Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

হালের বাংলা সংস্কৃতি

Icon

সোমা দেব

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালের আবর্তে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি বহু দেশের, বহু অঞ্চলের মানুষের সমন্বিত সংস্কৃতি। কালের বিবর্তনে, সময়ের প্রবাহে এ সংস্কৃতি নানা রকম ভাষা, আচার, পার্বণ, খাদ্য, শিক্ষা, রীতিনীতি, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সবকিছু মিলে একটি সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়েছে। যা বহুকাল ধরে চর্চার ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসকারীরা একটি অভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে সেই সংস্কৃতি চর্চায় শহুরে ও গ্রামীণ সংস্কৃতিচর্চায় মোটা দাগে একটা পার্থক্য ধরা পড়ে। সংস্কৃতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। বয়ে চলা নদীর মতো সংস্কৃতিও বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। সময়ের বিবর্তনে সেই সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা মত, ভিন্নতা, পরিবর্তন।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণ দীর্ঘদিন ধরেই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখেছিল। বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক পার্বণ, উৎসব, বিয়ের আচার, বিয়ের গীত, ধানকাটা উৎসব, নৌকাবাইচ, গ্রামের মেলা, গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ, সহজ-সরল-সাধারণ জীবনই গ্রামীণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। বাঙালি জাতির পরিচয়ই গ্রোথিত রয়েছে গ্রামে। আজকের শহুরে মানুষের বিশাল একটা অংশই গ্রাম থেকে উঠে আসা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন শাখায়, নাটক, সিনেমা, সংগীত, সাহিত্যে গ্রামের সঙ্গে বাঙালি জাতির, সংস্কৃতির নাড়ির একটি সম্পর্ক ধরা পড়ে। বাঙালি জাতি সুদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে বসেও গ্রামীণ সংস্কৃতির রোমন্থন, পূর্ণিমা রাতে নদীর জলের পাশে বসে পূর্ণচন্দ্র অবলোকন কিংবা শীতের ভোরে দিগন্তজোড়া সরিষা খেতের হলুদ ফুলের পাশে বসে এক গ্লাস খেজুরের রস খাওয়া খুব মিস করে। শহুরে সংস্কৃতির অতি ব্যস্ত জীবন আর গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনধারা এ দুই সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। অতীতে গ্রামীণ জীবনধারায় ছিল না কোনো প্রযুক্তির ছোঁয়া। শুধু সিনেমাহলে সিনেমা দেখার জন্যও গ্রামের লোকজন শহরে চলে যেত। এভাবে শহুরে সংস্কৃতি আর গ্রামীণ সংস্কৃতির মাঝে একটা বিশাল পার্থক্য সব সময় চোখে পড়ত। আবার শহুরে সংস্কৃতির যে আবহ গত কয়েক দশক আগেও বর্তমান ছিল, দুয়েক দশকে সেই ধারাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি শহুরে জীবনে নিয়ে এসেছে অবিশ্বাস্য গতি। গ্রামীণ জীবন বা সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের যে নাড়ির টান বা শিকড়ের যোগসূত্র সেই ধারা থেকে শহুরে মানুষের জীবন হয়েছে বিচ্যুত।

শিল্পপ্রযুক্তি গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেকখানিই অবলুপ্ত করেছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি সেই অবলুপ্তিকে অনেকটাই ত্বরান্বিত করেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবন, সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। মানুষের জীবন সহজসাধ্য করেছে। ধান কাটার সময় গাওয়া গান, গৃহস্থের বাড়িতে সে সময় উৎসবের মতো ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ, শুকানো, লাইন ধরে গরুর গাড়িতে করে ধানের আঁটি নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। নানা রকম শিল্পপ্রযুক্তি সেসব স্থান দখল করে মানুষের কষ্টের জীবনে প্রশস্তি নিয়ে এসেছে। অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার সময় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে নানি বা দাদিবাড়িতে হইহই করে পিঠাপুলি খেতে যাওয়ার আনন্দও এখনকার শিশুদের কাছে অধরা। তাদের কাছে পিঠাপুলির চেয়ে অনেক বেশি লোভনীয় স্মার্ট ফোনে নতুন একটা গেম ডাউনলোড করে খেলা।

বাঙালি সংস্কৃতির খাবারের যে সমৃদ্ধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা থেকে সরে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম বেশি ঝুঁকে পড়েছে ভিনদেশি খাবারের স্বাদে। ভার্চুয়াল অর্ডারেই ম্যাজিকের মতো এক নিমিষে বাড়ির দরজায় টোকা দেয় চাইনিজ, ইটালিয়ান, থাই, ফাস্টফুডসহ ভিনদেশি খাবারের পার্সেল। তাই শ্রমসাধ্য পিঠাপুলি বানানো, ঢেঁকিতে চাল কোটা, চাল কুটতে কুটতে গ্রামীণ নারীদের নানারকম গল্পে মেতে ওঠা, রাত জেগে হারিকেনের আলোয় পিঠা বানানোর চর্চা এখনকার প্রজন্মের শিশুদের কাছে আরেক রূপকথা। তার চেয়ে বরং স্মার্ট ফোনের বাটনে স্পর্শ করে বার্গার, পিৎজা, চিকেন ফ্রাইসহ হালের নানারকম খাবার হাতে পাওয়া অনেক সহজ। তাই সেসব পিঠাপুলির উৎসব এখন কিছু সংগঠনকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। শহুরে কিছু সংগঠন পিঠাপুলি উৎসবের আয়োজন করে আর বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই উৎসবের বিভিন্ন পিঠার নাম জানতে পারা যায়। সেই পিঠার সঙ্গে নানা বয়সি মানুষের সেলফি দেখা যায়।

ঠিক একইভাবে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গৌরবগাথাও এ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কাছে অনেকটা পোশাককেন্দ্রিকতায় পরিণত হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার দিনটি, বাংলাদেশের বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তথা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বা মহান শহিদ দিবস এসবকিছুই বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। এ দিনগুলোকে ঘিরে নানা আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ হওয়া উচিত এ দিবসগুলোর তাৎপর্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে একনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা। আমাদের গৌরবগাথাকে মহিমামণ্ডিতভাবে এমনভাবে তুলে ধরা যেন তারা উন্নত মস্তকে নিজ দেশের এ বীরত্বগাথা নিয়ে নিজে বাংলাদেশি বলে গর্ববোধ করে এবং কাল থেকে কালান্তরে ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে যায়। বর্তমান সময়ে এসব দিবসকে কেন্দ্র করে ফ্যাশন হাউজগুলোর তৎপরতায় এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয়, যেন বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা নানা রঙের, নানা নকশার পোশাকের মধ্যে আটকে আছে। আর এসব দিবসে কোন শপথগ্রহণ তো দূরে থাক, জাতীয় শহিদ মিনারে একই রঙের, ডিজাইনের কাপড়ে পরিবারের সবাই আচ্ছাদিত হয়ে ভুভুজেলা বাজিয়ে মানুষের ঢল যখন উপচে পড়ে ফুচকা-চটপটি খাওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত হন, তখন সব শহিদের প্রাণ দেওয়া যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে যখন বর্তমান প্রজন্ম শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি কী বা কেন, ভাষা শহিদ সম্পর্কে বা তাদের নাম বলতেও অপারগতা প্রকাশ করে তখন শহিদ দিবস বা এর তাৎপর্য, বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেবে কে এবং কীভাবে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

একইভাবে যত দিন গড়াচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতির ইতিহাস, তার মাহাত্ম্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়া, সে সম্পর্কে জানাশোনার গণ্ডি ফিকে হয়ে আসছে। বই পড়া বা বই পড়ার প্রতি আগ্রহও অনেক কমে এসেছে। দুয়েক দশক আগের শিশু-কিশোররাও পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ত যাতে অভিভাবক বা শিক্ষকরা পাঠবই পড়ছে না বলে শাসন না করেন। কিন্তু গত এক দশকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিশু-কিশোরদের জোর করেও গল্পের বইমুখী করা যাচ্ছে না। শুধুু পাঠ্যবই নয়, নিজের ভেতরের জ্ঞানের জানালা খুলে দেওয়ার জন্য যে পাঠ্যবইয়ের বাইরে হাজারো বই পড়ে নতুন প্রজন্ম নিজেদের উন্নত করবে সেই চর্চাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। বই পড়ে নিজের মনের ভেতর কল্পনার যে জগৎ তৈরি করা যায় সে বিষয়েই তারা কিছু জানে না। বরং চোখের সামনে রকমারি, রঙিন, চলমান নানা রকম কার্টুন চরিত্র দেখতেই বেশি অভ্যস্ত। তারা সেই কার্টুন চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করে নেয় এবং তাদের সেই ভিনদেশি ভাষাতেই কথা বলে। মাতৃভাষা বাংলা শেখাতেও তাদের অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। বাংলা বলতে না পারাটাই এ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিন্ন ভাষা শিক্ষা মোটেও দোষের কিছু নয় কিন্তু সবার প্রথমে শুদ্ধ বাংলা শিক্ষা জরুরি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন তার ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে বলেছেন,‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’। নিজের ভাষায় যোগাযোগ করতে না পারা মানে নিজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা। গোলাম মুরশিদ তার ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইয়ে বলেছেন, ‘আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও বাঙালি সংস্কৃতি বলে যা পরিচিত হয়েছে, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো : তা ভাষানির্ভর। হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ঘটী-বাঙাল, গ্রামীণ-নাগরিক ইত্যাদি নানা বিভাগ সত্ত্বেও যে-সুতো দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি একই মালায় গাঁথা, তা হলো বাংলা ভাষা। এই ভাষা দিয়েই বাংলার বিভক্ত সমাজের সকল মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত। এই ভাষিক পরিচয় কেড়ে নিলে এ সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই লুপ্ত হয়’।

দুঃখের বিষয় হলো, ধীরে ধীরে বাঙালি এ পথেই হাঁটছে, যে পথে বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অবলুপ্ত হয়। এক কথায় মনের যে জানালা শিশুদের সামনে অভিভাবকদের খুলে দেওয়া প্রয়োজন, ইতিহাস, সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটানো প্রয়োজন সেই চর্চা থেকে দিনদিন সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। কর্মব্যস্ততা মানুষকে এত বেশি নাভিশ্বাসের মধ্যে রেখেছে যে, মানুষের দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে এসেছে, মানুষের কাছে সময় বড্ড কম। পরিবার থেকে পরিবারে, পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমও হয়ে উঠেছে শুধুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তৈরি হয়েছে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম। পরিবারের সদস্যরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক কক্ষ থেকে পাশের কক্ষে কারও সঙ্গে কথা বলার জন্যও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। মানুষ দিন দিন শর্টকাট পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ভালো বই পড়ে জ্ঞানার্জন করার বিষয়টি মানুষের কাছে শ্রমসাধ্য মনে হচ্ছে। তার চেয়ে কোনো প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে সেই বিষয়টি জেনে নেওয়াই ভালো উপায় হিসাবে ধরা দিচ্ছে। খুব কম সময়ে জনপ্রিয় হওয়ার একটি প্রবণতা মানুষের মাঝে কাজ করছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার নানা রকম কৌশল ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা লাভের পদ্ধতি মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়ায় রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া এক শ্রেণির মানুষের কাছে বেশি লোভনীয় হয়ে উঠছে। ‘টিকটক স্টার’ হওয়া এত বেশি জনপ্রিয় যে এ জন্য তারা অপরাধ করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। টিকটক করে স্টার বানিয়ে দেওয়া, জনপ্রিয়তা পাইয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ করে হতদরিদ্র এবং গ্রামের নারীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তাকে ধর্ষণ, খুন করে ফেলার ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে অহরহই চোখে পড়ে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতদরিদ্র বাংলাদেশি তরুণীকে ‘টিকটক হৃদয়’ বিয়ের কথা বলে সম্পর্ক তৈরি করে ভারতে নিয়ে গিয়ে তাকে নির্যাতনের ঘটনা সবারই জানা। সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের সদস্য হৃদয়সহ অন্য সহযোগীরা অল্প বয়সি মেয়েদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে চাকরির প্রলোভন বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে যৌন পেশায় যুক্ত করে। পরে এ চক্রের সদস্যদের সাজা দেয় ভারতের আদালত। গত ২২ মে ২০২২ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ অনলাইনে এ রকম একটি খবর প্রকাশিত হয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনা যেগুলো অনেক সময় গণমাধ্যমে প্রকাশের আড়ালে থেকে যায়, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ধর্ষণ, নির্যাতনকে বৈধতা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের অভিভাবকদের অলক্ষে এসব ঘটনা ঘটে। মূলত পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা এসব অপরাধকে উৎসাহিত করে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্রতার অভাব, বাঙালি জাতির ইতিহাস সম্পর্কে না জানা, আত্মকেন্দ্রিকতা, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব, সঠিক যোগাযোগের অভাব, ইতিহাস-সংস্কৃতি-বাঙালি সত্তার সঙ্গে আত্মিক বন্ধন তৈরি না করাই এসব অপরাধে এক শ্রেণির তরুণ-তরুণীকে উৎসাহিত করছে যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

সারাক্ষণ স্মার্ট ফোনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকাই এক শ্রেণির মানুষের বর্তমান সময়ের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। স্মার্ট ফোন থেকে মাথা তুলে ওপরের আকাশ, মেঘ, বর্ণিল পাখি, গাছপালা, প্রকৃতি দেখা, প্রকৃতিতে উপভোগ, ধারণ, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিকতা অনুভব করা এসব এদের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে। নদীতে নানা রঙের পাল তোলা নৌকায় ভেসে যেতে যেতে মাঝিদের কণ্ঠে ভাটিয়ালি, ভাওইয়া গানের সুরে বিমোহিত হয়ে যাওয়াও এখন কল্প জগতের মতো। একতারা-দোতারা বাজিয়ে পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওইয়া, কীর্তন, গম্ভীরাসহ নানা রকম লোকজ গানের শিল্পী খুঁজে পাওয়া এখন দুষ্কর। এসব গান ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সংগীত, নৃত্য, পথনাটক এসব শিল্পও ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষ দিন দিন মেধাহীন সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা থেকেও এরা অনেক দূরে সরে এসেছে। পারিবারিক মেলবন্ধন, নিজের দেশের জন্য, সংস্কৃতির জন্য আত্মিক টান অনুভব হয়তো আছে কিন্তু সে সবের চর্চা নেই। দেশকে ভালোবেসে, সংস্কৃতিকে ভালোবেসে তার চর্চা করার অভ্যাস থেকে মানুষ এখন অনেক দূরে। যেন পঙ্গপালের মতো সবাই কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে মানুষ শুধুই ছুটছে। পরিবার, সংস্কৃতি, দেশ কোনো দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসত নেই মানুষের। তাই বাঙালির বিভিন্ন উৎসব, পালার চেয়ে হ্যালোইন উৎসব অনেক বেশি সাড়া জাগায় মানুষের মধ্যে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় বাঙালি সম্পর্কে লিখেছেন,‘ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ-মানা এ প্রাণ/ বোতাম-আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান। দেখা হলেই মিষ্ট অতি, অলস দেহ ক্লিষ্টগতি-গৃহের প্রতি টান।’ গৃহের প্রতি টান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ করা যায় প্রতিবছর ঈদের সময়। ঈদ এলে শহুরে মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে চেপে গ্রামের পানে ছুটে চলাও সংস্কৃতির ধারায় যুক্ত হয়েছে। এর কারণও সারা বছরের বিচ্ছিন্নতার ফসল। একেবারে পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে সারা বছর ধরে প্রত্যক্ষ যোগাযোগহীনতা সেই তিন দিনের ছুটির সময় এসে উদ্গিরণ হয় আর মানুষ যেভাবে হোক, মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও ট্রেনের ছাদে, বাসের হাতলে ঝুলে যাত্রা শুরু করে। আবার ঠিক তিন দিন পর একইভাবে শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। আবার নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো ঘটনাও কম নয়। মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব, মানসিক দূরত্ব, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির মাত্রা, চর্চা, একে অপরকে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা একে অপরের প্রতি অসহিষ্ণু করে তুলছে। আর এখানেই নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ভ্যাকুয়াম তৈরি হচ্ছে।

একটা প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতি পিছিয়ে যাচ্ছে। বই পড়ার চর্চা না থাকা, সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব, দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত না হওয়া অপসংস্কৃতির সৃষ্টি করছে। যার বড় একটি উদাহরণ ‘কিশোর গ্যাং’। শুধু বইয়ের পাতায় মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা দিবস, বাঙালি জাতির ইতিহাস থাকলেই হবে না, সেটা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। বই পড়ায়, সুস্থ মানসিক বিকাশের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। না হলে অচিরেই দেশে একটি মেধাশূন্য জাতির উদ্ভব হবে।

বিখ্যাত যোগাযোগ বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ডি ল্যাসওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী যোগাযোগের প্রাথমিক তিনটি কাজের মধ্যে একটি হলো তথ্যের সাংস্কৃতিক প্রবাহমানতা অথবা সামাজিকীকরণ। সব সংস্কৃতিরই কিছু ধারা থাকে। একেকটি সংস্কৃতি বিবর্তনের একেকটি ধারা তৈরি করে। হাজার বছর ধরে একেকটি দেশে, সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রকম জ্ঞান, বিজ্ঞান, ভাব, ধারণা, রীতি সংমিশ্রিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতির ধারা বয়ে চলেছে। এ পুঞ্জীভূত সংস্কৃতির ভান্ডার, তথ্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও যোগাযোগ তথা গণমাধ্যমের। ল্যাসওয়েলের মতে, গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে জনমানুষের মতামত তৈরি, আচরণ নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষাগুরুর দায়িত্ব পালন করতে পারে। সমাজে যে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষ আছে সেসব মানুষের মতবিনিময়ের স্থান তৈরি করে দেয় গণমাধ্যম। সমাজের একেকটি ধারার মধ্যে সম্মিলন ঘটানোর, নানা ধরনের সংস্কৃতির সে াত একটি ধারায় নিয়ে আসার কাজটি গণমাধ্যম করতে পারে। যেমন, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতের ধারায় নিয়ে আসার কাজটি করতে পারে গণমাধ্যম। এতে করে সামাজিক বিচ্যুতির আশঙ্কা কমে যায়। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। সমাজের বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের, অংশের যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে, বিভিন্ন বিভাজন রয়েছে তা যেন দ্বন্দে পরিণত না হয়, সে জন্য পরস্পরের প্রতি এক ধরনের সমঝোতার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমকে শুধু শহুরে সংস্কৃতি, ভিনদেশি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা না করে দেশীয় সংস্কৃতি, দেশের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতে হবে। এভাবেই গণমাধ্যম সাংস্কৃতিক প্রবাহমানতার, তথ্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতে পারবে। সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রগুলো শুধু শহরকেন্দ্রিক না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও গণমাধ্যমের করতে হবে। যেমন, অমর একুশে বইমেলা শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে নতুন প্রজন্মও বই কিনতে, বই পড়তে উৎসাহী হবে। সর্বোপরি সংস্কৃতির প্রবাহমানতায় গণমাধ্যম, পরিবার, রাষ্ট্র প্রত্যেকের নিজস্ব দায়িত্ববোধের জায়গা রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রয়েছে এ দেশকে সঠিক পথে বয়ে নিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায়, নিজস্ব স্বকীয়তায়, সংস্কৃতিতে গড়ে তোলার দায়িত্ব সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ও পরিবারের। প্রত্যেককে নিজস্ব দায়িত্বের জায়গায় সচেতন হতে হবে, তাহলেই বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য নিজস্ব ধারায় বিকশিত হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম