বাংলা বর্ষপঞ্জি ও অর্থবছর একটি উদ্ভাবনী সংস্কার প্রস্তাব
আসাদুল্লাহ্
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সম্প্রতি বাংলা একাডেমি আবার বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলা সনের হিসাব সংস্কারের একটি সুপারিশও প্রণয়ন করেছে। পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায় যে, বাংলা সনের প্রস্তাবিত সংস্কারে বৈশাখ থেকে আশ্বিন ৬ মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে। ফাল্গুন ব্যতীত কার্তিক থেকে চৈত্র ৫ মাস হবে ৩০ দিনের। ২৯ দিনে ফাল্গুন ধরা হবে। বছরে দিনের সংখ্যা ৩১x৬ (১৮৬) + ৩০ x ৫ (১৫০) +২৯= ৩৬৫ ঠিক রইল। বাংলা একাডেমির ভাবনামতে এ প্রস্তাবের ফায়দা হল ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ১২ চৈত্রে ২৬ মার্চ, ২৫ বৈশাখে ৮ মে, ১১ জ্যৈষ্ঠে ২৫ মে এবং ১ পৌষে ১৬ ডিসেম্বর প্রাতিষঙ্গিক হবে। কিন্তু এই মিলের সমান্তরালে গরমিল রয়ে যাচ্ছে। তা ভেবে দেখা জরুরি।
আমার কথা হল অতীতের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রেই মিলে যাওয়া সমীচীন নয়। সম্ভবও নয়। কেননা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশে সংস্কারকৃত বর্তমান বাংলা সন চালুর আগে বাংলা মাসের দৈর্ঘ বা দিনের সংখ্যার সাযুজ্য ছিল না। জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় প্রভৃতি ৩২ দিনে হতো। পৌষ মাস ২৯ দিনের ছিল। কোনো কোনো মাস ৩০ বা ৩১ দিনে হতো। সেই সময়ে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যু বরণকারী কোনো কীর্তিমান মহাজন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু দিবসের সঙ্গে বর্তমান সংস্কারকৃত বাংলা সনের তারিখ এবং রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইংরেজি মাসের তারিখের প্রাতিষঙ্গিকতা ঠিক রাখা যাবে না। ৩২ শে জ্যৈষ্ঠ বা আষাঢ়ে কারও বিশেষ দিনের প্রাতিষঙ্গিক তারিখ পাওয়া যাবে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিলে যেতে পারে। তাই বলে প্রস্তাবিত সংস্কার সর্বত্রগামী হবে না। এতে জটিলতা বাড়বে।
আমার বিবেচনায় ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি মেলানোই প্রধান লক্ষ্য হওয়া সমীচীন। একুশ হচ্ছে মাথানত না করা। একুশ বাঙালির পরিচয়। আজ তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। অর্থাৎ একুশ আমাদের বিশ্ব-পরিচয়। বস্তুত মহান একুশে ও ৮ ফাল্গুন মেলানোর পর আর যে যে আদি বাংলা তারিখ (অর্থাৎ বিশেষ দিন) এবং রোমান ক্যালেন্ডারের তারিখ মিলে তা-ই শ্রেয়। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী কিংবা স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস মেলানো বাড়াবাড়ি প্রতীয়মান হতে পারে। বারবার বর্ষপঞ্জি সংস্কার সমীচীন নয়। তাহলে আমরা মূল হারাব। তবে আলোচ্য সংস্কারের ফলে যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলে যায়-সেটাই গ্রাহ্য। অতিরিক্ত কিছু মেলানোর চেষ্টা সুফল দেবে না। তাছাড়া বাংলা একাডেমির প্রস্তাবিত সংস্কারে লিপিয়ারে ফাল্গুন মাস ৩০ দিন হওয়ায় ১৭-৩০ ফাল্গ–নের দিনগুলো বিগত ৩ কছরের সাযুজ্য হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ প্রাতিষঙ্গিক থাকে না। অথচ আরেকটু ভেবে দেখলে চিরকালের জন্য (ঋড়ৎবাবৎ) উল্লিখিত প্রাতিষঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এতে ২৯ নয়, বাংলা মাস হবে শুধু ৩০ ও ৩১ দিনের। সে কথা একটু ভূমিকাসহ স্বল্প বিস্তারে বলি।
বর্তমান সরকারের দিনবদলের পালায় জাতীয় পর্যায়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন দৃশ্যমান। কিসিঞ্জারের ব্যঙ্গাত্মক উক্তির একাত্তরের সেই তলাবিহীন ঝুড়ি-বাংলাদেশ আজ নিুমধ্যম আয়ের দেশ। শিক্ষা স্বাস্থ্য ক্রীড়া নারীর ক্ষমতায়ন-এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত পালাবদল আজ বিশ্বের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালির পরিচয়-একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের মতো ১ বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষও বাঙালির এক অনন্য বাতিঘর। ঐতিহ্য ও ঐক্যের বাতিঘর। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রাপ্ত। বিশ্বসংস্কৃতির উত্তরাধিকার।
-২-
তবে বাতির নিচের আঁধারের মতো বাংলা বর্ষপঞ্জির গণনায় আজও দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ দুর্বলতার বদলে স্বচ্ছতা আনার জন্য বাংলা সনের দিন গণনা একটুখানি বদলাতে হবে। দিন বদলের মতো হিসাব বদলও আমরা পারি বৈকি।
যে কোনো বাঙালি হিন্দুকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়- তারা চৈত্র সংক্রান্তি মান্য করে এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে। লোকনাথ পঞ্জিকাতে ১ বৈশাখ ১৫ এপ্রিলে পড়ে। অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল ও ১ বৈশাখ প্রতিষঙ্গ। বাংলাদেশের সরকারি গণনায় বাংলা নববর্ষ বা ১ বৈশাখ হয় ১৪ এপ্রিল। এমন কেন হবে? বাংলা নববর্ষ তো হিন্দু মুসলমানের কোন ধর্মীয় পর্ব নয়। কোনো বিভেদ নেই। তবু এমন কেন হয়? ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুসরণ করেই সরকার বাংলা বর্ষপঞ্জির গণনা নির্ধারণ করেছে। কমিটির কোনো কোনো সদস্যের আপত্তি সত্ত্বেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষঙ্গ (অর্থাৎ একই দিনে আবর্তন) ধরেননি। ১৯৫২ সালে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলা ফাল্গুন মাসের ৮ তারিখ। বর্তমান বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতিবছর ৯ ফাল্গুন হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। এতে বাংলা মায়ের সন্তানের বুকের রক্তে ভেজা ৮ ফাল্গুন হারিয়ে গেছে। এটাই বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার দুর্বলতা। এ দুর্বলতার বদল ঘটিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ৮ ফাল্গুন ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মেলানো বা প্রাতিষঙ্গিক করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন শুধু একবার ফাল্গুন বা চৈত্র মাসকে ১ দিন বাড়িয়ে প্রলম্বিত করে ৩১ দিনে গণনা করা। তা করলেই পরের বছর থেকে প্রতিবছরই ১ বৈশাখেই হবে ১৫ এপ্রিল। বাংলা-ভারত নির্বিশেষে নিখিলবিশ্ব জুড়েই হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিশ্ববাঙালি একই দিনে বাংলা নববর্ষ বা ১ বৈশাখ উদযাপন করতে পারবে। এই প্রাতিষঙ্গিকতা প্রতিবছর অটুট থাকবে। প্রশ্ন হতে পারে অধিবর্ষ ছাড়াই ফাল্গুন বা চৈত্রে কেন ১ দিন বাড়িয়ে ধরব। দোহাই একটাই ৮ ফাল্গুনে ২১ শে মিলিয়ে ঐতিহ্যের অটুট বন্ধনে অনন্য মাত্রা যুক্ত করা। লক্ষ্য ৮ ফাল্গুন ও ২১ শে অবিচ্ছেদ্য করা। ফায়দা বা অতিরিক্ত প্রাপ্তির আনন্দ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিখিল বাংলার নিখিলবাঙালির একই দিনে (১৫ এপ্রিলে) ১ বৈশাখ পাওয়া।
দ্বিতীয় যুক্তি হল ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। অতীতে বহু দেশে বহু সরকার জাতীয় প্রয়োজনে দফতর সময় (office hour) আগে পিছে করেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনের বহু বদল ঘটেছে। তেমনি আকবরের সময়ে ৯৬৩ হিজরিকে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে বাংলাসন চালুর সময়তো অধিবর্ষের হিসাব গণ্য করা হয়নি। আধুনিক আমরা না হয় তার ক্ষতিপূরণ বা নমুনা শুদ্ধিস্বরূপ ১টা দিন মাত্র ১ বছরের জন্য বাড়িয়ে অধিবর্ষ ছাড়াই ৩৬৬ দিন ধরে নিই। ফাল্গুন বা চৈত্রকে ৩১ দিন গণনা করি। তবেই তো সব মিলে যায়। দুর্বলতার লেঠা চুকে যায়। উপরন্তু ফায়দা হল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস ৭ আগস্ট প্রাতিষঙ্গিক হয়। যা বর্তমান বর্ষগণনায় হয় না।
প্রকৃত অধিবর্ষে ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে অধিফাল্গুন স্বরূপ অ১৫ তারিখ ধরলেই হয়। এই অ১৫কে ৯৯(লী) ফাল্গুনও ধরা যায়। ৯৯(লী) বিলুপ্ত বাংলা বর্ণ। ৯৯(লী) দেখতে নিরানব্বই এর মতো। অর্থাৎ Digital letter বা আংকিক বর্ণ। অধিফাল্গুন কে ৯৯(লী) ফাল্গুন বলা হলে রক্তে ভেজা একটি বাংলা বর্ণ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর কী চাই! এ কথাগুলো এর আগেও একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধে বলার চেষ্টা করেছি। আশা করি বাংলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিষয়টি জাতির স্বার্থে এই উদ্ভাবনী সংস্কার প্রস্তাব আমলে নেবেন। বঙ্গাব্দের তারিখ অনুশীলনের বড় মাধ্যম হয়ে থাকবে বাংলা সনভিত্তিক অর্থ বছর।
তাই এবার একটু অর্থ বছর নিয়ে চিরকুটের মতো অল্প কথা বলি। আকবরি ফসলি সনের সঙ্গে মিল রেখে ব্রিটিশরা মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অর্থবছর চালু করে সেই ১৮৬০ সালে। ওরা এটা করে ওদের স্বার্থেই। স্বার্থটা-খাজনা আদায়ের সুবিধা। ফসলের আগমনে কৃষক যাতে তা বিক্রয় করে খাজনা শোধ করতে পারে। ভারত বিভক্তির পর ভারত-অংশে অর্থছর আগের মতোই রইল। পাকিস্তান সরকার জুলাই থেকে জুন অর্থবছর চালু করল।
-৩-
যা গ্রামবাংলার সঙ্গে মিলে না। ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে না। এই দুষ্ট পাকস্মৃতি স্বাধীন বাংলাদেশে আজও আছে। ইসলাম মটর হয়েছে বাংলা মটর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জিন্নাহ হল যথাক্রমে হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও মাস্টারদা সূর্যসেন হল। এমন আরও অনেক কিছু। কেন তবে অর্থ বছরে বয়ে বেড়াব জুলাই টু জুন? এ ছাড়া ঋতুর আবর্তনে ঝড় বৃষ্টিসহ নানাবিধ কারণে উন্নয়নমলূক কার্যসূচি বাস্তবায়নের সুবিধাজনক সময় অধিকতর উপযোগী হয় অর্থবছর বৈশাখ থেকে চৈত্র হলে। আকবরি ফসলি সনের মূলে আবার আমাদের প্রত্যাবর্তন হয়।
আরেকটা কথা- স্বাধীনতার ইতিহাস বাঙালির সর্বোজ্জ্বল ঘটনা। কত রাজা-সম্রাট ক্ষমতার স্মৃতি ধরে রাখতে কত সন অব্দ চালু করেছে-ইতিহাস তার সাক্ষী। আমাদের প্রবাসী বা মুজিবনগর সরকার শপথ নেয় ১৭ এপ্রিল। একাত্তরে বিশ্ব ওই দিন জানে যে বাংলাদেশ সরকার আছে। এ সরকারের সঙ্গে রাজনীতি অর্থনীতি একাকার হয়েছিল স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ নামে। স্বাধীনতার যে সূর্য পলাশীর আমবাগানে অস্তমিত হয়েছিল; মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের গঠন ও শপথের মাধ্যমে আবার বাংলার সেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। তা হলে ইতিহাসের এ মহাঘটনা কেন নয়- নতুন অব্দ অন্তত অর্থ বছরের মহাস্মারক? আকবরি ফসলি বঙ্গাব্দ এবং বাংলা দেশের রক্তাক্ত বিজয়যাত্রার ১৭ এপ্রিলই তো দেখি অর্থবছরের যোগ্যতম সূচনা দিবস। ১৭ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল এর প্রতিষঙ্গ নতুন হিসাবে ৩ বৈশাখ থেকে ২ বৈশাখ হতে পারে অর্থবছর। এতে বঙ্গাব্দে অর্থ বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের মহাস্মৃতির স্মারকাব্দ একাকার হয়ে যায়। যা কিনা বাঙালির রক্তাক্ত বিজয়ের সূর্যগাথা। বাঙালির আরেকটি অনন্য বিজয় ঘটবে- যেদিন ৮ ফাল্গুন হবে ২১ শে। আমি সেই মহান দিনটিকে আগাম স্বাগত জানাই। বাঙালির আরেকটি অনন্য বিজয় ঘটবে- যেদিন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চালুকৃত অর্থবছর জুলাই টু জুন বাতিল করে মজিবনগর দিবসে ১৭ এপ্রিল বা ৩ বৈশাখ হবে বাংলাদেশের অর্থ বছরের সূচনা দিন। আমি সেই মহান দিনটিকে আগাম স্বাগত জানাই। জয়তু বাঙালির বদলযাত্রা।
