Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

বাঙালির সুগন্ধি চর্চা

Icon

সাইফুর রহমান

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতের পর ইংরেজ অনুরাগীদের অনেকেই বন্যার জলের মতো বিত্ত-বৈবভের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে কলকাতার শোভাবাজারে পাশাপাশি দু’জন প্রতিবেশী ছিলেন। একজন রাজা নবকৃষ্ণদেব। অন্যজন চুড়ামনি দত্ত। দেব আর দত্তদের মধ্যে তখন চলছে তুমুল লড়াই, কে বড় আর কে ছোট এই নিয়ে। রাজা নবকৃষ্ণদেবের আরেকটি কীর্তি হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ঠিক সে বছরই, অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে তিনি চোখ ধাঁধানো এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে কলকাতায় দুর্গা পূজা উৎসবের গোড়াপত্তন করেছিলেন।

নবকৃষ্ণ তার মায়ের উৎসাহে ইংরেজি, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন সুচারুরূপে। এর ফলে প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক নিযুক্ত হলেন নবকৃষ্ণ। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধিবলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদ লাভ করলেন। লর্ড ক্লাইভ তখন কোম্পানির প্রভাবশালী ব্যক্তি। নবকৃষ্ণ ক্রমেই তার কাছের লোক হয়ে উঠলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরোধে রাজা রাজবল্লভ, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, মীরজাফর, জগত শেঠদের সঙ্গে নবকৃষ্ণও কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর সিরাজের বিশাল টাকা ও সম্পত্তির একটি ভাগও পেয়েছিলেন তিনি।

তো হয়েছে কি সেই নবকৃষ্ণদেব কিংবা চুড়ামনি দত্তরা এতটাই ধনী হয়েছিলেন, তারা কীভাবে যে তাদের অর্থ খরচ করবেন সে বিষয়ে প্রায়ই দিশা পেতেন না। সে সময়কালেরই একটি ঘটনা- একদিন এক ব্রাহ্মণের ছেলের কানে পুঁজ জমেছে। ছেলেকে নিয়ে ব্রাহ্মণ ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সাহেব সব শুনে-বুঝে বললেন, এই রোগের মোক্ষম ওষুধ হচ্ছে পচা আতর।

গরিব বামুন আঁতকে উঠলেন- পচা আতর!! তা পচা আতর আমি কোথায় পাব ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার বেচারাই আতরের সন্ধান বাতলে দিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণকে। ডাক্তারের পরামর্শমতো বামুন গিয়ে হাজির রাজা নবকৃষ্ণদেবের দুয়ারে। কী চাই, জিজ্ঞেস করলেন নবকৃষ্ণের ছেলে গোপীমহনদেব। বামুন কাচুমাচু কণ্ঠে বললেন- আজ্ঞে আমার ছেলের কানে পুঁজ জমেছে একটু পচা আতর প্রয়োজন। গোপীমহন তো রেগে আগুন। আমরা কি পচা আতরের আড়ৎ খুলে বসেছি। পচা আতর চাই তো পাশেই চুড়ামনি দত্তের বাড়ি সেখানে চলে যাও। আর শোন তোমার ওই ছোট পাথর বাটি দেখে চুড়ামনি দত্ত হয়তো রেগে যাবেন। একটি কলসি নিয়ে যেও। বামুন এবার চুড়ামনি দুয়ারে গিয়ে হাঁক ছাড়লেন। চুড়ামনি দত্ত বললেন, কি চাই। আজ্ঞে একটু আতর। চুড়ামনির দত্ত বললেন, পাত্র এনেছ। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই যে কলসি। কলসি দেখেই চুড়ামনি সব বুঝতে পারলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আতরওয়ালাকে ডেকে বললেন, এই কলসিখানা ভরতে কত টাকার আতর লাগবে। আড়াই হাজার টাকার মতো দাত কেলিয়ে বলল আতরওয়ালা। তাহলে এক্ষুণি এক কলসি আতর দিয়ে দাও এই বামুনকে। চুড়ামনি দত্ত বামুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যাও এবার ওদের দেখিয়ে এসো। আর শোন গোপীমহন ছোট মানুষ ওকে দেখিয়ে কোন লাভ নেই তুমি বরং নবকৃষ্ণকে দেখাবে। বামুনও কলসি ভর্তি আতর নিয়ে হাজির নবকৃষ্ণের বাড়িতে। গোপীমহন আর নবকৃষ্ণ দু’জনেই তখন লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে কথা জানাতে বামুন আবার ফিরে এলেন চুড়ামনি দত্তের বাড়িতে। বললেনও সে কথা। চুড়ামনি বামুনকে বললেন, এক কলসি আতর নিয়ে তুমি কি করবে। বরঞ্চ তোমাকে আমি আড়াই হাজার টাকা দিচ্ছি আতরের কলসিটা আমাকেই দিয়ে যাও। আর অল্প একটু আতর তোমার ওই বাটিতে নিয়ে যাও। চুড়ামনির মোট খরচ হয়ে গেল পাঁচ হাজার টাকা। তাতে কি? আতরের লড়াইয়ে তো জিত হল তার। নব-র মাথাটা তো নিচু করা গেল! এই বা কম কি! সে সময় কলকাতার বাবুরা যে শুধু কলস কলস আতর ঘরে মজুদ রাখতেন তাই নয়। সমস্ত ঘরদোর, বাড়ির দেয়াল, মেঝে, বারান্দা সব ধোয়া-মোছা হতো আতর দিয়ে। সেকালের কলকাতার বিখ্যাত ধনী নিমাইচরণ মল্লিকের পৌত্রের বিয়ের সময় চিৎপুর রোডের দু’মাইল পথে গোলাপজল ছড়ানো হয়েছিল। বিয়ের শোভাযাত্রাতে পথের ধুলো আর দুর্গন্ধে যাতে বিঘ্ন না ঘটে। সেকালের ধনী বাঙালিবাবুর বনেদিয়ানা বজায় রাখতেও সুগন্ধের বড় একটা ভূমিকা ছিল। বার মহলে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো গোলাপ পাশ থেকে গোলাপজল ছিটিয়ে। এছাড়া আসরে সাজিয়ে রাখা হতো আতরদান। তুলোয় মোড়া ছোট্ট ছোট্ট কাঠি। অতিথিরা আতরদান থেকে তুলোয় মাখিয়ে তুলে নিতেন মনপছন্দ আতর, খস, চামেলি, বেলি।

উপরোক্ত ইতিহাস থেকে অনেকের মনে হতে পারে। সহস্র বছর ধরেই হয়তো ভারতবর্ষের এই ভূ-খণ্ডে সুগন্ধির চর্চা ও ব্যবহার হয়ে আসছে। আসলে মোটেও সেরকম কিছু নয়। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও তিন-চার হাজার বছর আগে যেখানে মিসর ও মেসোপটেমিয়ার রীতিমতো সুগন্ধের জয়জয়কার সেখানে ভারতবর্ষে সুগন্ধির ব্যবহার শুরু হয় আরবদের হাত ধরে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সুগন্ধির ইংরেজি শব্দ হল- Perfume এই শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Perfumare থেকে। বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ধোঁয়ার মাধ্যমে’। অর্থাৎ ধোঁয়ার মাধ্যমে যে সুগন্ধ ছড়ানো হয় তাকে পারফিউম বলে। বর্তমানে পারফিউম বলতে যা দেখি বা বুঝি তা হচ্ছে সুদৃশ্য বোতলের ভেতর তেলজাতীয় এক প্রকার পদার্থ যা স্প্রে করে শরীরে কিংবা পোশাকে ছিটানো হয়। কিন্তু পাঠকবৃন্দের একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত হবে, সুদৃশ্য বোতলে সুগন্ধির ব্যবহার হচ্ছে তিন হাজার বছর ধরে চলমান একটা সংস্কৃতির সবচেয়ে উৎকর্ষিত রূপ। তিন-চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সুগন্ধি সাধারণত ব্যবহার হতো ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং সেটা প্রধানত ব্যবহার হতো উপাসনালয়ে, রাজপরিবার, রাজআমাত্য ও সমাজের উচ্চকোটির মানুষের মধ্যে। উপাসনালয়গুলোতে দেবতাদের সামনে প্রার্থনারত মানুষের ও দেবতাদের সঙ্গে সেতু তৈরি করত এ সুগন্ধিযুক্ত ধোঁয়া। সহস্র বছরের পুরনো এ সংস্কৃতি কিন্তু এখনও চালু আছে। এখনও আমরা মিলাদ কিংবা ধর্মীয় মাহফিলে আগরবাতি জ্বালিয়ে চারপাশ সুগন্ধময় করে তুলি। তাছাড়া সে সময় দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদন করতে হতো দামি কোনো বস্তু যেমন- সোনা, রুপা কিংবা কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মানুষের শিরশ্ছেদ। বেশিরভাগ মানুষই একাধারে ধর্মপ্রাণ ও বুদ্ধিমান এজন্য সোনা, রুপা কিংবা মানুষের মুণ্ডুর পরিবর্তে ধর্মভীরু মানুষ বেছে নিয়েছিল সুগন্ধি বস্তু। এতে করে একই সঙ্গে অর্থের কৃচ্ছতা সাধন ও ধর্মকৃত্য দুটোই সম্পন্ন হতো।

মিসরীয় ফারাও রাজারা যে কী পরিমাণ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন তার একটি জাজ্বল্যমান প্রমাণ মেলে ফারাও রাজা তুতানখামুনের মমি আবিষ্কারের সময়। তুতানখামুন জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ অব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার পিরামিডের ভেতর যখন তুতানখামুনের সমাধিস্থল আবিষ্কার করেন তখন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সোনা, রুপা, হীরে, জহরতসহ পাওয়া যায় অনেক মূল্যবান বস্তু। তবে লোকজন সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হোন এটা দেখে যে, তখনও তীব্র ও ঝাঁঝালো সুগন্ধ বের হচ্ছিল মমিটির শরীর থেকে। চিন্তা করেই অবাক হতে হয় কী পরিমাণ অমূল্য ও ব্যতিক্রমী সুগন্ধি ঢালা হয়েছিল মমিটার শরীরে, যে তিন হাজার বছর পরও এর সৌরভ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। ফারাও যুগে সুগন্ধি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো মোমের মাধ্যমে। সুগন্ধি ফুল, লতাপাতার নির্যাস মোমের মধ্যে মিশিয়ে তা শরীরে মাখা হতো। পিরামিডে আঁকা চিত্র দেখে ধারণা করা যায় যে ফারাও রাজা-রাণীরা এক ধরনের মোম মাথায় সেঁটে রাখতেন। প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপে মোম গলে পুরো শরীরের কোষে কোষে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে দিত। তবে ফারাও রাজরাণীদের মধ্যে কুইন ক্লিওপেট্রা বোধ করি ছিলেন খোশবাইয়ের সবচেয়ে বড় সমঝদার। তিনি তার ব্যক্তিগত সৌগন্ধিকদের নির্দেশ দেন একেক সময় একেক রকম সুগন্ধি তৈরি না করে উৎকৃষ্ট ধরনের একটি নির্দিষ্ট সেন্ট পুনরায় তৈরি করতে।

সুগন্ধি প্রস্তুতকারকরা এ প্রথম নির্দিষ্ট ফরমুলার মাধ্যমে ক্লিওপেট্রার জন্য একটি সেন্ট তৈরি করে দেন যার নাম ছিল ‘কিফি’। সুগন্ধির ইতিহাসে কিফি-ই হচ্ছে পারফিউমের প্রথম ব্র্যান্ড। ক্লিওপেট্রা যে শুধু পারফিউমের ভক্ত ছিলেন তা-ই নয়, পারফিউমের ব্যবসায়ও নেমেছিলেন তিনি। খুলেছিলেন পারফিউমের কারখানা। তবে সেকালে তার খদ্দের কে ছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। মিসরের পাশাপাশি গ্রিক রোমান ও পারস্যেও সুগন্ধি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। রোমান সম্রাট নিরো (৩৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন মুক্ত হস্তে। সম্রাটের হিসাবপত্রের খাতা ঘেঁটে দেখা যায় শুধু একদিনে সুগন্ধির পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন লক্ষাধিক টাকা। আমার বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটিতে হাজার দশেকের মতো বই থাকলেও সুগন্ধির ওপর কোন বই নেই। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সুগন্ধির ভিষণ অনুরাগি। এ বিষয়ে লেখার জন্য গত তিন বছর ধরে নোট নিচ্ছিলাম।

সুগন্ধির উপর যখন যা তথ্য পেয়েছি টুকে রেখেছি নোট বইয়ে। এই তো মাস তিনেক আগে আলেকজান্ডারের উপর একটি বই পড়েছিলাম সেখানে পেলাম মজার একটি তথ্য। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে যখন পারস্যের রাজা তৃতীয় ডারিয়ুসকে হারিয়ে প্রথম রাজদরবারে এসে পা রাখলেন তখন তিনি পারস্য সম্রাটের অনেক কিছু দেখেই অভিভূত হয়েছিলেন। বিশেষ করে জাকালো রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদে পরীর মতো অজস্র সুন্দরী নারী। ডারিয়ুসের সিংহাসনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ভাস্কর্য। এছাড়া বিবিধ জেল্লা জৌলুস তো ছিলই। কিন্তু আলেকজান্ডার সবচেয়ে বেশি অভিভূত হোন প্রাসাদের ভেতর ঐশ্বরিক এক সুগন্ধির সন্ধান পেয়ে। যোজনগন্ধা প্রাসাদটি সুগন্ধে যেন মঁ মঁ করছিল। তিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পূর্তি করেন জোরে জোরে শ্বাস টেনে। তারপর এক সতীর্থ সমর নায়ককে উদ্দেশ্য করে বলেন- একেই বলে যথার্থ এক মহান রাজা ও তার সম্রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন সুগন্ধির কোনো এক মহান স্বর্গে তৈরি করা হয়েছে এই রাজপ্রাসাদ।

এবার ভারতবর্ষে সুগন্ধিচর্চা প্রসঙ্গে আসা যাক। যদিও হিন্দু আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ সশ্রুত ও চারাক সহিংতায় আতরের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু ভারতের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য কিংবা ধারাবাহিকভাবে যেসব পর্যটকরা এই ভারত ভূখণ্ডে এসেছিলেন তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় জোরালোভাবে সুগন্ধির চর্চা এদেশে আরবদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত শুরু হয়নি। বিখ্যাত পর্যটক আলবেরুনী ভারতীয়দের প্রসাধন চর্চা প্রসঙ্গে লিখেছেন- উৎসবের দিনে তারা তাদের দেহে সুগন্ধির বদলে গোবর লেপে। মেয়েদের সাজ-পোশাকের জিনিস পুরুষরা পরে। তারা তাদের শরীরের কোনো চুল কাটে না। আসলে, গরমের প্রভাব থেকে তারা নগ্নভাবে চলাফেরা করে। আর মাথার চুল না কাটার মূল কারণ হল সর্দি-গর্মির কবল থেকে আত্মরক্ষা করা। এক গুচ্ছের আকারে তারা তাদের গোঁফ রাখে। নখ না কেটে তারা তাদের কুড়েমিকে মহিমান্বিত করে। এ দেশিরা একের পর এক, একা একা ভোজন করে। গোবরের প্রলেপ দেয়া স্থানে তারা একাজ সমাধান করে। (আলবেরুনী-প্রেমময় দাশগুপ্ত কর্তৃক অনুদিত, পৃষ্ঠা- ৫০ ও ৫১)। আলবেরুনী ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক তার প্রণীত ভারততত্ত্ব গ্রন্থটি ইতিহাসের আলোকে বেশ প্রণিধানযোগ্য।

অন্যদিকে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন- “সধবা নারীরা কপালে পরিতেন কাজলের টিপ এবং সীমন্তে সিঁদুরের রেখা; পায়ে পরিতেন লাক্ষারস অলক্তক, ঠোঁটে সিঁদুর; দেহ ও মুখমণ্ডল প্রসাধনে ব্যবহার করিতেন চন্দনের গুঁড়া ও চন্দনপঙ্ক, মৃগনাভী, জাফরান প্রভৃতি। বাৎস্যায়ন বলিতেছেন, গৌড়ীয় পুরুষরা হস্তশোভা ও চিত্তগ্রাহী লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং সেই নখে রং লাগাইতেন, বোধ হয় যুবতীদের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীরা নখে রং লাগাইতেন কিনা, এ বিষয় কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা- ৪৬০)।

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার ‘প্রাচীন ভারতীয় সমাজ’ বইটিতে বাঙালির সুগন্ধি চর্চা বলতে শুধু চন্দনের ব্যবহারের কথাই বলেছেন। আর লিখেছেন- নেপালের মেয়েরা গ্রীষ্মকালে মুখে কস্তুরি চুর্ণ ব্যবহার করত। আরবদের হাত ধরেই ভারতবর্ষে সুগন্ধি চর্চার বিস্তার লাভ করে। একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, ইসলামে সুগন্ধি চর্চার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজে সুগন্ধি পছন্দ করতেন। নামাজে যাওয়ার আগে তিনি শরীরে সুগন্ধি লাগাতেন বিশেষ করে শুক্রবার জুমা-মোবারকে তিনি বিশেষ বিশেষ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তার প্রিয় সুগন্ধি ছিল মাস্ক ও আম্বার। পরবর্তীতে মোগল আমলে সুগন্ধ চর্চার বিস্তার বেশ ব্যাপকভাবে ঘটে। বিশেষ করে মোগল সম্রাটরা সাধারণত পারস্য সম্রাটদের আদব, কায়দা, কেতা, স্বভাব ও ফ্যাশন অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। সে কারণে গোলাপ ও সৌরভের দেশ পারস্য থেকে আসত তাদের জন্য উৎকৃষ্ট আতর ও সুগন্ধি। এখানে বিশেষভাবে বলতে হয় আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক জ্যোর্তিবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও গণিতবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) পরিপূর্ণ ও স্বার্থক পারফিউম আবিষ্কার করেন। তাকেই বলা যায় আধুনিক অর্থাৎ আমরা যে ধরনের পারফিউম বর্তমানে ব্যবহার করি তার জন্মদাতা।

সম্রাট বাবরের ছিল গোলাপের প্রতি আসক্তি এজন্য ইরান থেকে তার জন্য আসত সহস্র বোতল ভর্তি হরেক রকমের গোলাপের নির্যাস। বাবর ইরানের ইস্পাহান ও ইরাকের বসরা থেকে উৎকৃষ্ট প্রজাতির গোলাপ এনেছিলেন তার বাগানের জন্য। এই গোলাপের সম্মানে ভারতের কিছু গোলাপ এখনও বসরাই গোলাপ নামে পরিচিত। মোগল যুগে সুগন্ধি চর্চার সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তার পত্নী সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সময়ে। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার ঘোড়ার লেজেও নাকি মেখে দিতেন নানারকম সুগন্ধি, যাতে করে চলার পথের আকাশ-বাতাস ছেয়ে যায় সুগন্ধের সৌরভে। সৌন্দর্য চর্চায় নূরজাহানের সবচেয়ে খ্যাতিমান আবিষ্কার গোলাপের আতর, যার পোশাকি নাম ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’। তবে আতর তৈরির আরেকটি প্রাচীন স্থান হল ভারতের মুর্শিদাবাদ। মোগল আমল থেকে এখানকার আজগর হোসেনের তৈরি গোলাপি আতর ভুবন বিখ্যাত। নুরজাহানের বিশিষ্ট গোসলখানাটিও একটি গবেষণার বিষয়। বিলাসবহুল গোসলখানার চৌবাচ্চায় গোলাপ মিশ্রিত পানিতে তরলাকার ভাসমান পদার্থের মধ্যে গোলাপের নির্যাস ছড়িয়ে রাখা হতো। তার স্নানের পানিতে আতর, গোলাপ, চন্দন, রূপটান ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী মিশ্রিত থাকত।

সুকন্যা নামের এক গবেষক নূরজাহান শিরোনামের এক জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন : “নূরজাহান নিজে সুরভিত হতেন গোলাপ নির্যাসের স্নানে, যার দৈনিক খরচ পড়ত তৎকালীন তিন হাজার টাকা।” নূরজাহানের উদ্যোগে কাশ্মীরের বিশিষ্ট উদ্যান শালিমার, নিশাতবাগ প্রভৃতির স্থাপনা ঘটে।

পারস্য ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যখন সুগন্ধের সাগরে ভাসছে সেসবের অল্প কিছু ঢেউ হয়ত এসে পড়ছে ভারতবর্ষেও। অথচ সুগন্ধি ব্যবহারের দিক দিয়ে ইউরোপ তখনও ম্রিয়মাণ। ইউরোপে প্রথম সুগন্ধি ব্যবহার করার ইতিহাস রচিত হয় ১৩৭০ সালে হাঙ্গেরীয় রাণী এলিজাবেথ অব পোল্যান্ডের হাত ধরে। তিনি যে পারফিউমটি ব্যবহার করতেন সেটার নাম ‘হাঙ্গেরীয়ান ওয়াটার’। পারফিউমটি নাকি তৈরি করা হয়েছিল রোজমেরি ফুলের নির্যাস থেকে। এ তো গেল হাঙ্গেরির রাণীর কথা। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ (১৪৬০-১৫৫০) সুগন্ধির এতটাই ভক্ত ছিলেন যে উনি প্রসাদের বাইরে বেরুলে সে স্থানে আগে শ’খানেক বোতল পারফিউম স্প্রে করা হতো। তারপর রাণী নামতেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে। এবার ফরাসি দেশের সৌরভ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। ফ্রান্সে প্রথম সুগন্ধির প্রচলন করেন রাণী ক্যাথেরিন মেডেচি। ক্যাথেরিন মেডেচি

জন্মেছিল ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে, ইতালির বিখ্যাত মেডেচি পরিবারে। দ্বিতীয় লরেঞ্জো মেডেচি ছিলেন ক্যাথেরিনের পিতা। ক্যাথেরিন ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে কেতাদুরস্ত ও বহুগুণ সম্পন্না নারী। এমন কিছু নেই যে সে বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল না। তো সেই ক্যাথেরিনের বিয়ে হয় ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরির সঙ্গে। ক্যাথেরিন যখন রানী হয়ে ফ্রান্সে আসেন তখন তিনি তার ব্যক্তিগত সুগন্ধি প্রস্তুতকারকদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ফ্রান্সে। রাণী ক্যাথেরিন রাজা হেনরিকেও সুগন্ধি বিষয়ে সচেতন করে তোলেন। তিনিই প্যারিসে প্রথম পারফিউমের দোকান খোলেন। কথিত আছে যে তার ওই পারফিউমের দোকানের নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল যাতে করে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে যাতায়াত করা যায় তার ব্যক্তিগত পারফিউম প্রস্তুতকারকের বাসভবনে। সুগন্ধির উদ্ভাবিত নতুন নতুন ফর্মুলা যাতে ফাঁস না হয়ে যায় তার জন্যই এমন ব্যবস্থা। রাণী ক্যাথেরিন মেয়েদের মধ্যে প্রথম হ্যাট, দস্তানা অর্থাৎ হাত মোজা প্রভৃতির প্রচলন করেছিলেন। সেই দস্তানাতেও ব্যবহার হতো সুগন্ধি। ফ্রান্সে যথার্থ অর্থেই পারফিউম কিং ছিলেন রাজা চৌদ্দতম লুই (১৬৩৮-১৭১৫) তার কোর্টকে বলা হতো পারফিউম কোর্ট। রাজপ্রাসাদের সমস্ত পর্দা, সোফা, বেড কভার, দৃশ্যত সবকিছুতেই ঢালা হতো সুগন্ধি। তিনিই বোধকরি বিশ্বে একমাত্র রাজা যিনি প্রজাদের মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে সুগন্ধি ব্যবহার করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি নিজেও রোজ চার-পাঁচ বোতল পারফিউম নিজের শরীর ও পোশাকে ঢালতেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ বোধকরি তিনি জীবনে মাত্র তিন বার গোসল করেছিলেন। হ্যাঁ পাঠকবৃন্দ সত্যি তাই, বিশ্বাস না হয় তো ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে পারেন। একটা প্রচলিত কথা চালু আছে যে ফরাসিদেশের লোকেরা গোসল করে না বলেই সেখানে এত্তো এত্তো সুগন্ধির উদ্ভব। আমি যখন বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাই তখন আমার বেশকিছু ফরাসি বন্ধু-বান্ধবী জুটেছিল। আমি কিন্তু দেখেছি তাদের নিয়মিত স্নান করতে। কিন্তু তারপরও কেন এই অপবাদ? দীর্ঘদিন এ নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল। আমি কিছুতেই আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই তো কয়েকমাস আগে প্লেগ রোগের ওপর একটি বই পড়ছিলাম, সেখানে পেয়ে গেলাম আমার প্রশ্নের উত্তর। মধ্যযুগে একটা সময়ে ম্যালেরিয়া, প্লেগ, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শুধু প্লেগ রোগেই মারা পড়ে ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ জনগণ। তখন সবাই ধারণা করত যে পানির মাধ্যমেই হয়তো এসব রোগ ছড়ায়। আর এজন্যই পানি পরিহারের একটি প্রবণতা তৈরি হয়। সে সময়টায় ফ্রান্সের বেশিরভাগ লোকজনই বছরে সাধারণত একবারের বেশি গোসল করত না। একই সঙ্গে তখন মানুষ ধারণা করত যে কোনো একটি সুগন্ধি হয়তো এসব রোগ দূর করতে সক্ষম। শরীরের বিবিধ অসুখে ব্যবহার করা হতো সুগন্ধি মলম। মানুষ গলায় যে লকেট পরত তার বিভিন্ন খোপে খোপে থাকত সুগন্ধি। কোনো খোপে ল্যাভেন্ডার তো কোনোটায় রোজমেরি। আর এ কারণেই সে সময়ের পারফিউমের নামগুলোও হতো একটু অন্যরকম। যেমন- মধ্যযুগের একটি পারফিউমের নাম ‘টালিশমান’ কিংবা ‘প্রমেন্ডা’ প্রভৃতি। টালিশমান অর্থ হচ্ছে পরশপাথর। আর পরশপাথর অর্থ যে কি সেটা পাঠকমাত্রই হয়তো জানেন। এছাড়াও কীট-পতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ার, শ্বাপদ প্রভৃতি বিতাড়িত করতেও ব্যবহার হতো গাছ-গাছড়া, ফল ও ফুলের নির্যাসের ধোঁয়া। সুগন্ধি যে শুধু মানুষকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে তাই নয়। মাঝে মধ্যে মানুষের বিপদেরও কারণ হয়ে উঠতে দেখা যায় এই সুগন্ধি ব্যবহার। ফ্রান্সের রাজা অষ্টাদশ লুই ও রানি আতোঁয়ানেত দুজনেই ছিলেন সুগন্ধ অনুরাগি। বিশেষ করে রানি ছিলেন ভীষণ ভোগ বিলাসি। তার সুগন্ধি গুলো তৈরিতে খরচ হতো শত সহস্র মুদ্রা। ফরাসী বিপ্লবের সময় রানি আতোঁয়ানেত যখন পালাচ্ছিলেন। হয়তো বা তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষমও হতেন কিন্তু বাদ সাধলো শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধি। রানির শরীর থেকে এতো কড়া সুগন্ধ ভেসে আসছিলো যে বিপ্লবীরা সহজেই বুঝে ফেলে ঘোড়ার গাড়িতে নিশ্চয়ই রানিই যাচ্ছেন। তা না হলে এতো দামি সুগন্ধি এই মুলুকে আর কে বা ব্যবহার করতে পারে। এই বিষয়ে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। আমার বন্ধু ব্যারিস্টার মীর হেলাল বিলেত থেকে তখন সদ্য ব্যারিস্টারী পাশ করে দেশে ফিরেছে। তখন সম্ভবত রোজ অর্ধেক বোতল সেন্ট ও গায়ে মাখতো। যখনই সে তার চেম্বারে আসতো, লিফ্ট থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে আসতো সেন্টের সুন্দর গন্ধ। আর এতে চেম্বারের কর্মচারিরা বুঝে ফেলতো যে ব্যারিস্টার সাহেব চেম্বারে ঢুকছেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই সচেতন হয়ে কাজকর্মে মনোযোগি হয়ে উঠতো। এটা দেখে বেশ কৌতুক বোধ করতাম আমি। এখন অবশ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর ওর সুগন্ধির প্রতি অনুরাগ অনেক কমে গেছে। এখন সুগন্ধির স্থান দখল করে নিয়েছে জনগণ। প্রেম, ভালোবাসা ও যুদ্ধের সঙ্গে সুগন্ধির রয়েছে প্রগাঢ় সম্পর্ক। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধে যাওয়ার সময় দুটি জিনিস সবসময় সঙ্গে রাখতেন। প্রথমটি বই আর দ্বিতীয়টি হল সুগন্ধি। সুগন্ধির প্রতি ছিল তার অসম্ভব আসক্তি। রাজসুগন্ধ প্রস্তুতকারীদের কাছে প্রতি মাসে তার চাহিদা ছিল ৬০ বোতল সেন্ট। নেপোলিয়নের প্রিয় সুগন্ধি ছিল জেসমিন। অন্যদিকে বাংলার নবাব আলিবর্দি খানও না কি যুদ্ধে যেতেন পারস্যের বিভিন্ন সুগন্ধি সঙ্গে নিয়ে। এটা নাকি তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলত। সেই সঙ্গে যুদ্ধেও উৎসাহ জোগাত। আলিবর্দিখানের দৌহিত্র যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলারও সুগন্ধির প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। নিজে গায়ে মাখতেন হরেক রকমের দামি সুগন্ধি। বিভিন্ন পালা পার্বণে হীরা ঝিল প্রসাদের কোনো কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে পায়রা, কাকাতুয়া, টিয়া, ময়ূর বা অন্যান্য পাখি পারস্যের সুগন্ধির তরলে ভিজিয়ে উড়িয়ে দেয়া হতো হল ঘরে। আর এতে সুন্দর স্নিগ্ধ পারস্যের সৌরভে ছেয়ে যেত বাংলার যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলার স্বপ্নরঙে রাঙানো হীরা ঝিল প্রাসাদ।

সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসাও সুগন্ধি ভালোবাসতেন। ঋতুভেদে বিভিন্ন উৎসবে পারস্যের ফুল ও চন্দন ছিল লুৎফার প্রিয় প্রসাধন। সুগন্ধি অলঙ্কার পরা ছিল সে সময়ের ফ্যাশন। যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা হেঁটে গেলে সবাই বলতেন পদ্মগন্ধা। লুৎফার সাতনরী হার হাতে নিয়ে শুঁকে দেখত অনেকেই। আতর-চন্দনের গন্ধ লেগে থাকত সেই গহনায়। সুগন্ধে ভুরভুর করত চারপাশ। গ্রীষ্মের দহন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লুৎফুন্নিসা গোসল করতেন পারস্যের সুগন্ধি জলে। তারপর চন্দনচর্চিত দেহে, নানাবিধ দ্রব্যে প্রসাধন পরে নিজেকে সজ্জিত করতেন কুসুম আভরণে। লুৎফার নিজের ব্যবহৃত নানা সুগন্ধির মধ্যে চন্দন ও কস্তুরির নিজস্ব গন্ধ তো ছিলই। তাছাড়া তিনি জটামাংসী নামে এক প্রকার গাছের শেকড় দিয়ে তার পোশাককে সুগন্ধী করে নিতেন।

তবে বাঙালির সুগন্ধি চর্চার কথা বলতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির লোকজনদের সুগন্ধি ব্যবহারের কথা না বললেই নয়। সেকালে ঠাকুরবাড়ির সুগন্ধি চর্চার ইতিহাস অনেকটা কিংবদন্তিতূল্য বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জেঠাতো ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- আমাদের বাড়িতে পুজো না থাকলেও পুজোর আবহাওয়া এসে লাগত আমাদের বাড়িতে। পুজোর আগেই আসত চীনেম্যান-বার্নিশ করা নতুন জুতোর জন্য পায়ের মাপ নিতে। সব বাড়ির ছেলেরা মিলেই পায়ের মাপ দিতুম। তারপর আসত দরজি। তার নামটা ভুলে গেছি। যতদূর মনে পড়ে ‘আবদুল’। তার মাথায় গোল গম্বুজের মতো একটা মস্ত সাদা টুপি। গায়ে সামনে-বোতাম- দেওয়া দিব্যি ধবধবে সাদা চাপকান, মস্ত ভুঁড়ি। পিঠে কাপড়ের পুঁটলি। তার কাছে দিতে হতো সক্কলের জামার মাপ। পোশাকের পালা চুকে গেলে আসত গ্রিবেল সাহেব। ইহুদি সাহেব সে। টকটকে রং, গোঁফ-দাড়িতে জমকালো চেহারা। তার চেহারাটা হুবহু শাইলকের ছবি। তার ওপর ইহুদি-জামার আস্তিনে রুপোর বোতাম সারি সারি লাগানো থাকত। তা দেখে চমক লাগত। সে আসত গোলাপ আর আতর বিক্রি করতে। কর্তারা, বাবুরা, সব্বাই ছিলেন তার খদ্দের। আমাদের ছোটদের জন্য ছোট ছোট শিশিতে সে আনত গোলাপি আতর। সেটা আমাদের বার্ষিকী। তার জন্য পয়সা দিতে হতো না তাকে। তিনি আরও লিখেছেন- তার দিদিমা অর্থাৎ গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী যোগমায়া ছিলেন অতি রূপবতী মহিলা। পাশ দিয়ে চলে গেলে মনে হতো পদ্মগদ্ধ ছড়াচ্ছে কেউ। সেই দিদিমার সাতনরী হারটি হাতে নিয়ে শুঁকে দেখতেন তার নাতি-নাতনিরা। আতর-চন্দনের সুগন্ধ লেগে থাকত সে গয়নায়। তখনও খুসবো ভুরভুর করছে, সাতনরী হারের সঙ্গে যেন মিশে আছে মহাকালের সুগন্ধি। সেকালে আতর মাখবার খুব রেওয়াজ ছিল; আর তেমনি সব আতর। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী লিখেছেন- জোড়াসাঁকোর ৬নং বাড়ির গৃহিণী তার শাশুড়ি সারদাদেবীর কথা। শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি থাকলে ‘শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে, আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন। তারপর একটু আতর মাখতেন। এই ছিল তার রাতের সাজ।’

চার হাজার বছর পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করতো উচ্চ শ্রেণির মানুষ। হিসেব কষে দেখা যায় এখনও সুগন্ধির ব্যবহার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতো বছর পরেও মানুষের অভ্যাস বা রুচির কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি। দেখা যায় অনেক স্বচ্ছল মানুষ আছেন যারা শরীরে ঘামের বোটকা গন্ধ নিয়ে ঘুড়ে বেড়ান কিন্তু সুগন্ধ ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। এটা নিঃসন্দেহে একটি সচেতনতার বিষয়। এই শিক্ষা পরিবার থেকেও আসতে হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে ছোট বেলায় আমার মাকে দেখেছি নানারকম সুগন্ধি ব্যবহার করতে যদিও সেগুলো খুব একটা দামি ছিলো না। একটার নাম সম্ভবত ছিলো ‘চার্লি’ আরো কয়েকটার নাম যতদূর মনে পড়ে ‘পয়জন’, ‘ইয়ার্ডলি’ ইত্যাদি। বিয়েশাদি বা এ ধরনের কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আমাদের ভাই বোনদের শরীরে তিনি স্প্রে করে দিতেন সেসব সেন্ট। আম্মা সেসব অনুষ্ঠানকে বলতেন ‘ফাংশন’। এ ধরনের ইংরেজি শব্দ এখন আর কাউকে ব্যবহার করতে দেখা যায় না। আমি ব্যক্তিগত ভাবেও সুগন্ধির ভয়ানক ভক্ত। নেপোলিয়ন যেমন মদের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়ে খেতেন সেরকম না হলেও কখনো সখনো মন বিষন্ন হলে আমার পছন্দের কিছু সুগন্ধি আছে যা হাতের মনিবন্ধের তালুর দিকটায় দু’তিন দফা স্প্রে করে নাকের সামনে ধরলেই কিভাবে যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়। সে বড়ই এক অদ্ভুদ ব্যাপার!

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম