Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

সুস্থ জীবনের লক্ষ্যে সুস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার

Icon

ডা. আহসান উদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা তার জীবনের নানা ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। আমার জীবনের নানা ক্ষেত্র, নানা দিক নিয়ে হচ্ছি পূর্ণ আমি। এবং একেকটা ক্ষেত্রে আমি একেকভাবে Perform করি। যেমন-আমার শিক্ষা জীবন, কর্ম জীবন, পারিবারিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, সামাজিক জীবন ইত্যাদি নানা জীবন বা ক্ষেত্র নিয়ে আমার পূর্ণ জীবন। এখন দৈনন্দিন জীবনের এ কর্ম প্রক্রিয়ায় জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমি কতটুকু সফলতার সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে এবং সুন্দরভাবে জীবনকে পরিচালিত করতে পারব তা নির্ভর করে আমার মানসিক সুস্থতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সমৃদ্ধির ওপর। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতার মাত্রা খুবই কম। আমাদের শারীরিক সুস্থতার বিষয়টিকে আমরা যতটুকু গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি, দুঃখজনক হলেও সত্য, মন তথা মানসিক সুস্থতার বিষয়টি আমাদের কাছে ততটুকুই অবহেলিত। মনের সুস্থতার প্রতিই যেখানে আমাদের গুরুত্ব শূন্যের কোঠায় সেখানে সমৃদ্ধি তো আরও সুদূর পরাহত। এখন প্রথমে আসি মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক সুস্থতা বলতে আমরা কি বুঝি?

শরীর এবং মন এ দুই মিলে হচ্ছে মানুষ। শরীর ছাড়া যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না তেমনি মন বিহীন মানুষও অকল্পনীয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে শরীরকে যেমন হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়, স্পর্শ করা যায়, মনকে তেমনভাবে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা যায় না। তবে মনের অস্তিত্বকে অনুভব করা যায়, মনকে মন দিয়ে স্পর্শ করা যায়। আবার তার মানে এই নয়, মন একটি বায়বীয় বিষয়। মন কেবলই একটি বায়বীয় বিষয় নয়। Biologically মনের অস্তিত্ব বিরাজমান। Biologicall মন হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের কতগুলো Neuronal pathway, neurotransmitter, hormones, অন্যান্য Chemicals, নিউরন এবং Synapse-এর সমন্বিত কার্যক্রমের বহিঃপ্রকাশ। যখন এ কার্যক্রম সঠিকভাবে চলে তখন আমরা বলি মানসিকভাবে সুস্থ। যখন এ কার্যক্রমের বিপর্যয় ঘটে তখনই দেখা দেয় মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো। আর সমৃদ্ধির ব্যাপারটা তখনই সম্ভব যখন আপনি মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন।

এবারে আমার এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর আবার দৃষ্টি ফেরাই। প্রতিপাদ্যে দুটি বিষয় লক্ষণীয় (১) মানসিক স্বাস্থ্য এবং (২) তার সমৃদ্ধি। এবং এ দুটো বিষয়কে সার্বজনীন অগ্রাধিকার দেখার কথা বলা হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এ অগ্রাধিকারের প্রশ্ন কেন আসছে? কারণ, আমি আগেই উল্লেখ করেছি দুঃখজনক হলেও সত্যি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখনো চরমভাবে অবহেলিত। কিন্তু সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা এবং সমৃদ্ধিকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এ সার্বজনীন অগ্রাধিকার তথা গুরুত্ব দেবেন? আমরা এবার ধাপে ধাপে আলোচনা করি কিভাবে সার্বজনীন অগ্রাধিকারের বিষয়টিকে স্থাপন করবেন।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে একবার চিন্তা করে দেখুন তো পৃথিবীতে এমন একজন মানুষও কি খুঁজে পাবেন যিনি জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রচণ্ড উদ্বেগ, বিষণ্নতা কিংবা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেননি। কিংবা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনই আমরা দিনের কোনো না কোনো সময় উদ্বেগ, উত্তেজনা, হতাশা, উৎকণ্ঠা কিংবা বিষণ্নতা অনুভব করি না? দেখবেন উত্তর আসবে হ্যাঁ, আমরা এ সবই অনুভব করি। কিন্তু এ সমস্যা বা লক্ষণগুলো অনুভব করলেই কিন্তু আপনি মানসিক রোগী হয়ে গেলেন না। এগুলো সবই আমাদের চিন্তা, আমাদের মনন তথা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোকে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের মতো করে মোকাবেলা করি। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে কতটা সফলতার সঙ্গে এবং দক্ষতার সঙ্গে আপনি এসব মোকাবিলা করছেন তার ওপর নির্ভর করছে আপনার মানসিক সুস্থতা। আবার মানসিকভাবে সুস্থ থাকলেই কেবল এগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারবেন। তাহলে এর পরের প্রশ্ন হলো কখন আপনি মানসিক রোগী হবেন? যখন এ মানসিক অবস্থাগুলোকে আপনি দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না এবং এগুলো আপনার জীবনের স্বাভাবিক গতিকে চরমভাবে ব্যাহত করবে অর্থাৎ আপানার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক তথা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে বিপর্যস্ত করবে তখন আপনার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন। কাজেই আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে অটুট রাখতে আপনার নিজেকেই সচেতন হতে হবে এবং অগ্রাধিকার দিতে হবে। এবারে সমৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলি। মানসিক স্বাস্থ্যের সমৃদ্ধির বিষয়টি আপেক্ষিক এবং একেক জনের স্তর একেক রকম এবং এ সমৃদ্ধির কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। আপনি প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবেন। নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাবেন। তবে এটা অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার জ্ঞান, জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতার যথাযথ মূল্যায়ন এবং প্রয়োগ, নিজের সম্পর্কে নিজের স্বচ্ছ ধারণা এবং সমস্যা মোকাবিলার দক্ষতার ওপর। কাজেই স্বচ্ছ জ্ঞান নিয়ে, মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজেকে নিজে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই।

একইসঙ্গে এ বোধেরও অনুধাবন প্রয়োজন যে শরীরের মতোই মনেরও রোগ হতে পারে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিলে মানসিক রোগী একটা সুন্দর Productive জীবন-যাপন করতে পারে।

পারিবারিক পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সমৃদ্ধিকে সার্বজনীন অগ্রাধিকার হিসাবে স্থাপন করা নিয়ে। প্রশ্ন হলো পারিবারিক পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন কিভাবে করবেন? ব্যক্তি পর্যায়ে যে মানসিক সমস্যাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করেছি তার সবই হচ্ছে লঘু মানসিক সমস্যা/ব্যাধি। কিন্তু গুরুতর মানসিক ব্যাধি যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার ইত্যাদির ক্ষেত্রে রোগ সম্পর্কে রোগীর অন্তর্দৃষ্টি (Insight) থাকে না। অর্থাৎ রোগী সচরাচর বুঝতে পারেন না যে তিনি অসুস্থ। ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সর্বাগ্রে সজাগ হতে হবে এবং চিকিৎসার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, চিকিৎসার মাধ্যমে গুরুতর মানসিক ব্যাধির রোগীরা অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। লঘু মানসিক রোগগুলোর ক্ষেত্রেও পরিবার একই ভূমিকা রাখতে পারে। একইসঙ্গে সুন্দর, সুস্থ পারিবারিক বন্ধন, পরিবারের সদস্যদের একের প্রতি অন্যের সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সমৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পরিবারের যথাযথ ভূমিকার কোনো বিকল্প নাই। একই কথা আসে পরিবারের বয়স্কদের ক্ষেত্রেও। বয়োবৃদ্ধদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সুস্থতার প্রতি আমাদের নজর সবচেয়ে কম। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা চরম অবহেলার শিকার হন। আমাদের পরিবারের সিনিয়র সিটিজেনরা অনেক ক্ষেত্রে চরম বিষণ্নতা, অবসাদ এবং নিরাপত্তাহীনতায় তাদের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন। যদিও বা তাদের শারীরিক অসুস্থতার প্রতি পরিবারের সদস্য যত্নবান হন কিন্তু তাদের মানসিক স্বাস্থ্য থাকে একেবারেই অবহেলিত।

কিন্তু তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যেমন পরিবারের অন্য সদস্যদের নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব তেমনি এর প্রাপ্যতা তাদের মৌলিক অধিকার।

সামাজিক পর্যায়ে-সামাজিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে সার্বজনীন অগ্রাধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। বাংলাদেশসহ এ সাবকন্টিনেন্টে বিষয়টি আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের জীবনের একটা বিরাট জায়গা জুড়ে আছে। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং ধর্মের অপব্যাখ্যা একদিকে যেমন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ তেমনি এগুলো মানসিক রোগের চিকিৎসাকেও বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তাই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতা, সঠিক শিক্ষা এবং ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা জনগণকে জানানো জরুরি। সমাজের কিছু প্রচলিত বিধান আছে যার অনেকগুলোই সত্যিকার অর্থে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এ বিধানগুলোর অনেকগুলোই আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা এবং মনের সমৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। মানসিক সু-স্বাস্থ্যের সার্বজনীনতা নিশ্চিত করতে গেলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানসিক রোগীদের প্রতি সমাজের সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পুনর্বাসনের জন্য অপরিহার্য।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে-মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে এর সংযোগ ও সফলতা মূলত নির্ভর করে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতি এবং পরিচর্যার ওপর। কারণ, প্রশ্ন যখন সার্বজনীন অগ্রাধিকারের এবং সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সমৃদ্ধির তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো দিনই তা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকে নিয়ে ভাববার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মানসিক অসুস্থতা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যেমন ২০২০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধু উদ্বেগ (অহীরবঃু) এবং বিষণ্নতা (Depression) জনিত মানসিক ব্যাধির কারণে প্রতি বছর Global economy ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার Productivity হারায়। ফলে একটি মজবুত অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মানসিকভাবে সুস্থ জনগোষ্ঠী পূর্বশর্ত। ঠিক তেমনিভাবে সাংস্কৃতিক এবং দার্শনিকভাবে একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের সমৃদ্ধি অপরিহার্য।

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে গবেষণার বিষয়টি অতীব জরুরী। গবেষণা বিষয়ক কার্যক্রমগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।

যদিও মানসিক স্বাস্থ্য সব সময় সব অবস্থাতেই অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে তথাপি করোনা পরবর্তী পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য আরও নাজুক অবস্থায় এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর সমৃদ্ধিকে সার্বজনীন অগ্রাধিকার দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ খেয়াল করলে দেখবেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যায় কিন্তু মনের অসুস্থতা নিয়ে আপনি কিছুতেই স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন না। আমাদের অন্তর্জগৎ এবং বহির্জগৎ দু’টোই মনের ওপর সমহারে ক্রিয়াশীল। এ ক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের চিন্তা, আমাদের মনের প্রতিক্রিয়ার ধরনের ওপর জীবনের গতিপথ, স্বাচ্ছন্দ্য, সুখ-স্বস্তি নির্ভর করে। তাই আপনার জীবনের সুন্দর, সুস্থ, ছন্দময় গতিময়তার জন্য আপনার মনের সুস্থতা অপরিহার্য। তাই আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের মানসিক সুস্থতা এবং সমৃদ্ধির প্রতি নজর দিন। মনের অসুখ, মনের অসুস্থতাকে কখনই অবহেলার চোখে দেখবেন না। মনে রাখবেন শরীরের যেমন অসুখ হয় তেমনি মনেরও অসুখ হয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে সুস্থ হওয়া যায়। মনকে সুস্থ রাখুন, মনকে সুন্দর সুন্দর চিন্তায় সমৃদ্ধ করুন, জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করুন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), জাতীয় মানসিক

স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম