স্বপ্নের পদ্মা সেতু-শেখ হাসিনার অনন্য অর্জন
এ কে এম শহীদুল হক
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পদ্মা সেতু আজ আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবতা। স্বপ্নের বাস্তবায়ন। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা। তিনি পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ায় সেই সেতু তিনি দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে জনগণের রায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে যমুনার ওপর নির্মাণাধীন সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সেতু উদ্বোধন করেন। নিজ কন্যার হাতেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একুশটি জেলার জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দাবি ছিল পদ্মা সেতুর। বঙ্গবন্ধুরকন্যা শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর মতো একজন ভিশনারি লিডার। তিনি পদ্মা নদীর ওপর সেতুর শুধু স্বপ্নই দেখেননি তার বাস্তব দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি পদ্মা সেতুর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেন। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা সেতুর সম্ভাব্যতা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি করান। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুর নির্মাণের বাস্তব ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে। তবে তা নিজস্ব অর্থায়নেই। অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে Pre-qualification টেন্ডার আহ্বান করে। পরিকল্পনা ছিল ২০১১ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু হবে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর কাজ হাতে নিয়েছিল। ২০০৭ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় সেতুর নকশা তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অনুমোদিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেনি।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয় লাভ করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইস্তেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। সরকার গঠন করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেন। তিনি ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযোজনের জন্য নির্দেশনা দেন। তার নির্দেশ মতো সেতুর ডিজাইন বা নকশা পরিবর্তন করা হয়। ওপরে মোটরযান সড়ক এবং নিচে রেলপথ অর্থাৎ দোতলা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ওপরে চারলেনের মোটরযান সড়ক এবং নিচে একলেনের রেলপথের ব্যবস্থা রেখে নকশা তৈরি হয়। আমাদের মনে আছে শেখ হাসিনার ইচ্ছায়ই বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ সংযোজিত হয়েছিল। এবার তিনি যমুনা সেতুর ওপর পৃথকভাবে রেলপথ নির্মাণ কাজের শুভ সূচনাও করেছেন। দেশের উন্নয়ন, কল্যাণ ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে শেখ হাসিনা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। নিজ মেধা, বিচক্ষণতা ও পরিকল্পনায় সব অভিলাষ একটির পর একটি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের শিখরে।
সেতুর নকশা পরিবর্তন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও সময় ক্ষেপণের জন্য নির্মাণ ব্যয়ের প্রাক্কলনও বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এ ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে মূল সেতু, নদীশাসন, জমি অধিগ্রহণ, দুই পারে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, পুনর্বাসন, কর্মীদের বেতন সব মিলিয়ে তৃতীয়বারের মতো পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পে ৪০০০ কর্মী কাজ করছে। ২০০৭ সালে মার্কিন ডলার ও টাকার বিনিময় হার ছিল ৬৮.৬৫ টাকা। অর্থাৎ এক মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৬৮.৬৫ টাকা। ২০১৮ সালে এ হার হয় ৮৪.৮০ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রকল্প ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। কাজেই ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে এ কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত না করাই শ্রেয়। প্রয়োজনেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাই বাস্তবতা।
৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮.২ মিটার প্রস্থের পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশ তথা পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সবচেয়ে বৃহৎ সেতু। সেতুটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং শরীয়তপুরের জাজিরাকে সংযুক্ত করেছে। পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ৬০ ফুট। মোট পিলার ৪২টি। কংক্রিট ও স্টিল সামগ্রী দিয়ে সেতু নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি পিলারের জন্য পাইলিং ৬টি। পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৬৪টি। পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ফুট। এসব তথ্য নির্মাণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গই জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করেছে। তারপরও কুচক্রি মহল সেতু সম্বন্ধে নানা রকম অপপ্রচার চালিয়েছে। দেশের ভালো কিছু তাদের ভালো লাগে না।
পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও আরও আছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা। সেতুর জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে পদ্মার দুই পারের জমির মালিক ও জনগণের অবদান অপরিসীম। সবাই সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করেছে। সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চুক্তি সই হয়। ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ হলো কানাডার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এসএনসি লেভালিন (SNC Lavalin) কাজ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রী, সেতু সচিব, সেতু প্রকল্পের পিডি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। তারা জোর দাবি করে তাদের কাছে দুর্নীতির যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে।
বিশ্বব্যাংক তাদের ভাষায় কথিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে। তারা মন্ত্রী, সচিব, পিডি ও অন্যদের সেতুর কাজ থেকে অব্যাহতিও চান। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠান সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা সরেজমিনে দেখার জন্য। তারা দুদকের সঙ্গে সভা করেন। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর আর্জেন্টিনার আইনজীবী লুইস গেব্রিয়েল মরেনো ওকামপোকে বাংলাদেশে পাঠায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা দেখার জন্য। এভাবে বিশ্বব্যাংক অনৈতিক কাজ ও বাড়াবাড়ি করেই যাচ্ছিল। শেখ হাসিনার সরকার অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত চাপ, মিডিয়ার প্রপাগান্ডা এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের কিছু লোকের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং কোনো কোনো গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তাদের কথায় এমন আবহ তৈরি করা হয়েছিল যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সত্যি সত্যি দুর্নীতি হয়েছে। জনমতও দুর্নীতির পক্ষে সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে মনে হবে সরকার দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে চাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল যদিও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেনকে ইস্তফা দিতে বললে তিনি ইস্তফা দেন। সচিব মোশারফ হোসেন ভুঁইয়াকে বদলি করা হয়। প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান টিম গঠন করে। পরে সাতজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়। সেই মামলায় সচিব মোশারফ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেল খাটেন।
বাংলাদেশ সরকার এত সব ব্যবস্থা নিলেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। তারা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ঋণচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে জাইকা, এডিবি ও আইডিবি ঋণচুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংক ঝঘঈ খঅঠঅখওঘ কে ১০ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাজে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কানাডার একটি আদালত SNC LAVALIN এর দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। পরে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ আদালত অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে মামলা খারিজ করে দেয় এবং অভিযুক্তরা খালাস পায়। বাংলাদেশের দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আদালত আসামিদের খালাস দেন। বিশ্বব্যাংক তদন্ত করেও দুর্নীতির পক্ষে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পায়নি। কানাডার আদালতে এবং বাংলাদেশের দুদকের তদন্ত দলের কাছে বিশ্বব্যাংক কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। অথচ তারা বলেছিল তাদের কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে। তবে তা নিজস্ব অর্থায়নেই। অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে Pre- qualification টেন্ডার আহ্বান করে। পরিকল্পনা ছিল ২০১১ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু হবে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
চায়না BOT (Build own transfer) ভিত্তিতে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সেদিকে যায়নি। আন্তর্জাতিক টেন্ডারে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড কাজ পায়। ১৭ জুন ২০১৪ তারিখে সেতু কর্তৃপক্ষ চায়না ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানিকে সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদার হিসাবে নির্বাচন করে। তারা ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টম্বর। সর্বশেষ স্প্যান অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। সার্বিক কাজ সমাপ্ত করে জুন ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দিতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। তখন নির্মাণ ব্যয়ের প্রাক্কলন ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। ওই টাকা কীভাবে আসবে তার রুপরেখাও তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। তিনি বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার ঋণচুক্তি বাতিলের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেই এবং আমরা তা সুদে আসলে ফেরত দিই। আমরা তাদের কাছে ভিক্ষা চাই না। বাংলাদেশ যাতে দরিদ্র থাকে সে লক্ষ্যে তারা নানা রকম পরামর্শ দেয়। কৃষিতে ভর্তুকি দিতে নিষেধ করে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে নিষেধ করে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করলে দেশ কখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মিত হবে। তার সেই ঘোষণা আজ বাস্তব। পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। পদ্মার দুপাড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এখন শুধু আনুষঙ্গিক কাজ। সে কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বিশ্বব্যাংক এ অভিযোগ এনেছিল রাজনীতির কারণে। বিশ্বব্যাংক শুধু অর্থনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে না। এটার অন্যতম এজেন্ডা রাজনৈতিক। বিশ্বব্যাংক সর্বদা পুঁজিবাদী দেশের মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে। ঋণগ্রহীতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করলেই বিশ্বব্যাংক সে দেশকে ঋণ দেয়।
ওইদিন সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ চুক্তি স্থগিত করার পেছনে ড. ইউনূসকে দোষারোপ করেছিলেন। নিশ্চয়ই তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য আছে। সরকারবিরোধী দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকারকে বহির্বিশ্বে বিতর্কিত ও অপ্রিয় করার জন্য আমেরিকা ও ব্রিটেনে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা কিছু কিছু সিনেটরের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অমূলক নয়। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরাই বিদেশিদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার পাঁয়তারা করতে থাকে। এতে যে দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয় তা তারা ভাবে না। তারা যে কোনো ধরনেরই হোক ক্ষমতায় আসতে চায়। এ দেরকে কি আমরা দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলব?
ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতু নির্মাণ বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সেতু সম্বন্ধে নানা রকম মিথ্যা, ভিত্তিহীন তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। পদ্ম সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে এ গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেককে ছেলে ধরার অভিযোগ দিয়ে আহত নিহত করা হয়েছে। ঢাকার বাড্ডায় তাসলিমা স্কুল থেকে মেয়েকে আনার জন্য গেলে তাকে ছেলে ধরার অভিযোগ দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের মানবতা বলতে কিছু নেই।
২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু করতে পারবে না। জোড়াতালি দিয়ে যে সেতু তৈরি করবে তা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না। ঝুঁকিপূর্ণ হবে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বললে তার সম্বন্ধে সচেতন মহলের কী ধারণা হয়? বেগম খালেদা জিয়ার সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিএনপির অন্য নেতারাও পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কতিপয় সুশীল সমাজের ব্যক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরাও পিছিয়ে ছিল না। তারাও নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। ২০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যান (৪১নং স্প্যান) বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মার দুই তীর সংযুক্ত হলে ওই সব ব্যক্তির সব মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়। বাস্তব।
ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপাকে ফেলতে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনে সরকারের জনপ্রিয়তা কমানোই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। বাস্তবে তার উল্টোই হয়েছে। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ঋণচুক্তি বাতিল বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদই হয়েছে। বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো একটি বৃহৎ বহুমুখী সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত করতে সক্ষম হয়েছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ অহংকার নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে। আমাদের প্রকৌশলীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেতু তৈরিতে টেকনোলজিক্যাল দক্ষতা তারা অর্জন করছেন। নির্মাণ উপকরণ থাকলে আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা এ ধরনের সেতু নিজেরাই তৈরি করতে পারবে। বাইরের পরামর্শক লাগবে না। আমাদের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বেড়ে গিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু ঘোষণা দেওয়ার পর অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ১৯ জুলাই ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা সেতু : জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির সুযোগ’ শিরোনামে এক সেমিনারের আয়োজন করেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে তিনি অর্থের বিভিন্ন উৎসের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন সরকার চার বছরে ১৪টি উৎস থেকে ৮৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারে। তা দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যায়।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৯৭২-৭৩ সালের অর্থনীতি নয়। দেশের অর্থনীতি এখন অনেক উঁচু মাত্রায় উঠেছে। আসলেও তা সঠিক। বাংলাদেশের প্রথম বাজেট (১৯৭২-৭৩) ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকায়। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। দেখা যায় আমাদের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির সব সূচক ঊর্ধ্বগামী। জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম খারাপ অবস্থায় পড়েনি। এ সবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার ক্যারিশমায়, তার জাদুকরি বিচক্ষণতায়।
বিশ্বব্যাংক সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহস সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেনি। শেখ হাসিনা কারও কাছে মাথা নত করার ব্যক্তি নয়। তার ধমনীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত প্রবাহিত। বিশ্বব্যাংক বুঝতে ভুল করেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। তার কন্যা সেই কথা প্রমাণ করেছেন।
পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু যোগাযোগ নেটওয়ার্ক-এ বিপ্লব ঘটাবে না। এ সেতু সতেরো কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একুশটি জেলার মানুষ অল্প সময় ব্যয় করে সহজে রাজধানী শহর ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে পারবে। তাদের সময় বাঁচবে, কষ্টের লাঘব হবে, জীবন সহজ হবে। শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার লোকজন ইচ্ছা করলে প্রতিদিন ঢাকায় এসে অফিস বা অন্য কাজ করে বাড়িতে ফিরতে পারবে।
ঢাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ না থাকায় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শরীয়তপুর লোকজন ঢাকায় আসতে অনেক কষ্ট করতে হতো। দুঘণ্টা হেঁটে সুরেশ্বরের ওয়াপদা ঘাটে এসে লঞ্চ ধরতে হতো। একতলা ছোট লঞ্চ। সেই লঞ্চেই পদ্মা পাড়ি দিতে হতো। পদ্মার প্রচণ্ড ঢেউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা আসতে হতো। সারা দিন চলে যেত। সদরঘাটে আবার কুলি ও টাউটের খপ্পরে পড়ে হয়রানির ও প্রতারণার শিকার হতে হতো। মাদারীপুরের অধিবাসীদেরও ঢাকা আসতে অনেক কষ্ট করতে হতো।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জননেতা আবদুর রাজ্জাক সাহেবের উদ্যোগে মাওয়া-মাঝির ঘাট (জাজিরা) ফেরি চালু হয়। নদীর ঘাট থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত রাস্তাও হয়। আজ শরীয়তপুর ও মাদারীপুরবাসী দেশের সর্ব বৃহৎ সেতু তাদের জেলায় পেয়েছে। এর চেয়ে আর কি পাওয়ার আছে? আর কত আনন্দ হতে পারে? দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য সহজে ও দ্রুত সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে। কৃষি উৎপাদন বাড়বে। এ অঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার যাবে। ফলে নতুন নতুন শিল্প কারখানা তৈরি হবে। বাণিজ্য কেন্দ্র বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। মোংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হবে। বন্দরকেন্দ্রিক শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হবে। অর্থনীতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। দেশের জিডিপি ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের সম্পদ, অহংকারের নিদর্শন। এ সেতু আমাদের মর্যাদার প্রতীক, আত্মসম্মানের প্রতীক, কারও কাছে মাথা নত না করে মাথা উঁচু করার প্রতীক, সক্ষমতার প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক এবং সর্বোপরি আমরা পারি তা প্রমাণের প্রতীক। আর এ প্রতীক রচনার বীর ও সাহসী নায়ক সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। সহস্র সালাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
লেখক : সাবেক আইজিপি।
