ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কার্যকরে ১১ বাধা
একগুচ্ছ সুপারিশসহ কমিটির প্রতিবেদন দাখিল
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিনিয়োগের বিকল্প উৎস ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালে’ উদ্যোক্তাদের ওপর ‘স্ট্যাম্প ডিউটি’ আরোপ ও আয়কর রেয়াত সুবিধা না দেয়াসহ ১১টি বাধা চিহ্নিত করেছে এ সংক্রান্ত সরকারি কমিটি।
এসব বাধা দূর করতে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে কমিটি। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভিসিপিয়াব) মহাসচিব শওকত হোসেন সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইকুইটি খাতটি এখন বর্ধনশীল পর্যায়ে রয়েছে।
অলটারনেটিভ ফান্ড ম্যানেজারদের আয়কর আগামী ১০ বছরের জন্য পুরোপুরি অব্যাহতি কিংবা আয়করের হার কমানোর দাবি দীর্ঘদিনের। একটি ভিসিপিই প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রধান ব্যবসা থেকে আয় পেতে সাধারণত এই সময়ের প্রয়োজন হয়। এর আগে খুবই সামান্য পরিমাণ
আয় হয়, যা দিয়ে কোম্পানিকে শুধু চলমান রাখা সম্ভব। এ ছোট্ট আয়ে ট্যাক্স থাকলে সেটি এই খাতের জন্য খুবই সর্বনাশা ছিল।
প্রসঙ্গত, ব্যবসায় ঋণের জন্য উদ্যোক্তাদের মূল ভরসার জায়গা হল ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্রে ঋণ দিতে রাজি হয় না। এক্ষেত্রে একটি বিকল্প হতে পারে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট প্রতিষ্ঠান।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ একটি নতুন ব্যবসায়িক ভাবনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী থাকে। ফলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং প্রায় ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও নতুন কোম্পানির একমাত্র অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালে বিনিয়োগের পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ২৫ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩ কোটি। বিনিয়োগের সময় ৫ বছর। এক্ষেত্রে এক্সপেকটেড ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন ন্যূনতম ২৫ শতাংশ, শেয়ারহোল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি প্রত্যাহার করা না হলে বিনিয়োগে কেউ আগ্রহী হবে না। কারণ ট্রাস্ট চুক্তিপত্র নিবন্ধনের সময় ২ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটি পরিশোধ করতে হয়। এ ব্যবসার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয় আয়করকে। সেখানে বলা হয়, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ব্যবসা থেকে উপার্জনের জন্য আদর্শ সময়সীমা হচ্ছে কমপক্ষে ১০ বছর।
কিন্তু এই সময় আয় সীমিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে তা ব্যয় হয়ে যায়। ফলে এই ক্ষুদ্র আয়ের ওপর আয়কর আরোপ এ শিল্পের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিকল্প বিনিয়োগ তহবিল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ক্রমবর্ধমান অবস্থানে আছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর আয় খুব সীমিত। এর ওপর আরোপিত সব ফি বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে আয়কর রেয়াত সুবিধা দেয়া না হলে বিকল্প বিনিয়োগ তহবিলে বিনিয়োগের জন্য কোনো ব্যক্তি খাত উৎসাহিত হবে না। কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী কর প্রদান করবে।
তবে ডিভিডেন্ট ও ক্যাপিটাল গেইনের ক্ষেত্রে তহবিল থেকে একাধিকবার কর প্রদান পরিহার না করলে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আনয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান ভেঞ্চার ক্যাপিটালে বিনিয়োগে বাধ্যবাধকতার বিধান না থাকা। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দাখিলকৃত কমিটির সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির গতিশীল আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যুবসমাজের নেয়া উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন দরকার, যা সম্ভব ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে।
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে এ ধরনের বিনিয়োগের বিকল্প তহবিল ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে অর্থায়নের উৎস হিসেবে সহায়তা করে।
সরকার গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের অন্তরায় উত্তোরণে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বিনিয়োগ শুরুর আগেই প্রদেয় ২ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে বিকল্প বিনিয়োগ তহবিলকে অব্যাহতি প্রদান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বীমার মুনাফার একটি অংশ এ খাতে বিনিয়োগ করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়, অন্যান্য আর্থিক সেবার তুলনায় বিকল্প বিনিয়োগ অধিক ঝুঁকি বহন করে। অথচ তহবিলের সংকটের কারণে এক্ষেত্রে অর্থায়নের পরিমাণ সীমিত। অর্থায়নের পরিমাণ বাড়াতে বিকল্প তহবিলে বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতির পরিমাণ ২ বছরের জন্য ১০০ শতাংশ নির্ধারণ করা যেতে পারে। বর্তমানে এ সঞ্চিতির পরিমাণ দেড়শ শতাংশ।
সেখানে আরও বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এক্ষেত্রে দ্রুত অর্থ আদানপ্রদানের জন্য নন রেসিডেন্স ইনভেস্টর টাকা অ্যাকাউন্ট (এনআইটিএ) পদ্ধতি সংস্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সংশোধন করতে হবে পুঁজিবাজারে আসার জন্য বিনিয়োগকৃত তহবিল থেকে এক্সিট সংক্রান্ত বিধানকে।
সুপারিশে আরও বলা হয়, ক্ষুদ্র আয়ের ওপর সব ফি আরও সহনীয় করা, কর ও ডিউটিমুক্ত করা, আইপিতে বিকল্প বিনিয়োগের কোটা নির্ধারণ, রেমিটেন্স আদানপ্রদানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন পরিবর্তন, বিকল্প বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা দেয়া।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সেচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট বিধি পাস করে। এই বিধির আওতায় বাংলাদেশে বিভিন্ন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাশাপাশি অনেক বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করা শুরু করে। স্থানীয় স্মার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরিতে কাজ করার জন্য ২০১৬ সালে এসব ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানি মিলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ গঠন করে।
