্পী আছেন তাদের কাউকে দিয়ে কাজটা করালে ভালো হতো না?
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সবকিছু আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। ছয় দফার এসব কাজ আপনিই করবেন। নূরুল ইসলামের পরিষ্কার জবাব।
প্রায় সাত-আট দিন অনেক নকশা এঁকে, জল্পনা-কল্পনা করে ছয় দফায় লোগো, পতাকার নকশা, পোস্টার ও অন্যান্য শিল্পকর্ম দাঁড় করলাম। শেখ ফজলুল হক মনি ও নূরুল ইসলাম ভাই কাজগুলোসহ আমাকে নিয়ে একেবারে নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুখোমুখি। তৎকালীন হোটেল ইডেনের সামনের মাঠে সভার ব্যবস্থা করে ছয় দফা জনসাধারণের সম্মুখে ঘোষণা দেওয়া হবে। তার প্রস্তুতি পর্বের কাজের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন হোটেল ইডেনের বারান্দায় আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে বসে আলাপ আলোচনা করছেন। শেখ মনি ও নূরুল ইসলাম আমার আঁকা নকশা ও অন্যান্য শিল্পকর্ম তার সামনে তুলে ধরলেন। এই প্রথম আমি বঙ্গবন্ধুর সামনে (তখন অবশ্য বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি)। তাই খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার আঁকা নকশা, পোস্টার ইত্যাদি তার পছন্দ হবে তো! এরপর এখানে উপস্থিত রয়েছেন অন্যান্য নেতা। তারা সবাই কী বলেন কে জানে!
শেখ ফজলুল হক মনি ও নূরুল ইসলাম ছয় দফার নকশা ছবি দেখে প্রথমে পছন্দ করতে পারেননি। তারা চেয়েছিলেন অনেক মনুষের মুষ্টিবদ্ধ ও উত্তেজিত হাত, পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংগ্রামী ছবি, ঘৃণার ছবি ইত্যাদি। অনেক চিন্তা করে আমি যে প্রতীকী ছবি এঁকেছি- ‘৬টি আকৃতি- ৬ রঙে এবং ছয় দফা। আমাদের বাঁচার দাবি’ এই লেখার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমপজিশন বা বিন্যাসের সঙ্গে আরও কিছু নকশা। মনে মনে তাই ভীত হয়ে পড়ে ছিলাম এবং ভেবেও রেখেছি এই প্রতীকী নকশা ইত্যাদি পছন্দ না হলে নেতা শেখ মুজিব ও অন্যরা যেভাবে চাইবেন তাই করে দেব।
বঙ্গবন্ধু পাইপ টানছেন আর নিবিষ্ট মনে একটি একটি করে নকশা দেখছেন। অন্যান্য নেতার সামনে নকশাগুলো ঠেলে দিচ্ছেন আর মৃদু গম্ভীর স্বরে বলছেন- হ্যাঁ, দেখেন।
আমার বুকে তখন দপ্দপ্ আওয়াজ। ঘাবড়ে গিয়ে রীতিমতো ঘেমে উঠেছি। কী বলেন কে জানে। নকশা ও ছবি যদি পছন্দ না হয়! শেখ মনি বলে উঠলেন- মামা, হাশেম ভাই নকশাগুলোর খুব সুন্দর ও অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। হাশেম ভাই আপনি ব্যাখ্যাগুলো বলুন।
আমি আরও ঘাবড়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকালেন। তার চেহারায় মৃদু হাসি দেখে এবার খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। বুঝতে পারলাম ছবি ও নকশা দেখে সম্ভবত তিনি খুশি হয়েছেন। বললেন- বেশ তো ব্যাখ্যাগুলো কী একটু শুনি।
সাহস পেয়ে আমি প্রতিটি নকশার অর্থ ও ব্যাখ্যা ধীরে ধীরে বললাম। বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতার উদ্দেশে বললেন- আপনারা কী বলেন, মনোগ্রাম আর ডিজাইনগুলো ভালো হয়েছে কিনা বলুন।
কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে নেতা শেখ মুজিব বললেন, খুব ভালো হয়েছে।
সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নেতা আগ্রহ নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। বুঝতে পারলাম না তারা পছন্দ করেছেন কিনা? সে দিন অনেক নেতাই উপস্থিত ছিলেন। যাদের কথা মনে আছে তারা হলেন- তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ইত্তেফাক ম্যানেজার আবদুল ওয়াদুদ এবং ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাসহ আরও কিছু রাজনীতিবিদ।
বঙ্গবন্ধু বললেন, নূরুল ইসলাম এবার যত তাড়াতাড়ি পার এগুলো ছেপে বের কর।
আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে মঞ্চ থেকে ছয় দফা ঘোষণা হবে তার ব্যাক সিনে এ সিম্বলিক নকশা দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে। আর এই মনোগ্রাম ও নকশা ছয় দফার সব রকম প্রচারে ব্যবহার করতে হবে।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর নেমে গেল। সব ভয় কেটে গেল আমার। ছয়দফার লোগো, পুস্তিকা ও পোস্টারের ডিজাইন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দ হয়েছে। আমি সেদিন হালকা মেঘের সঙ্গে আকাশে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ অনুভব করলাম।
শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী ছয় দফা ঘোষণার মঞ্চ ও ৬টি আকার আকৃতি এবং ৬টি রং ও আমাদের বাঁচার দাবি এই স্লোগান সমন্বয় করে রূপ দেওয়া হলো। ‘ছয় দফা’ উপলক্ষ্যে দৈনিক ইত্তেফাক একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল এবং ইত্তেফাকের পূর্ণ পৃষ্ঠার প্রচ্ছদে ব্যবহার হলো ঘোষণা মঞ্চের শিল্পরূপ। ঢাকায় ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে বিশাল জনসভায় ছয় দফা ঘোষণা হলো ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ আরও ছয় বছর পর ১৯৭৩ সালের মে মাসে। আমার শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এক সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটি ছাপা হচ্ছে। কীভাবে ছাপা হবে- ছবি-নকশা কিছু হবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগামীকাল বেলা ১১টায় গণভবনে দেখা করতে হচ্ছে। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।
পরদিন যথারীতি শিল্পাচার্যের সঙ্গে গণভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে হাজির। সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। তিনিই সংবিধান গ্রন্থটির শিল্পমান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য শিল্পাচার্য ও বঙ্গবন্ধুর সেই সভার আয়োজন করেছিলেন। ঘরে ঢুকতেই সফেদ পাঞ্জাবি, পায়জামা ও মুজিব কোট পরিহিত শেখ মুজিব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আবেদিন ভাই, আসুন।
তারপর করমর্দনের জন্য দু’জনেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। আবেদিন স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝখানে শিল্পাচার্যকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন- আবেদিন ভাই, আপনি বসুন, আমিই ওর পরিচয় দিচ্ছি। ও আমার ছয় দফার মনোগ্রাম, নকশা ও পোস্টার করেছিল। ছয় দফা ঘোষণার জন্য যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ব্যাক সিনটা ও এত সুন্দরভাবে করেছিল আমার এখনো সব মনে আছে। ছয় রং, ছয়টি গঠন ও আকৃতি ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ছয় দফার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমি আগে ভাবতেই পারিনি আমি ভাবতে পারিনি যে, আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও বাঙালির নায্য অধিকারসহ নকশা ও ছবি দিয়ে ছয় দফার এত চমৎকার ব্যাখ্যা হয়। আবেদিন ভাই, সংবিধান গ্রন্থে ছবি আঁকার জন্য আপনি ঠিক লোককেই পছন্দ করেছেন।
আমি বিস্ময়ে অভিভূত। সেই কবে ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ ছবি ও নকশা বিষয়ে বিশ মিনিটের এক সাক্ষাৎ। আমার মতো এক সাধারণ তরুণের কথা ছয় দফার মনোগ্রাম ও পোস্টারের নকশা, তার ব্যখ্যা সবকিছু এতদিন পর তার মনে আছে।
বাংলাদেশের ‘সংবিধান গ্রন্থের’ প্রথম পৃষ্ঠার অংশবিশেষ। বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠায় চার দিকজুড়ে রয়েছে নকশা এবং ভেতরে লেখা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন এ গ্রন্থের লেখক হাশেম খান। নকশা তৈরি করেছেন জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। পুরো গ্রন্থের লিপিকার ছিলেন আব্দুর রউফ।
গত ছয় বছরে তার ওপর দিয়ে কত ঝড়, ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। উনসত্তরের আন্দোলন, আগরতলা মামলা, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস, পাকিস্তানের জেলে দুর্বিষহ জীবন, ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, দেশকে গড়ে তোলার এক দুর্জয় স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন। কিন্তু একটি অতি ক্ষুদ্র স্মৃতিও তার কাছে ম্লান নয়।
সেদিন অনেক কথাই আলোচনা হলো। তবে মূল আলোচনা ছিল সংবিধান গ্রন্থটির ছবি-নকশা ইত্যাদি সমন্বয়ে একটি সুদৃশ্য গ্রন্থ তৈরি করা। বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্যকে বললেন, আবেদিন ভাই, পাকিস্তানিরা সবই তো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সব সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। আমার কাছে জাতির অনেক চাওয়া এবং পাওয়া, আমি যে কী দিতে পারব জানি না। অনেক পরিশ্রম করে আমরা একটা সংবিধান তৈরি করেছি, আট কোটি বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে সরকারের কিছু নিয়ম, আইন ও দলিল। আমি কিছু দিবার না পারলেও আমার পরে যারা আসবে অন্তত এই সংবিধান সামনে রেখে তারা জাতিকে নিশ্চয় কিছু দিবার পারবে। আবেদিন ভাই, সংবিধানের মতো রস-কষহীন একটা বিষয় কতটুকু শৈল্পিকভাবে ও সুন্দরভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরব সেই পরামর্শ আপনি ছাড়া আর কে দেবার পারবে। আমি কাজ করবার পারি, খাটবার পারি, কিন্তু তা সুন্দরভাবে করা, কাজকে শৈল্পিক রূপ দেয়া আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। যতই আইনের কথা হোক, নিয়মের কথা হোক, রাষ্ট্র পরিচালনার আইনগুলো শৈল্পিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। এই সংবিধান গ্রন্থের রূপ কেমন হবে, ছবি, নকশা এ সবের প্রয়োজন আছে কী নেই- সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন প্রকাশনার দায়িত্বটুকু আপনার হাতে তুলে দিলাম।
শিল্পাচার্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে দেখছিলেন, তার কথা শুনলেন এবং বললেন, আপনি যা চাইছেন, তা আমরা শিল্পীরা কতখানি পারব জানি না, তবে আমরা আপনার সঙ্গে আছি। যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আপনি দেখছেন- আজন্ম এ ইচ্ছাকেই তো আমরাও লালন করে চলেছি। আজ আপনার উৎসাহ ও স্বপ্ন আমাকে এবং শিল্পী সমাজকে অনুপ্রাণিত করছে।
এরপর প্রায় চার মাসের অনলস কর্মের ফলে শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন ও আমরা পাঁচজন শিল্পীর একটি দল দিন রাত পরিশ্রম করে প্রায় চার মাসের মধ্যেই কাজটি সমাধা করেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম আলোচনার দিনই ড. কামাল হোসেন চার পাঁচটি দেশের সংবিধান গ্রন্থ নিয়ে এসেছিলেন। ভারতের সংবিধান গ্রন্থটি ছাড়া অন্যান্য দেশের সংবিধান গ্রন্থের চেহারা ছিল আটপৌরে, সুন্দর কাগজে ও টাইপে মুদ্রিত আর দশটা গাম্ভির্যপূর্ণ গ্রন্থের মতো। ভারতীয় সংবিধান গ্রন্থটি আকারে বড় এবং নকশার বিন্যাসে প্রতিটি পাতা যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল। নকশার বিন্যাস এমন করে করা হয়েছে যে, তাতে ভারতীয় ঐতিহ্যের একটা পরিচয় ফুটে উঠেছে। গ্রন্থের শিল্পকরণ ও বই নকশার দায়িত্বে ছিলেন নন্দিত শিল্পী নন্দনাল বসু। বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেন ভারতীয় সংবিধান গ্রন্থের শিল্পসজ্জা দেখেই হয়তো অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পাচার্যেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটি সুন্দর ও সুশোভন করে প্রকাশ করার দায়িত্ব দিলেন।
শিল্পাচার্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে আমি অনেক কিছু চিন্তা করে চার পাঁচ দিনের মধ্যেই একটা যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে গ্রন্থের শিল্পকরণের খসড়া তৈরি করে ফেললাম। যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়েছিলাম, তা হলো- যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সদ্য স্বাধীন দেশে মুদ্রণশিল্পের অনেক দক্ষ শ্রমিকের অভাব। প্রেসের মেশিন চালক ও অন্যান্য বিশেষ কাজে অভিজ্ঞ মানুষ বেশিরভাগই শতকরা ৭০ জনই ছিলেন অবাঙালি, উর্দুভাষী। স্বাধীনতার পর এরা ভারতের বিহারে এবং পাকিস্তানে চলে যায়। এমতাবস্থায় যে ক’টি উন্নয়তমানের প্রেস ছিল সেগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়ে। মোটামুটি সবদিকে উপযুক্ত প্রেস পাওয়া গেলো ‘পদ্মা প্রেস। চার রঙের বা দু’রঙের প্রেস তখন ঢাকায় ছিল না। এক রঙের অফসেট মেশিনে চারবার বা পাঁচবার ছাপার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। যে কাগজে ছাপার সিদ্ধান্ত হলো তা অ্যাসিড ফ্রি হতে হবে এবং পার্চমেন্ট কাগজই উপযুক্ত বিবেচনায় তা ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে নিয়ে আসতে হবে।
‘সংবিধান’ গ্রন্থের শিল্পরূপ কী হবে, কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত- এসব বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে দ্রুত সিদ্ধান্তে এলাম। যদিও ভয় ছিল- শিল্পচার্য স্যার পছন্দ করবেন তো? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শিল্পীদের ওপর নির্ভর করেছেন বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান দিতে পারছেন- সে গ্রন্থটি শিল্পের সুষমায় মণ্ডিত করে দেশের মানুষের হাতে দিতে চান। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনও তাকে কথা দিয়েছেন সাধ্যমত চেষ্টা করার।
সংবিধান গ্রন্থের আকার, আকৃতি, বই-নকশার কয়েকটি নমুনা ইত্যাদি নিয়ে স্যারের বাড়িতে হাজির হলাম। পুরো পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে শিল্পাচার্যকে পেশ করলাম। বই নকশাও সংবিধানের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি অধ্যায় কীভাবে রং ও নকশায় আকর্ষণীয় করে তুলব তার কয়েকটি খসড়া পৃষ্ঠা স্যারের সামনে তুলে ধরলাম। শিল্পাচার্য মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। নিবিষ্ট চিত্তে রং নকশায় সজ্জিত খসড়া পৃষ্ঠাগুলো দেখলেন। দুরুদুরু বক্ষে আমি অপেক্ষা করছি- স্যার পছন্দ করবেন তো!
কিছুক্ষণ পর স্যার আমার দিকে তাকালেন। কিছুই বললেন না। আবারও খসড়া নকশার পৃষ্ঠাগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বললেন ষড়ঋতুর রঙের বিন্যাস ও আমাদের লোকশিল্পের নক্শা- বিষয়গুলো ভালো, কিন্তু ছাপাতে গিয়ে ঠিকমতো রংগুলো আনা যাবে তো?
দিন রাত প্রেসের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস সব সময় ছাপাটা তদারকি করলে অন্তত নব্বই ভাগ সম্ভব।
: তোমার পরিকল্পনা, লে আউট সবই যথাযথ- এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে! তবে নকশা ও আরও কিছু বিষয় আছে। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সেগুলো যোগ করে এবং আরও একটু পরিপাটি করে প্রস্তুত থাক। আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবিধান মুদ্রণ, ডিজাইন ও পুরো পরিকল্পনা নিয়ে ৩-৪ দিনের মধ্যেই যাব।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের সামনে সংবিধানের প্রকাশনা, বই-নকশার মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের পুরোপুরি পরিকল্পনা-নকশা ও আনুসঙ্গিক বিষয়গুলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তুলে ধরেছেন। প্রাথমিক ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তিনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন- সবকিছু একে একে যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। সেদিন সংবিধান রচনার উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন তো ছিলেনই। অন্য সবার কথা আজ এতদিন পর মনে করতে না পারলেও দু’জনের কথা মনে আছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও তৎকালীন সংসদ সদস্য মোহাইমিয়েন সাহেব। মোহাইমিয়েন সাহেব পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেসের মালিক তিনি যথাযথ সুন্দর মুদ্রণে একজন বিশেষজ্ঞ।
সংবিধানের শিল্পরূপের পরিকল্পনা, মুদ্রণ, নকশা এবং খসড়া পৃষ্ঠা (নমুনা হিসেবে) বঙ্গবন্ধুসহ সবারই মনঃপূত হয়েছে এবং ভালোও লেগেছে। কিন্তু মুশকিলের মুখোমুখি হলাম মুদ্রণ বিষয়ে। ‘পদ্মা’ প্রেস উপযুক্ত হলেও তারা এমন সব শর্ত জুড়ে দিল, যা আমার ভালো লাগেনি। তবুও আমি বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য সবার কাছে উত্থাপন করতেই তারাও বিস্মিত।
বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, অসম্ভব কোনো শর্তসাপেক্ষে আমরা ওদেরকে দিয়ে কাজ করাব না। আরও প্রেস খোঁজা হোক।
মোহাইমিয়েন সাহেব পরামর্শ দিলেন ইস্টার্ন রিগেল প্রেস ও কো-অপারেটিভ প্রেসে ভালো মেশিন আছে ওদের মুদ্রণ উন্নতমানের।
এবার আমি একটা ঝুঁকি নিয়ে বুকে সাহস সঞ্চার করে জানালাম প্রাইভেট প্রেসগুলোতে দক্ষ মেশিন চালক ও কারিগরের অনেক অভাব। আমি সরকারি প্রেসে গিয়ে দেখেছি যেটি এখন বিজি প্রেস, সেখানকার ডেপুটি সুপার জনাব সিদ্দিকুর রহমানকে সংবিধানের লেআউট দেখিয়েছি। ভারতের সংবিধান গ্রন্থটি দেখিয়ে জানতে চেয়েছি এ রকম মানে ছাপা সম্ভব কিনা। তিনি জানালেন বিজি প্রেসে পুরনো হলেও কিছু ভালো মেশিন আছে। মেশিনম্যান ও দক্ষ কারিগরও আছে। তবে এ ধরনের রঙিন ও মানসম্পন্ন ছাপার কাজ সরকারিভাবে হয় না বলে অনেকেই জানে না। আমরা সরকারের দলিলপত্র, ফরম, গ্যাজেট ইত্যাদি সাদা কালো ছাপাতেই ব্যস্ত। এরপর সিদ্দিকুর রহমান সহেব বিজি প্রেসের কারিগরদের মতামত চাইলেন। তারাও ভারতীয় সংবিধান গ্রন্থ দেখে বললেন, ‘এই কাগজ এনে দিলে বিজি প্রেসে যা ব্যবস্থা আছে এর থেকেও পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ আমরা করে দিতে পারব।’
প্রেস কর্মচরীরা খুবই উৎসাহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে জানালেন, বঙ্গবন্ধু যেভাবে বলবেন- যেভাবে চাইবেন আমরা কাজ করে দেব।
আমি সেই সভায় আরও জানালাম, সিদ্দিকুর রহমান সাহেব একজন মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ। তিনি ইংল্যান্ডের শ্লেট স্কুল অব আর্টসের মুদ্রণশিল্পের উৎকর্ষতা বিষয়ে একটি ডিপ্লোমা কোর্স করে এসেছেন। তার সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেল তিনি আস্থাশীল সংবিধান গ্রন্থটি যথাযথ মানে ছাপাতে সক্ষম।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, সংবিধান গ্রন্থটি বিজি প্রেসেই ছাপা হবে। জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে আমরা শিল্পীরাও দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম!
সংবিধান গ্রন্থের অন্যান্য শিল্পী যারা নকশাগুলো করেছেন তারা হলেন- জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভী ও ক্যালিগ্রাফির জন্য আবদুর রউফ।
সংবিধান গ্রন্থটি যেটি বাংলাভাষায়, সেটিতে মুদ্রণ যন্ত্রের টাইপ ব্যবহার না করে প্রতিটি পৃষ্ঠা হাতে লেখা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা হাতের লেখা ব্যবহার করে পুরো গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষার গ্রন্থটিতে টাইপ ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন একটি মূল্যবান দলিল-গ্রন্থ ইচ্ছা করলে দেশের বাইরে যে কোনো উন্নত দেশ থেকে সুন্দর পরিপাটি মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা যেত। অনেকেই সেই পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি একটি বিষয়ে খুবই সচেতন ও সচেষ্ট ছিলাম যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষরাই নিজেদের কাজগুলো করবে। আমাদের যা সম্পদ আছে, যে প্রযুক্তি আছে, যে কর্মী আছে, শিল্পী আছে তা দিয়েই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। যে নিষ্ঠা ও চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি- দেশ গড়ার কাজেও মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে কাজে লাগাতে হবে। নিতান্তই প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই সংবিধান গ্রন্থের জন্য শুধু কিছু উন্নতমানের কাগজ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সরকারি মুদ্রণালয়ের অতি পুরনো একটি মুদ্রণ যন্ত্রকে সামান্য মেরামত করে গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি উন্নতমানের মুদ্রণালয় থাকা সত্ত্বেও একটি আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে ও সরকারি মুদ্রণালয় এবং সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব বোধকে সচেতন করার প্রয়োজনে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।
সরকারি মুদ্রণালয়ের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা সবাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি সমাধা করেছিলেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করায় সরকারের প্রতি তাদের সন্তোষ প্রকাশ পায়। সংবিধান গ্রন্থটির মুদ্রণ শেষ হলে সরকারি মুদ্রণালয়ে এক সমাবেশে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা তাদের প্রতি সরকারের আস্থা ও দায়িত্ব অর্পণের কারণে বঙ্গবন্ধু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে তাদের আনন্দ, কতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সোনার বাংলা গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর হাতকে বলিষ্ঠ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ইচ্ছাকেও প্রকাশ করেন।
শিল্পাচার্য ও ড. কামাল হোসেন শিল্পকর্মে শোভিত ও পরিপাটিভাবে মুদ্রিত সংবিধান গ্রন্থটি নিয়ে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে আমরা পাঁচজন শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু একটি একটি পাতা তুলে সংবিধানের পৃষ্ঠাগুলো অবাক হয়ে দেখছেন। কিছুক্ষণ দেখার পর মুগ্ধ ও অভিভূত দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকালেন। বললেন- আবেদিন ভাই, এত সুন্দর কী করে করলেন! আমি যে ভাবতেই পারছি না! কিছুই তো ছিল না, ভাঙা প্রেস, ভালো কালি নেই- তারপরও আপনি কি অসাধ্য সাধন করলেন। আপনারা শিল্পীরা কত সুন্দর ও পরিপাটি করে বাংলার মানুষের জন্য সংবিধান গ্রন্থ তৈরি করলেন। কিন্তু আমি কী করি? আমি কি পারব আমার বাংলাকে এত সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে? এই যেমন আপনারা পারলেন এই সংবিধান!
: বঙ্গবন্ধু এ কাজটা তো আপনিই করলেন। আপনার পরিকল্পনা ও চিন্তাকে আমরা একটা রূপ দিলাম। আমরা আপনার হাতিয়ার, আপনার কর্মী। বাংলার মানুষের দেশ গড়ার সংবিধান শৈল্পিক রূপ লাভ করুক, সুন্দর একটি চেহারা পারু আপনার স্বপ্ন ও অভিলাসকেই আমরা শিল্পীরা রূপ দিয়েছি। আমাদের শিল্পীদের মতো বাংলার লাখো কোটি মানুষ ও কর্মী আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। যাকে যে কাজে প্রয়োজন আপনি আহ্বান জানালেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনার আহ্বানেই ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাক সেনাদের মতো অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যা বাংলার মানুষের ছিল না, তবুও তারা যুদ্ধ করেছে। ত্রিশ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছে। তেইশ বছর সংগ্রাম ও নয় মাস যুদ্ধ করে বলিষ্ঠ ও দক্ষ পাক বাহিনীকে হটিয়ে নিজের দেশকে মুক্ত করেছে। আজ আপনার স্বপ্ন এই বিধ্বস্ত বাংলাকে সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলবেন। বাংলার মানুষ আপনার হাত শক্তিশালী করার জন্য তৈরি।
বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন সংবিধান গ্রন্থটি। তারপর বললেন, আবেদিন ভাই, আপনি তো আমার কাজটা করে দিলেন। এখন আমি আপনাদের জন্যে কী করতে পারি বলুন।
: আমি এবার একটা কাজে হাত দিতে চাই। আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন। শিল্পাচার্য বঙ্গবন্ধুকে বলতে লাগলেন, ঢাকার পাশে যে ঐতিহাসিক শহর সোনারগাঁ, সেই সোনারগাঁকে আমি নতুন রূপে গড়ে তুলতে চাই। এ অঞ্চলেই তৈরি হতো সারা বিশ্বে খ্যাত শিল্পকর্ম ‘মসলিন’ যা আজ হারিয়ে গেছে। এমনিভাবে বাংলার অনেক ঐতিহ্য ও লোকশিল্প আজ লুপ্তপ্রায় এবং যে ক’টি বেঁচে আছে তা কোনো কদর পাচ্ছে না। বাংলার লোক-ঐতিহ্য ও শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং পুনর্জীবিত করার জন্য এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সোনারগাঁয়ে একটি লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের লোকশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের শিল্পকর্মে উৎসাহ প্রদান ও উজ্জীবিত করার প্রয়াসে আমি একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছি। আর তা বাস্তবায়নে আপনার সাহায্য ও উৎসাহ প্রয়োজন। সোনারগাঁকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে আপনার সোনার বাংলা গড়ার কাজ অনেকখানি এগোবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বঙ্গবন্ধু একটু অবাক হয়ে শিল্পচার্যের দিকে তাকালেন। একটু সময় নিলেন। সংবিধানের পাতা ওল্টাতে, ওল্টাতে আনন্দ ও বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন- আবেদিন ভাই, আপনি আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী এখনই কাজে নেমে যান। আমি এবং বাংলাদেশ সরকার আপনাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। শুধু আমার ছোট একটা অনুরোধ, সোনারগাঁয়ে মাঝে মাঝে আমি আপনার কাছে গিয়ে থাকব। আমার জন্য আপনার পাশে একটু জায়গা রাখবেন। সুন্দর কিছু সৃষ্টি করার শক্তি ও প্রেরণা আপনার কাছ থেকে যাতে পেতে পারি ও শিখতে পারি সে ব্যবস্থা আমাকে করে দেবেন।
সংবিধান এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন- দুটি মানুষের কথোপকথনে সেদিন আমি বিমোহিত। মহামানব দেখতে কেমন হয় এমন কোনো ধারণা আমার নেই। কিন্তু সেদিন এ দু’জনকে আমার মনে হয়েছে দুই মহামানবের সম্মুখে আমরা। বিশাল বক্ষ দু’জনের। যে বক্ষ ধারণ করে আছে বাংলার আপামর মানুষকে। সোনারগাঁ ও সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন, দু’জনের মধ্যেই এক অদ্ভুত মিল। এ দুই মহামানব হারিয়েও গেছেন আমাদের মাঝ থেকে প্রায় একইভাবে। দু’জনকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেছে মহাকাল। শিল্পাচার্যকে অকস্মাৎ ছিনিয়ে নিয়েছে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আর বঙ্গবন্ধুকেও অকস্মাৎ হত্যা করল কিছু দুর্বৃত্ত ও দুর্জন যারা বাঙলার ও বাঙালি জাতির চিরশত্রু।
লেখক : চিত্রশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক
