Logo
Logo
×

২৩ বছরে যুগান্তর

হাতিরঝিল : একটি শুভ পরিবর্তন-উদ্যোগ

Icon

আনোয়ার সেলিম

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাতিরঝিল : একটি শুভ পরিবর্তন-উদ্যোগ

হাতিরঝিল। নামটার সঙ্গেই একটি নস্টালজিক ঐতিহাসিক দ্যোতনা আমাদের মানস-পটে ফুটে ওঠে। বিশেষত বিগত শতাব্দীর নব্বই-এর দশক বা তারও আগে এবং পঞ্চাশ ষাট কিংবা ঐতিহাসিকদের যারা এ এলাকা দেখেছেন বা ইতিহাস চর্চা করেছেন তাদের কাছে ক্রম পরিবর্তন চিত্র এক রকম; আর বিপরীতে বর্তমান প্রজন্মের কাছে অন্যরকম।

এ প্রজন্মের কাছে হাতিরঝিল একটি নান্দনিক আরবান-স্পেস যাতে আছে স্বচ্ছ পানির লেক, বিনোদন ও শ্বাস নেওয়ার মতো উন্মুক্ত পারিসর, আলো ঝলমলে স্থাপনা ও গমনাগমনের জন্য পরিচ্ছন্ন রাস্তা। এ পরির্তনের পেছনে ক্রমাগত নগরায়ণ ও এর ফলে নাগরিক সমস্যা ও বিড়ম্বনার সমাধানে আধুনিক উদ্যোগের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে।

হাতিরঝিল এলাকায় সঙ্গে এর আশপাশের কয়েকটি স্থানের নাম মিলিয়ে দেখা যাক। এগুলো হচ্ছে : এলিফ্যান্ট রোড, পিলখানা, হাতিরপুল, কলাবাগান, ভূতপূর্ব রেসকোর্স, পল্টন ইত্যাদি। এ এলাকাগুলো নবাবি আমল ও সমসাময়িক ভাওয়াল রাজাদের জমিদারির অংশ ছিল। মূলত বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নগর সভ্যতার পত্তন ঘটে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এ ভূখণ্ডে এমনিতে অসংখ্য নদীনালা, খাল-বিল জলাধারের সঙ্গে উর্বর পলেল ভূমি-জাত প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয় ইতিহাসে জানা যায়।

যে সময় সাধারণত তুলনামূলকভাবে অবস্থাপন্ন ও অভিজাত শ্রেণিয় মানুষদের চলাচলের বাহন, মালামাল পরিবহন, ভারী জিনিসপত্র স্থানন্তর, যুদ্ধ-বিগ্রহ এসব কাজে যেমন হাতির ব্যবহার হতো; অন্যদিকে বেশি সংখ্যক হাতি পোষা এক ধরনের অভিজাত্য, সম্পদ ও শক্তিমন্ডার পরিচায়ক ছিল।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এক বা দেড়শতক আগে পূর্বে বর্ণিত এলাকাটি হস্তিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। পিলখানায় ছিল হাতিদের আবাসস্থল। সেখানে থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে হাতিরপুর অতিক্রম করে হাতির ঝিলে হাতিদের গোসল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশ্রাম, রোদ পোহানোর ব্যবস্থা ছিল। রেসকোর্স পল্টন, এলাকায় ছিল হাতিদের চারণভূমি। ধারণা করা হয় কলাবাগান এলাকায় হাতিদের খাদ্য হিসাবে কলাগাছের চাষ হতো। ঢাকায় অতি পুরোনো কিছু ছবিতে হাতির পাল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাহূতদের এসব এলাকা অতিক্রম করতে দেখা যায়।

মূলত কথা যাচ্ছিল বর্তমান হাতিরঝিল নিয়ে। ঢাকা, পূর্ববঙ্গ ও পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ার পর দ্রুত নগারায়ণ ঘটতে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে নগর-বন্দর নাগরিকদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে আসছে। প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার বিত্তবান নাগরিকদের বিলাস ও সুখ নিশ্চিত করার জন্য সেবাদানকারী বিত্তহীন অন্ত্যজ শ্রেণির বস্তি গড়ে উঠতে থাকে যত্রতত্র। সাধারণভাবে জলাধারের আশপাশে অনেকটা দাবিদারহীন বা পরিত্যক্ত ভূমিতে ঘন-সন্নিবিষ্টভাবে এসব বস্তি গড়ে ওঠে। এগুলো ঘিঞ্জি ও নাগরিক সেবা-সুবিধাহীন মানবেতর বসতে পরিণত হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত সমস্যা তৈরি করতে থাকে। এর মধ্যে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ আটকে দেওয়া, দূষিত বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনের পরিকল্পিত ব্যবস্থাহীন এসব বস্তি নাগরীর বিষফোঁড়া হিসাবে বিস্তৃত হতে থাকে। একই সঙ্গে বস্তিগুলো বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের সূতিকাগার হয়ে ওঠে।

এক সময় অধুনালুপ্ত বেগুনবাড়ী খাল ও রামপুরা খাল হাতিরঝিলে এসে মিশেছিল। বর্তমান ধানমণ্ডি লেক পান্থপথ বরাবর লুপ্ত একটি খালের মাধ্যমে হাতিরঝিল ও সন্নিহিত গুলশান ও বনানী লেকের সঙ্গে পরস্পর সংযুক্ত হয়ে বর্তমান বনশ্রীর জলাভূমি বিধৌত হয়ে ধলেশ্বরীতে পড়েছিল।

নব্বই-এর দশকে পান্থপথ ও এর পার্শ্বস্থ খাল বন্ধ করে বক্স কালভার্ট এবং সংযোগ সড়ক তৈরির ফলে ধানমণ্ডি লেকের সঙ্গে এর সংযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তেজগাঁও ও মগবাজারের মাঝমাঝি এলাকা সংলগ্ন বেগুনবাড়ী খাল ও হাতিরঝিল বিশাল এক ঘিঞ্জি বস্তিতে পরিণত হয়। একদিকে এখানকার অধিবাসীদের মানবেতর জীবনযাপন, অপরাধীদের অস্তানা, ক্রমাগত দূষণে নগরকেন্দ্রের এ জায়গাটির পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল, আর অন্যদিকে চলাচলের উপযোগী সংযোগ সড়কের অভাবে নগরের যানজট ভয়াবহ জটিল আকার ধারণ করে। এমনকি আশি-নব্বুই দশকেও এ বিষয়ে নগর প্রশাসকদের আদৌ কোনো মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। উলটা পান্থপথের বক্স-কালভার্ট বাহিত পয়ঃবর্জ্য হাতিরঝিলে পড়ে এবং সঙ্গে বস্তির বর্জ্য যুক্ত হয়ে এটিকে আরও পুতিগন্ধময় চরম অস্বাস্থ্যকর এক ভাগাড়ে পরিণত করে ।

এ অবস্থায় পরিবেশ আন্দোলনকারী, একদল স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, নগর-বিশারদ সুধী এবং সিভিল সোসাইটির ক্রমাগত চেষ্টা ও চাপ নীতিনির্ধারকদের টনক নাড়াতে সক্ষম হয়। ২০০৭ সালের অক্টোবরে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় উন্নয়ন ও যানজন নিরসন করে প্রকল্প এলাকায় শ্রীবৃদ্ধি-পূর্বক একটি নাগরিক উন্মুক্ত বিনোদন পরিসর তৈরি করা।

ইতোমধ্যে প্রকল্পে কাজ শুরু করতেই বেশ বিলম্ব ঘটে। এটি ২০১০-এর জুনে শেষ হওয়ায় কথা থাকলে ও নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি জনসাধাণের জন্য উন্মুক্ত হয়।

বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিশেষ উদ্যোগ, তত্ত্বাবধান ও আগ্রহে রাজউক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানসহ ইত্যাদি বহুপক্ষের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি সম্পন্ন হতে আরও কিছু কাজ বাকি আছে। বস্তুত উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যাতে জনগণের অংশগ্রহণ, অগ্রহ ও চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে উপযোগী নীতিনিধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। বাস্তবায়নে চাই সামর্থ, অর্থ এ কার্যকর টেকসই নির্মিতি। গর্বের বিষয় হচ্ছে-এ নির্মাণে সম্পূর্ণ দেশীয়, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ নিয়োজিত ছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা করা প্রয়োজন সামগ্রিকতা বিবেচনায় নিয়ে। এরপর বৃহৎ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হবে উপযোগিতার অগ্রাধিকার বিবেচনায় খণ্ডাংশে এবং যুগপৎভাবে। বর্তমানে হাতিরঝিল একটি মনোরম দর্শনীয় ও বিনোদনমূলক নাগরিক সম্মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সব শ্রেণির জনগণের জন্য এ পরিসর উন্মুক্ত হয়েছে। ঢাকায় পূর্ব ও পশ্চিমাংশের প্রধান সড়ক হাতিরঝিলের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়েছে। দর্শনার্থী, ভ্রমণপিপাসু ও কম্যুটারদের জন্য সার্কুলার রুটে বাস চলাচল করছে। চালু হয়েছে ওয়াটার বাস। এটি একই সঙ্গে বিনোদন ও যাত্রীদের গন্তব্যে পারাপার সহজ করেছে। লেকে সংগীতের তালে বর্ণিল আলোকচ্ছটায় জলফোয়ারার নৃত্য দর্শকদের মুগ্ধ করছে। ফুডকোর্ট, এম্ফিথিয়েটার, প্লাজা, পায়ে চলার রাস্তা, বিশ্রাম ও অবসর কাটানোর মতো নাগরিক সম্মিলনির বিবিধ উপাচারে এলাকাটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে এখনো কিছু সমস্যা থাকলেও বহুপাক্ষিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান আরও সংহত এবং নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়। পাবলিক স্পেস ব্যবহারে জনগেণের সচেতনতা সৃষ্টিরও প্রয়োজন আছে।

নাগরিক সমস্যা তথা ঘিঞ্জি বস্তি থেকে একটা চমৎকার ও মনোরম পাবলিক প্লেস-একই সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানমূলক পরিবর্তনের এ ধারণাটিই অনন্য সাধারণ। সে বিবেচনায় অর্জনটি অবশ্যই অনেক বড়। উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য উপযুক্ত দূরদর্শী, প্রগতিশীল নেতৃত্ব, ও দৃঢ়তা যে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে হাতিরঝিল প্রকল্প তার একটি উদহরণ হতে পারে। একটি পরিবর্তন অপর পরিবর্তন কে ত্বরাম্বিত ও উৎসাহিত করে।

হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প পরিবর্তনের পক্ষে পথনির্দেশক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে ইতোমধ্যে অনুরূপ পরিবর্তনের অনুবৃত্তি ঘটানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এটাই আশায় বিষয়।

লেখক : স্থপতি, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও এনবিআরের সাবেক মহাপরিচালক

 

উদ্যোগ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম