মেরিন ড্রাইভ : অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
শামস আরেফিন
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সমুদ্র চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। তাই সঞ্জীব চৌধুরী গেয়েছেন-‘চোখটা এত পোড়ায় কেনো ও পোড়াচোখ সমুদ্রে যাও, সমুদ্র কী তোমার ছেলে আদর দিয়ে চোখে মাখাও’। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজার। অথচ সেই সৈকত কখনো স্বল্পসময়ে পুরো ঘুরে দেখা আমাদের সৌভাগ্য হয় না। আর স্বল্পসময়ে পুরো সমুদ্রসৈকত ভ্রমণও আমাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। কক্সবাজার সমুদ্র দর্শনে যাবেন, কিন্তু পুরো সৈকতের দৃশ্য কেমন তা দেখতে মেরিন ড্রাইভে যাবেন না, তা তো হতে পারে না। মেরিন ড্রাইভে ঘুরে সমুদ্রের প্রকৃত গর্জন, নীল ঢেউয়ের সৌন্দর্যের মাঝে সূর্যের আলো খেলা ও অবারিত সবুজের পাঠশালায় কার না মন চায় কিছুটা অবকাশ যাপন করার। সৈকতঘেঁষা মেরিন ড্রাইভে দাঁড়িয়ে নির্মল বাতাসে উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ এ পাথুরে নাগরিক জীবনে দেবে অন্য রকম অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে মেরিন ড্রাইভ।
১৯৯৩ সালে সেপ্টেম্বর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পর্যটনশিল্পের দ্রুত বিকাশের উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প এটি। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ডাইভ সড়ক প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনির্য়াস কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের (ইসিবি) মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রকল্পটি ২০০০ সালে একনেকের সভায় পাশ হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়-প্রকল্পটি তিনটি ধাপে বাস্তবায়িত হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৮ সালে প্রথম ধাপে কলাতলি থেকে ইনানি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটারের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে ইনানি থেকে শিলখালি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হয় ৪৭৪.৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে। আর অবশিষ্ট শিলখালি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয় ২০১৮ সালে প্রায় ২০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে। সব মিলিয়ে এ সড়কটি অত্র অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পাশাপাশি উপকূলের জনগণকে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস হতে রক্ষা, লবণাক্ততার প্রভাব হাস, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং বঙ্গোপসাগরের মৎস্য আহরণ ও মৎস্যশিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নির্মিত এ সড়কটিকে পৃথিবীর বৃহত্তম মেরিন ড্রাইভ সড়ক হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
কলাতলী থেকে বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একদিকে সাগর এবং অপরদিকে স্থলভাগে নিরবচ্ছিন্ন পাহাড়ে ঘেরা অসাধারণ প্রকৃতির মাঝে কম বেশি ২০০ মিটার প্রশস্ত সমতল এ করিডোর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত এ জাতীয় মহাসড়কটি এ পাহাড় শ্রেণির সামনে অবস্থিত। আর বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে এই সড়কটির দূরত্ব কোথাও ৭ কিলোমিটার, আবার কোথাও ১০ কিলোমিটার। কক্সবাজার কলাতলীর ডলফিন মোড় পার হয়ে একটু অগ্রসর হলে আমরা পেয়ে যাই মেরিন ড্রাইভ। কলাতলি পয়েন্ট থেকে এখানে বেড়াতে উন্মুক্ত ছাদের দ্বিতল বাসে আরোহণ করতে পারেন। এ পথের প্রথমদিকে রয়েছে বিভিন্ন মাছের হ্যাচারি জোন। এর একটু পরই রয়েছে দরিয়ানগর ইকোপার্ক বা দরিয়া নগর সমুদ্রসৈকত। আর এ দরিয়ানগর থেকে শুরু রামু উপজেলা। আর রামু থেকেই মেরিন ড্রাইভের উপভোগ্য সৌন্দর্যের শুরু। ড্রাইভের পূর্ব পাশে অরণ্যঘেরা পাহাড় ও পশ্চিমে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এ দুইয়ের মাঝেই পিচঢালা পথ। আরও একটু সামনে অগ্রসর হয়ে কক্সবাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে এ মেরিন ড্রাইভের সন্নিকটে হিমছড়ি সৈকত। এ স্পটে রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণা, পাহাড়ে অরোহণ করা ও সুউচ্চ পাহাড়ে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার সুযোগ।
মেরিন ড্রাইভ হয়ে হিমছড়ি পার হলে উত্তর হিমছড়ি, কাঁকড়া বিচ ও পেঁচার দ্বীপের অবস্থান। এখানে পেঁচার দ্বীপের পথের পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ক্যাফে। পেঁচার দ্বীপ অতিক্রম করে যেতে হয় করাছিপাড়া। করাছিপাড়ার রাস্তুার দুপাশে রয়েছে অজস গাছের সারি। আছে বিভিন্ন সুপারির বাগান ও পানের বরজ। অতপর মংলাপড়া হয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে অগ্রসর হলে দেখা যায় রেজুখাল। এ খালের সেতু পার হয়ে অগ্রসর হলে দেখা যাবে বিশাল ঝাউবাগান। আর ঝাউবাগান পার হয়ে আরও অগ্রসর হয়ে দুপাশে অবারিত সবুজে ঘেরা পথ দেখা যাবে। এ পথ ধরে কিছুটা অগ্রসর হলে পশ্চিমে দেখা যাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের খেলা, মাছধরার নৌকা ও সঙ্গে শোনা যাবে ঢেউয়ের গর্জন। এ গর্জন শুনতে শুনতে সোনারপাড়া, চরপাড়া, নিদানিয়া হয়ে ইনানী বিচ। জাতীয় এ মহাসড়ক থেকে সমুদ্র তীরের নয়ানাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকনে ও প্রাকৃতিক বাঁধ হিসাবে দাঁড়ানো পাহাড়ের সারি আপনাকে দেবে অসাধারণ অনুভূতি। সব মিলিয়ে সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য মেরিন ড্রাইভ সত্যিই অনন্য।
আইএমইডি পরিচালিত ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা জরিপে জানা যায়-এ সড়ক নির্মাণের ফলে প্রকল্পের এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তুলনামূলকভাবে উন্নত হয়েছে। যেমন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ও পরে প্রকল্প এলাকায় ১০,০০০ টাকা বা তদূর্ধ্ব আয়কারী পরিবারের সংখ্যা ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের মানুষের পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এ অঞ্চলের বসবাসরত মানুষের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ২১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে পূর্বে ১৭ শতাংশ বেকার থাকলেও তা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-প্রকল্প এলাকায় জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতে-এ প্রকল্পের কারণে পর্যটন ও নির্মাণ সেক্টরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ৮০ কিমি সড়ক নির্মাণের ফলে বিশ্বের দীর্ঘতম ও নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত সমুদ্রসৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারে দেশি বিদেশি পর্যটক সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া আইএমইডি পরিচালাতি জরিপে উঠে এসেছে-স্থানীয়ভাবে কৃষকদের জন্য তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে মেরিন ড্রাইভ। প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত কৃষকদের ওপর পরিচালিত জরিপে এও জানা যায়-৯৫ শতাংশ কৃষক মনে করেন আগে তুলনায় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, ৬৫ শতাংশ জরিপে অংশগ্রহণকারী মনে করেন-প্রকল্প এলাকায় মহিলাদের আয় উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কক্সবাজার-টেকনাফের বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক এবং মেরিন ড্রাইভ সড়কের মধ্যবর্তী এলাকায় বনজসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সহজতর হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ সড়কটি বিদ্যমান কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের বিকল্প সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও বড় বাস-ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল করছে না, তবুও জনসাধারণসহ পর্যটকরা আগের তুলনায় ১.০০ ঘণ্টা থেকে ১.৩০ ঘণ্টা মধ্যে যাতায়াত সুবিধা পাচ্ছে। এ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের ফলে বিদ্যমান হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা দ্রুত পরিবহন ও নতুন হ্যাচারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দেশের মৎস্যশিল্প উন্নয়ন সহজতর হয়েছে। শুধু চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা আয় করে। ফলে চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য সম্পদ রপ্তানির করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ প্রকল্প।
কক্সবাজার-টেকনাফের বিদ্যমান সড়ক ও সমুদ্রসৈকতের পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের ফলে মধ্যবর্তী এলাকার জনগণ এবং চাষযোগ্য জমি জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রকল্পের পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ ২য় পর্যায় (ইনানী থেকে শিলখালী পর্যন্ত) নির্মাণ করায় এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ফলে প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি, এ সড়ক নির্মাণ করায় কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সড়কটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে অনেকের বিশ্বাস।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৯-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩ শতাংশ যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৯.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৬০ হাজার, মানুষের যা মোট কর্মসংস্থানের ৩ শতাংশ। অথচ আমরা এখাতে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে, যা নিম্নের স্মারণীতে দেখানো হলো;
বিগত এক দশকের মতো সময় ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ বেশি হচ্ছে। স্বাধীনতার এ পঞ্চাশ বছর উদযাপনকালে আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ সার্বিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ বিশ্বে নিজেকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে প্রমাণ করেতে পেরেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ৩.৪৫ শতাংশ হয়েছে। করোনাপরবর্তী সময়ে অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মোট মাথাপিছু আয় আমাদের বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২,২৩৪ মার্কিন ডলার। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মাথাপিছু জিডিপি আয়ে বাংলাদেশ ভারতকে অতিক্রম করেছে। অর্থনীতির এ ধারা অব্যাহত রাখতে মেরিন ড্রাইভ সত্যি অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে যদি আমরা এখানে পর্যটকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি। আশা করা হচ্ছে-মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক সংযুক্ত হবে এ মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইটি ইন্টারন্যাশনাল গত প্রায় এক বছর সময় ধরে সমীক্ষা পরিচালনা করছে। যদি মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে এ সড়কের সংযোগ হয়, তাহলে অপার সম্ভাবনার দেশ আমাদের এ মাতৃভূমি অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপার সম্ভাবনার দ্বার সহজেই উন্মুক্ত করতে পারবে।
পর্যটন খাতের অর্থনৈতিক অবদান
দেশ জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান পর্যটন খাতের কর্মসংস্থানে অবদান
বাংলাদেশ ৩% ২.৯০%
চীন ১১.৩% ১০.৩০%
ভারত ৬.৮% ৮%
মালয়েশিয়া ১১.৫% ১৪.৭০%
থাইল্যান্ড ১৯.৭% ২১.৪০%
লেখক : কবি ও গবেষক, বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট
