সুবর্ণবন্দরের খোঁজে
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পায়ে ধুলো লাগা বাঁচায় জুতা, আর গায়ে ময়লা যাতে না লাগে তা রক্ষা করে পোশাক। কিন্তু বনের ময়লার জন্য তো কেউ এগিয়ে আসে না। এ ময়লা বনে যেমন পড়ে- তেমনি বনকেই মুছে ফেলতে হয়। যে পারে সে ময়লা সাফ করতে সে-ই তো অরণ্য। তার জন্মই তো সার্থক অরণ্যজন্ম। পড়শি ফোড়ন কাটে, ধূলিসম পত্রালি নিচে পড়ে, ভিন্ন পাড়া গলা উঁচিয়ে কেচ্ছা-কাহিনি ছড়ায়। হেলাফেলা গা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়- কিন্তু পরদেশি যদি নাক-মাথা দোলায় তখন তো তা সামাল দেওয়ার জন্য নিজের মাথাকেও ওপরে তোলার প্রয়োজন পড়ে। এ মন ও মাথা নিয়ে, এ হৃদয় ও বুদ্ধি নিয়ে চলাচলের অংশে চাই জুতসই একটি মাধ্যম- বিস্তার মাধ্যম।
কথার পিঠে কথা তাই- মানুষের জন্য হৃদয়কে পঞ্চভূতে মিশিয়ে এবং মস্তিষ্ককে সৃষ্টিদর্শনে লগ্ন করে দাঁড়াতে হবে। মেরুদণ্ডী প্রাণীর সব গুণ ধারণপূর্বক জানান দিতে হবে বিশ্বকে- আমরা এসেছি। নিজের ভাষা বাংলা-ই এ আগমনের একমাত্র প্রতীক! তাই বাংলা নিয়েই আমরা দখল নিতে চাই সারা বিশ্বের। আমাদের কর্মীদল মজবুত, আমাদের মেধাবাহিনী অটুট এবং আমাদের মেধা-সমবায় অভিযানের জন্য প্রস্তুত।
এখন এ অভিযাত্রার স্থানচিত্র এবং বিজয়সীমা নির্ধারণের জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। পৃথিবীর মানচিত্রে বিজয়বিন্দু বসিয়ে এগুলো দরজার ওপাশেই তো আপনচিত্র। এরপর পশ্চিমের ডাক। স্থলপথে যেতে সময় লাগবে, জলপথ এখন প্রায় অচল, বাকি রইল উড়াল যাত্রা। নামা যাক ইউরোপে, আশপাশে অনেক ঝালঝোলের গল্প। অনেক ছুরি-কাঁচির সঙ্গে পাঁচ-আঙুল পাল্লা দিচ্ছে দীর্ঘদিন। অতএব, অগ্রবর্তী বাহিনীর সমর্থনে বিজয় সম্ভব হতে দিনক্ষণ বেশি ব্যয় হবে না। এবার মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পতাকা পোঁতার পালা। ঢোলশহরত করে শুরুর সময় নির্ধারিত হলে মনে হয় না সমাগম হতে বেশি সময় লাগবে। ওখানে দাঁড়িয়েই স্থানীয় চিত্রটি নজর করার পাশাপাশি এশিয়ার পূর্বাঞ্চলটির কথা ভাবা যাবে।
আসুন লুই পা, আসুন আলাওল, আসুন মাইকেল, আসুন রবীন্দ্রনাথ, আসুন বঙ্গবন্ধু- আসুন বৈশাখ, আসুন ডাল-ভাত- আসুন একুশে, আসুন মুক্তিযুদ্ধ- পায়ের ধুলো, গায়ের ময়লা ঝেড়ে হৃদয়ে হৃদয় রাখি। বিশ্বময় গড়ে তুলি বাংলা ভাষার অমিয় সংস্কৃতি।
১
কখন যে কোন বিষয় মোচড় দেবে বোঝা দায়। ঘর থেকে বেরোবার মুখেই বিপত্তি মাথা ধরে টান দিল। ঢাকা থেকে দোহা হয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস যাত্রা। আমন্ত্রণটি কবিতা উৎসবের, আর যাত্রাপথের বিমান মাশুলও পরিশোধিত হয়েছে উৎসব কর্তাদের মাধ্যমে। তবে বিপত্তি কোথায়? বিপত্তি, যে মাধ্যমে মাশুল পরিশোধিত হয়েছে তার নিশ্চিতকরণ নিয়ে! বিমানবন্দরে নানা টানাপোড়েন উতরিয়ে- বুঝিবা একটা ঝুঁকি ঝুলিয়ে রেখেই যাত্রা শুরু করা গেল। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের আমেজটুকু রাত তিনটায় চোখে-মুখে ঝাপটা দিয়ে যায়। ছ’ঘণ্টার যাত্রা দোহা এসে দু’ঘণ্টার বিরতির পর আবার শুরু করল টানা ষোলো ঘণ্টার ওপারে লস অ্যাঞ্জেলেসের জন্য।
ভারি চকচকে অপরাহ্নে ঢুকে গেলাম নগরীর অভ্যন্তরে। চারদিকে মাথা তোলা পাহাড়ের পেটের মধ্যে বসতি। ঘন সবুজের অপরূপ সমারোহে চিনিয়ে দিল বৈচিত্র্যের আন্তরিক মাত্রা। তাপমাত্রা সতেরো-আঠারোর বেশি নয়, মৃদু হাওয়ায় বসন্তের পুলক। যার সঙ্গে প্রথম আহ্বান মূকাভিনয় পর্বটি মনে করিয়ে দিল- সে তো একদিন বাংলাদেশেই ছিল। যশোরের ধুলো-জল ছেঁকে-ছেনে ঢাকা এসে ছড়িয়েছিল প্রতিভার দ্যুতি। অভিনয়ে পটু, তা-ও আবার বাকবিহীন- সবই তো ছিল তার ঝুলিতে। তারপরও অন্য এক আকর্ষণ, ভিন্ন এক প্রণয় তাকে দেশ থেকে বৈদেশে নিয়ে এসেছে! তা-ও বুঝি তিন যুগ আগেকার অমোঘ আখ্যান। ও, কাজী মশহুরুল হুদা- হাতে গহনা বাজিয়ে, আঙুলের অলঙ্কার ঘুরিয়ে- আজ এই বেলা আমাকে ভাত ও সরপুঁটি মাছের ঝোলে নামিয়ে দিল। ‘স্বদেশ’-এর ভাণ্ডারে করলা ভাজি থেকে বেগুন-মানকচু, মুগডাল কিছুই বাদ নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের এই ‘লিটল বাংলাদেশ’ যেন বৈশাখের বৈভব নিয়ে এলো, দিল বাংলার পূর্ণতা।
আমার আমিতে খুঁজি সুবর্ণবন্দর!
২
‘হলিউড’ শব্দটির সঙ্গে ঝমঝম করে ওঠে পরিপার্শ্ব এবং দৃশ্যপটে আলোর ঝলকানি নেড়ে দেয় লৌকিক ও অলৌকিক চালচিত্র।
বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার অংশটুকু মিলিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে সকাল-দুপুর কাটল ‘গ্রিফিথ অবজারভেটরি টাওয়ার’ আর ‘বেভারলি হিলসে’। উপত্যকার শোভার সঙ্গে দর্শনার্থীর ঢল মিলেমিশে তৈরি করেছে বিচিত্র এক অবকাশ-প্রণালী। ছবি তোলা থেকে স্যুভেনির ক্রয়- এক পর্যায়ে ভেতর মহলে আপন অবস্থানটির জানান দিয়ে যায়।
‘উত্তর আমেরিকা কবিতা সম্মেলন ২০১৯’-এর আয়োজনকে সম্মুখে রেখে নানান কর্মকাণ্ডের ফাঁকে সন্ধ্যায় ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার ভেতর দিয়ে দিন ফুরালো। তবে একথাও ঠিক, দিনের সঙ্গে কে কবে পাল্লা দিতে পেরেছে? এই যে এখন সূর্যের উল্টোদিকে পৃথিবীর এ অঞ্চল তার হাসি-তামাশায় উনিশে এপ্রিল শেষ করল- তার ভঙ্গি কতটুকু পাবে গোলকের ওপারের মানুষ?
[লাল একটি পিঁপড়ে পৃথিবী
মিথ্যের মধ্যে পড়ে আছে!]
৩
বেশ ঠান্ডা বাতাস, তাপমাত্রা পনেরো ছুঁইছুঁই। সকালে বেরোবার মুখে দূরের পামসারি ক্যামেরা টেনে নিল। যেন প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলের পাকাপোক্ত একটি ব্যবস্থার মধ্যে একমাথা চুল নিয়ে তারা পাহারা দিচ্ছে জনবসতি। পথে পড়ল ‘ইউনিভার্সাল স্টুডিও’। ভেতরে ঢোকার মুখেই ঝাপটা দেওয়া মিশ্র ঘ্রাণ ঠেলে দিল নানান বর্ণে, ভিন্ন-ভিন্ন প্রাঙ্গণে। শিশু-তরুণ-বয়সি মিলে যে সাদা-কালোর তৈলচিত্র তা যেন কেবল আনন্দের, তা যেন কেবল শনিবারের ছুটি উপভোগের।
হু-হু করে বেলা নেমে যায়। সন্ধ্যায় কবিতার আয়োজন। প্রবাসে বাংলা কবিতার তল ঠাহর করা বড় কঠিন! অর্থ-বাণিজ্য-সচ্ছলতার এত দেমাগের মধ্যে লাজুক কবিতার ঠাঁই পাওয়া ভার। হ্যাঁ, এসব আয়োজনের শেষ দৃশ্যে সংগীত এবং নৈশভোজের পর্ব বড় মনোহর।
‘একটি দিনের জন্য রাত ফর্সা হলে
একটি রাতের লোভে লুট হয় জীবনের ছুটি’
৪
ফুরিয়ে আসে সময়। বাঁধাধরা ভ্রমণের শেষ দিন চোখ জুড়িয়ে দেয় সাগরের প্রসন্নতা। বালি ও ফেনার কোলাহলে এক জলরেখা যেন ডাক দিয়ে বলে :
‘তুমি ইংরেজি লেখা নিয়ে
বাংলায় কি আমার সঙ্গে খেলবে’
লেখক : কবি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক
