Logo
Logo
×

২৩ বছরে যুগান্তর

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা : প্রাসঙ্গিক বিষয়

Icon

প্রফেসর ড. মো. গোলাম সামদানী ফকির

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা : প্রাসঙ্গিক বিষয়

ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। একমাত্র শিক্ষাই মানবকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারে। এ কারণেই শিক্ষা শব্দটি বহুমাত্রিক। সময় ও বিষয়ের প্রয়োজনে শিক্ষাকে বিভাজন করা যায় নানাভাবে, নানা উপায়ে। তবে শিক্ষা যে শুধু ‘প্রচলতি আনুষ্ঠানিকতা’ নয়, একাডেমিক গণ্ডির বাইরেও এর বিশাল পরিসর রয়েছে; একুশ শতাব্দীর দুই দশক পর এসেও আজ আমরা শিক্ষার সেই পুরোনো ছকে আটকা পড়ে আছি। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে এ গণ্ডি পেরোতে হবে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমে এর শুরুর ইতিহাস নিয়ে দুই-একটা কথা বলা প্রয়োজন। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় গঠিত কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে আজকের এ উচ্চ-শিক্ষাব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়েছে। এর পেছনে যেমন নানা শাসকগোষ্ঠী, দল ও ব্যক্তির যুগপৎ প্রচেষ্টা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিদেশি শিক্ষার প্রবেশ ও অনুপ্রবেশ। দেশীয় শিক্ষাব্যস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৭৪ সালে, ‘কুদরাত-এ-খুদা’ তথা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে। সদ্যোজাত স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩০ মে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। এ প্রতিবেদনেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চার বছর মেয়াদি সম্মিলিত ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালুসহ নানা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়; যা পরে বাস্তবায়ন হয়। শুধু তাই নয়, এ কমিশনের মাধ্যমেই প্রতি বৃহত্তর জেলা, বিভাগীয় শহর এবং রাজধানীতে একটি করে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের কথা বলা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি (১৯৭৮), মজিদ খান শিক্ষা কমিশন (১৯৮৩), বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৮৭), শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ ও অন্যান্য এবং ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চ-শিক্ষাবস্থায় নানাভাবে পরিবর্তন এসেছে।

তবে এতকিছুর পরও আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সত্যিকার অর্থেই কি আমাদের উচ্চস্তরের শিক্ষাব্যবস্থার সব পরিবর্তন ইতিবাচক? স্বাধীনতার ৫০ বছরে মানসম্মত শিক্ষাদানের বিষয়টি-ই বা কতটুকু এগিয়েছে? উচ্চস্তরের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে কতটা অবদান রাখছে? এসবের সঙ্গে আরও একটি উদ্বেগ আমরা দূর করতে পারছি না; তা হলো-সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ডান-বাম চোখে দেখা। একদিকে বলা হচ্ছে, ‘আমরা পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা চোখে দেখি না’; অন্যদিকে পূর্ণ সহায়তার অভাবে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষাদানে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখলেও তারা পিএইচডি ডিগ্রি কোর্স পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজই হলো-জ্ঞান অন্বেষণের নেতৃত্ব দেওয়া, জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত এবং জ্ঞানের সাধনা ও প্রচার করা।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের উচ্চ-শিক্ষাব্যবস্থায় যখন দীর্ঘ সেশনজট ও বিদেশমুখিতা প্রবল রূপ ধারণ করেছিল; তখন এ প্রবণতা রোধে উচ্চস্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতা কমানোর বিষয়টি সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও দেখা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার প্রবণতা সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। সংখ্যা বিবেচনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গিয়েছেন। জনসংখা ও শিক্ষার্থী শতাংশ বিবেচনায় যা ভারত, পাকিস্তান, নেপাল থেকে সবচেয়ে কম। বলতে দ্বিধা নেই, গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষার আকার বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখা বাড়ার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। যেহেতু দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে, স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের বিদেশযাত্রার হার কমে গেছে। বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই দেশের স্বার্থে ইতিবাচক। যদিও শিক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করা এখনো আমাদের বড় চালেঞ্জ।

॥ দুই ॥

স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা পর্যালোচনা করলে আমরা লক্ষ করে থাকব, ১৯৭৩-এর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষার সঙ্গে কাজের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সময়োপযোগী শিক্ষা অর্জনের কৌশল হিসাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণকেও সমানভাবে আনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘Efforts will be made to improve the quality of Education by making an optimum use of the available facilities and increasing the number of trained teachers...’

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক হতে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি ছাড়া অন্য কোনো ডিগ্রি প্রয়োজন হয় না। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার নিয়োগ হয় শুধু ভাইভা পরীক্ষার মাধ্যমে। লিখিত পরীক্ষা কিংবা ডেমো ক্লাসের মতো বিষয়গুলো সেখানে অনুপস্থিত। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষক হতে হলে ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে। অর্থ্যাৎ প্রার্থী যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি তার জন্য জরুরি। অথচ বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থাকলেও উচ্চস্তরের শিক্ষকদের জন্য আজও কোনো ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।

আবার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে দেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল) চালু করা হলেও বর্তমানে তা নিষ্ক্রিয়। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে গড়ে ওঠা সিইটিএল’ শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিইটিএল-এর কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইটিএল কয়েক বছর আগে ভালো কাজ করলেও সম্প্রতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আর রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইটিএলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অন্যদিকে সরকারি কোনো প্রষ্ঠপোষকতা না থাকলেও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা তিনটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি ও ইউল্যাব) সক্রিয়ভাবে তাদের সিইটিএল কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।’

শিক্ষাব্যবস্থায় যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক না কেন; বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ, চাকরি পূর্ব ও চাকরিকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা না হলে আদতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই ২০১৬ সালে গড়ে উঠেছে ফাউন্ডেশন ফর লার্নিং, টিচিং অ্যান্ড রিচার্চ (এফএলটিআর)। আমি তখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে গ্রিন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসাবে কর্মরত। তখনই অনুভব করলাম, এমন একটি আলাদা প্ল্যাটফরম থাকা দরকার; যা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এ ভাবনা থেকেই গড়ে তুলি ফাউন্ডেশন ফর লার্নিং, টিচিং অ্যান্ড রিচার্চ। প্রতিষ্ঠকালীন প্রথম সারির ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তথা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আহ্ছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি), ইউল্যাব, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবং গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্যবৃন্দ এ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এ সংগঠনের চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অবর্তমানে আমি এ সংগঠনের চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। এফএলটিআর প্রতিষ্ঠার পর গত পাঁচ বছরে তিন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে (প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক) সার্টিফিকেট কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ‘টিচিং ফর অ্যাক্টিভ লার্নিং’ ও ‘সার্টিফিকেট ইন-লার্নিং অ্যান্ড লার্নিং’ নামক কোর্সের অধীনে প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবলিক ও প্রাইভেট) শিক্ষকবৃন্দ এ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছে।

॥ তিন ॥

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বা Sustainable Development Good (SDG)-এ ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো শিক্ষা। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো-শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান তৈরি ও বৈশ্বিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনমূলক গবেষণায় জোর দেওয়া। অর্থাৎ নতুন এ শতাব্দীতে শুধু জ্ঞানার্জন করলেই হবে না, বরং এর প্রায়োগিক ব্যবহারও জানতে হবে। কিন্তু বাস্তব রূপ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, আমাদের উচ্চ-শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ানো সিলেবাসগুলোয় এখনো পুরোনো ধাঁচ বিরাজমান। সনাতন পদ্ধতিতে চলছে শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন। অন্যদিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে কোভিড-১৯। অনলাইন, ফেস টু ফেস কিংবা ব্লেন্ডেড মুড পদ্ধতিতে ক্লাস পরিচালনায় এখনো আমরা সাবলীল নয়। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্প চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেসব দক্ষতা, অনুষঙ্গ ও কোর্স কারিকুলাম দরকার, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই এখনো আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরিচিত হতে পারেনি। অথচ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে পুরোনো কোর্স কারিকুলাম বদলে Outcome Based Education (OBE) পদ্ধতি গ্রহণ করে পাঠদান শুরু করেছে। আমাদের দেশের পাঠ্যসূচিও বিদেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ওবিই প্রক্রিয়ার দিকে এগোতে হবে। তা না হলে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা নতুন এ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গিয়ে হোঁচট খাবে।

বলা হচ্ছে-চলমান শিক্ষায় সিজিপিএকে মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়, কিন্তু OBE শিক্ষাব্যবস্থায় একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতার বিষয়টিও সামনে আনা হয়। অর্থাৎ এটা সুনির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জনভিত্তিক শিক্ষা। এ প্রক্রিয়ায় সেমিস্টার শেষে একজন শিক্ষার্থী কী শিখল, তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করাও সহজ। এখানে একজন শিক্ষক কী পড়ালেন সেটা মুখ্য বিষয় নয়, বরং শিক্ষার্থীরা কী শিখলেন বা জানলেন-সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ঙইঊ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বললেও প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কারণ দেশের উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খুব কমসংখ্যক শিক্ষকেরই ওবিই সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক এ শিক্ষা কারিকুলাম গ্রহণ করতে না পারলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে।

শেষ করব, তার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করছি। কবিগুরু তার ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্পর্কে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্য স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি।’ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি ছোট্ট বাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়।’ অর্থাৎ উৎপাদিত বিদ্যা বিতরণই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা করতে হবে। আমাদের সেই পথেই হাঁটতে চাই।

বাংলাদেশের উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তখনই সত্যিকারের উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে, যখন পাবলিক-প্রাইভেটের বৈষম্য ভুলে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক কাতারে আনতে পারব; কিংবা নৈতিক মূল্যবোধ ও কর্মমুখী শিক্ষার সমন্বয়ে দেশে প্রজন্ম পরম্পরায় শিক্ষিত, চরিত্রবান ও প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার মতো দক্ষ গ্র্যাজুয়েট গড়ে তুলতে পারব-যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আমাদের মেধা, মনন ও সৃষ্টিশীলতাও তখন একুশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের উচ্চ-শিক্ষাব্যবস্থা সেই দিনের অপেক্ষায়...।

লেখক : উপাচার্য, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

উচ্চশিক্ষা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম