Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কিশোর গ্যাং

খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে রাজশাহীর কিশোররা

বেপরোয়া বাইক চালাতে গিয়েও ঝরছে প্রাণ * নারীদের উত্ত্যক্তের সঙ্গে বাড়ছে ধর্ষণ ও আত্মহত্যা * স্কুল-কলেজ ছেড়ে মোড়ে মোড়ে আড্ডা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে

Icon

তানজিমুল হক, রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে রাজশাহীর কিশোররা

রাজশাহীতে সংঘবদ্ধ হয়ে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। কখনও ভয়ংকর হয়ে উঠছে এরা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজের রীতি-নীতিতে নেই তাদের শ্রদ্ধাবোধ।

অসুস্থ রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের আনুকূল্যেও কিশোর গ্যাং কালচার ডালপালা মেলছে। দল বেঁধে আড্ডা-ইভটিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণ, ছিনতাই, বেপরোয়া বাইক চালানো, পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি ছাড়াও সমাজের সম্পদশালী পরিবারের কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিতেও।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া যুগান্তরকে বলেন, বড় হয়ে ওঠার সময় কিশোরদের প্রতি বিশেষ কেয়ার নেয়া হচ্ছে না।

মানসিক ও শারীরিক বিকাশের সময় বাচ্চারা বাবা-মাকে খুব বেশি সময় কাছেও পাচ্ছে না। বেশির ভাগ বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে সামর্থ্যরে চেয়েও বেশি প্রত্যাশা করছেন।

ফলে হতাশা এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। গ্যাং কালচারের সর্বশেষ বলি হচ্ছেন- কলেজছাত্র ফারদিন ইসনা আশারিয় রাব্বি (১৮)।

৬ আগস্ট নগরীর বর্ণালীর মোড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় তাকে। তিনি দিনাজপুরের পার্বতীপুর থানার মমিনপুর গ্রামের মৃত মোজ্জাফর আলীর ছেলে। রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে জড়িতরা অল্প বয়সী।

এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি। ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর মধ্যরাতে নগরীর জামালপুর তাঁতপাড়ায় বন্ধুদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারায় নাসির উদ্দিন লালা (১৭)।

ওই রাতেই লালার ৩ বন্ধু রিয়াজুল ইসলাম সিয়াম (১৬), রাব্বি আহমেদ সিহাব (১৭) এবং শাহীন আলমকে (১৭) গ্রেফতার করা হয়। মদ্যপানের পর এ খুনের ঘটনা ঘটে। রাজশাহীর আদালতে মামলা চললেও গ্রেফতার তিন বন্ধুই জামিনে।

গত ১ বছরে রাজশাহীতে একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনায় কিশোরদের নাম উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। পুলিশের কাছে ছিনতাইকারীদের যে তালিকা, সেখানেও বহু কিশোরের নাম। মাঝে মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়েই দ্বিগুণ উৎসাহে ছিনতাইয়ে নেমে পড়ছে।

কিশোর ছিনতাইকারীদের মধ্যে গণমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে তারা হচ্ছে- লক্ষ্মীপুর ভাটাপাড়ার মুরাদ, সুজন, বুলনপুর ঘোষপাড়ার আরেক সুজন, চণ্ডিপুরের শিমুল ও সনি, হেতেমখাঁর বাপ্পি, বিলশিমলা বন্ধগেটের সওদাগার, বহরমপুরের ডলার, মিজু, শেখপাড়া মুক্তাপুকুরের শাকিল, তেরোখাদিয়া মধ্যপাড়ার জয়, তেরোখাদিয়া ডাবতলার মারুফ প্রমুখ।

এদের অনেকেই ধনীর দুলাল। ছিনতাইয়ের সময় এরা ব্যবহার করে দামি ব্র্যান্ডের মোটরবাইক। তাদের মূল টার্গেট নারী এবং নগরীর বাইরে থেকে আসা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

নগদ টাকা, মোবাইল ফোন বা স্বর্ণালঙ্কারের দিকেই তাদের নজর বেশি। মাদকদ্রব্যের টাকা জোগাড় করতেই এরা ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ঝড়োগতিতে দলবদ্ধ হয়ে বাইক চালানোর উৎপাত-তো আছেই। এতেও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে কিশোররা।

সর্বশেষ ৬ আগস্ট রাজশাহী মহানগরীর কোর্ট স্টেশন মোড়ে দ্রুতগামী একটি বাইক ট্রাকের নিচে চাপা পড়লে বাইকের তিন আরোহীই নিহত হন। এরা হলেন- নগরীর গুড়িপাড়ার রকি (২২), সাগর (২১) ও মাফিকুল (১৭)। কাশিয়াডাঙ্গার ওসি মনসুর আলী বলেন, ট্রাকটি নগরীতে ঢুকছিল।

এ সময় বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল ট্রাককে ক্রস করতে গিয়ে তিনজনই ট্রাকের ভেতরে ঢুকে চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে দু’জন, বাকি একজন রামেক হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়। ১৬ জুন রাতে এমনই এক বাইক দৌড়ে প্রাণ হারায় রাজশাহীর স্কুলছাত্র জুবায়ের হোসেন অন্তর। সে নগরীর উপকণ্ঠ আলীগঞ্জ পশ্চিমপাড়ার আলমগীর হোসেনের ছেলে।

অনাকাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যু নিয়ে কথা হয় রাজশাহী মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) অনির্বাণ চাকমার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সড়কে কিশোরদের অকালমৃত্যু খুবই দুঃখজনক।

দামি বাইকের রেস ঠেকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এসব বন্ধে অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী উত্ত্যক্তের ঘটনা।

বখাটে কিশোররা স্কুল-কলেজের সামনে আড্ডার নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করছে। বিশেষ করে রাজশাহী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রাজশাহী পিএন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যন্ত এলাকায় ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের ঘটনা বেড়েই চলেছে।

প্রেম প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। এদের হাত থেকে বাঁচতে ছাত্রীরা আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।

২৩ এপ্রিল প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিবেশী বখাটে মুকুল (১৭) মোহনপুর উপজেলার বাকশিমুইল হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বর্ষাকে অপহরনের পর ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে রাখে। পরে মুকুলসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে বর্ষার বাবা মামলা করেন। শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়।

পরে আত্মহত্যার প্ররোচনায় আরেকটি মামলা হয়। বতর্মানে মুকুল জেলে। এর আগে ২০১৬ সালের ৯ মে রাজশাহী নগরীর চরশ্যামপুর শান্তিনগর এলাকার হায়দার আলীর কিশোরী কন্যা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী আমেনা খাতুন (১৪) রেজাউল নামে প্রতিবেশী এক বখাটের অত্যাচারে আত্মহত্যা করে। বখাটে রেজাউল আমেনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় অপহরণের হুমকি দেয়। একপর্যায়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।

ওই বছর ২৩ মার্চ রাতে রাজশাহী নগরীর সোনাদিঘী মোড়ের ভাই ভাই হোটেলে রাতভর এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করে হোটেলের কিশোর-বয়রা।

জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে কিশোর খোকনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিশোরীর। তারই সূত্র ধরে প্রেমিক খোকন তাকে রাজশাহীতে ডেকে আনে। পরে হোটেলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়।

২৬ জুন রাজশাহীতে ১৪ বছরের কিশোরীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ এবং গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দিতে ওই কিশোরী জানিয়েছে- গর্ভপাতের সময় গর্ভের সন্তানের বয়স ছিল ৭ মাস। ওই কিশোরী এক ব্যক্তির পালিত কন্যা।

পাওয়ার (১৮) নামে এক প্রতিবেশী কিশোর তাকে ধর্ষণ করে বলে সে তার জবানবন্দিতে বলেছে। মামলার পর থেকেই ধর্ষক পাওয়ার পলাতক। এছাড়া রাজশাহীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্কুলের পোশাক পরে পদ্মার ধারে বা বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

অনেক সময় তাদের আপত্তিকর অবস্থায়ও দেখা যায়। এসব ঘটনায় সম্প্রতি রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান পদ্মার পাড়ে গিয়ে এসব শিক্ষার্থীদের ক্লাস ছেড়ে বিনোদন কেন্দ্রে না আসার জন্য বোঝান, পরামর্শ দেন। অপরদিকে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে কিশোররা মাদকদ্রব্যের বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশেষ করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চারঘাট এবং বাঘা উপজেলায় এসব ঘটনা ঘটছে। এদের ব্যবহার করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এর ফলে অনেক কিশোরই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে।

তাছাড়াও কিশোরদের মধ্যে সম্প্রতি স্মার্টফোন কালচার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর বদৌলতে আসক্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতেও। ভেঙে পড়ছে মানবিক মূল্যবোধ, সমাজের রীতি-নীতি। এরাই ফেসবুকে গ্রুপ সৃষ্টি করে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে।

কথা হয় জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) ইফতেখায়ের আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধীদের ব্যাপারে আমাদের সেভাবে পর্যবেক্ষণ নেই বা কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের রেকর্ডও নেই।

এ ব্যাপারে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, কিছু কিশোর অপরাধী রাজশাহীতে নারী উত্ত্যক্ত, ছিনতাই এবং খুনের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে কয়েকজন গ্রেফতার আছে।

আর যারা বাইরে তারা সার্বক্ষণিক আমাদের নজরে আছে। নগরীতে এরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করে। তবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এ ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক রয়েছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম