সিলেটে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সেবা

এক বছরে ২৩১ বিরোধ নিষ্পত্তি ১০৬

ইউনিয়নে বসেই পুলিশি সেবা দেয়ার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে
 মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট ব্যুরো 
২৫ আগস্ট ২০১৯, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিলেট রেঞ্জ পুলিশের সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সেবা। বিভাগের ৩৩৮টি ইউনিয়নে এক বছর ধরে চলছে এই সেবা। ছোটখাটো অভিযোগ নিয়ে এখন আর কয়েক কিলোমিটার দূরের থানায় যেতে হয় না ভুক্তভোগীদের। অন্য সেবার মতো পুলিশি সেবাকেও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতেই এক বছর আগে এ কাজটি শুরু করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান।

এরই মধ্যে এ কাজে স্থান পেয়েছে পুলিশের উদ্ভাবনী সেবায়ও। কাজটির উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন পুলিশ পদকও। গ্রামে গ্রামে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের কারণেই ঘটছে বড় বড় ঘটনা। সম্প্রসারিত বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তালিকা তৈরি হচ্ছে এসব বিরোধের। এরই মধ্যে সিলেট বিভাগের ৩৩৮টি ইউনিয়নে ২৩১টি বিরোধের তালিকা তৈরি করেছেন সম্প্রসারিত বিট পুলিশের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ১০৬টি নিষ্পত্তিও করে ফেলেছেন। বাকি বিরোধগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে।

প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট। প্রবাসে যারা থাকেন, তারা গ্রামে এসে গল্প করেন উন্নত দেশের পুলিশি সেবা নিয়ে- ঘটনা ঘটার খুব কম সময়ের মধ্যেই কীভাবে পুলিশ উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। এত দিন এসব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গল্পের মতোই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এসব গল্প সত্যি হতে শুরু করেছে সিলেট বিভাগের চার জেলায়। ৩৩৮টি ইউনিয়নে এক বছর ধরে শুরু হয়েছে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সেবা। যেখানে সপ্তাহে ৩ দিন একজন উপপরিদর্শক ও একজন সহকারী উপপরিদর্শক অফিস করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে। স্থানীয়দের ছোটখাটো অভিযোগ সেখানে বসেই নিষ্পত্তি করেন তারা। বড় ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সেখানে মামলা দায়েরের পর শুরু হয় অপরাধীদের গ্রেফতার এবং তদন্তের কাজ।

সরেজমিন দেখা যায়, সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের এই ফতেহপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়ন পরিষদের বাইরে দেখা গেল অনেক মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বিষয়টি আঁচ করা গেল। দুইজন পুলিশ সদস্য এসব মানুষকে পুলিশি সেবা দিচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের কথা শুনছেন। তা কাগজে লিপিবদ্ধ করছেন। কিছু কিছু ছোট অভিযোগ, যা মামলা দায়েরের প্রয়োজন হয় না- এমন অভিযোগ স্থানীয় চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সমাধান করে দেন এই কর্মকর্তারা।

এখান থেকে সেবা নিয়ে বের হয়ে সাহেব আলী নামের একজন জানান, সকালে তার সঙ্গে প্রতিবেশীর ঝগড়া হয়েছে, একপর্যায়ে তাকে মারতে আসে প্রতিবেশী। তিনি এ ঘটনায় মামলা করতে চান; কিন্তু মামলা করতে হলে তাকে যেতে হতো থানায়। আর ফতেহপুর থেকে থানার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। যেতে-আসতেই তার এক হাজার টাকার প্রয়োজন। এছাড়া থানায় গেলে গ্রামের আইন জানা কাউকে সঙ্গে নিতে হতো, তার জন্য আরও বাড়তি খরচ বহন করতে হতো। কিন্তু সেই খরচ করতে হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদেই পুলিশ পেয়ে তার অভিযোগ দিয়েছেন, তারা তা লিপিবদ্ধ করেছেন।

বিভাগের অন্য জেলাগুলোয়ও একই চিত্র। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদে বিট পুলিশিং সেবায় খুশি স্থানীয়রা। সেখানে পাওয়া গেল উপকারভোগী আবু তালেব। তার পারিবারিক কলহ ছিল দীর্ঘদিনের। কিন্তু ইউনিয়নে এসে বিট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালে দুই দিনেই স্থানীয় চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তা সমাধান করে দিয়েছেন। সিলেট পুলিশের এমন সেবায় মুগ্ধ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, এ সেবায় এখানকার মানুষ খুব খুশি। কারণ হাতের কাছেই পুলিশ পাচ্ছে তারা।

তাদের দাবি, সপ্তাহে তিন দিন নয়, প্রতিদিনই সেবা চান তারা। এমন উদ্যোগে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার পাল যুগান্তরকে জানান, এই সেবা চালু হওয়ার পর গ্রামে গ্রামে অনেক অপরাধ কমে গেছে। বিশেষ করে জুয়া এবং মাদক কারবারিদের এখন আর গ্রামে দেখা যাচ্ছে না। এ উদ্যোগটি সারা দেশে হলে মানুষ উপকৃত হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নীত হবে।

এই সেবা চালু করে এ বছর পুলিশ পদক পেয়েছেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান। সেই সঙ্গে সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সেবা স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশে পুলিশের উদ্ভাবনী সেবার তালিকায়। প্রচলিত পুলিশি সেবার বাইরে এই সেবা শুরু করার পেছনে কী কী বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন? জবাবে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, বিট পুলিশিংয়ের ধারণা পুলিশ বিভাগে আগে থেকেই আছে, কিন্তু সেটা শহরের জন্য। শহরের বাইরেও বিশাল এক জনগোষ্ঠী রয়েছে।

তাদের কষ্ট লাঘব করা এবং পুলিশি সেবা মানুষের খুব কাছে নিয়ে যাওয়াই ছিল এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য। সম্প্রাসারিত বিট পুলিশের কর্মকর্তারা বিরোধের তালিকা করছেন। মাদক ব্যবসায়ী ও অন্য অপরাধীদের তালিকাও তৈরি করছে ইউনিয়নে বসেই। এক বছরে সিলেট বিভাগের ২৩১টি দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ তালিকাভুক্ত করেছেন সম্প্রসারিত বিট পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ১০৬টি এখন মীমাংসিত। বাকিগুলো মীমাংসার চেষ্টা চলছে। কামরুল আহসান বলেন, জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সেবা। মানুষ উপকৃত হচ্ছে। সবচেয়ে খুশি হবে সেদিন, যেদিন সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং সারা দেশে কার্যকর হবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন