পিকে হালদার দুর্নীতি
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং টিকবে কি না সন্দিহান ইব্রাহিম খালেদ
আদালতে অভিমত দিয়েছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ * সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না : আদালত * আজ আদেশ
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পিকে হালদার ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিকল্পনা ছাড়া পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকে টিকিয়ে রাখা দুরূহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিলোপ, অপসারণ, নতুন নিয়োগ বা পুনর্গঠন করা হলে হয়তো ওই কোম্পানি টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
শুনানিতে আদালত বলেন, প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না। এ বিষয়ে আদেশের জন্য আজ (বুধবার) দিন ধার্য করেন আদালত।
বাংলাদেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা নিয়ে আদালতে অভিমত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালন শাহ আলম।
মঙ্গলবার সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে হাজির হয়ে তারা লিখিত আকারে এ মত তুলে ধরেন। ১৯ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে অপসারিত প্রশান্ত কুমার হালদারের পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে পিকে হালদারের মা, স্ত্রী, ভাইসহ ওই কোম্পানির শীর্ষ ১৯ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দের আদেশও দেয়া হয়।
আদালত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে পিকে হালদারকে অপসারণ করে কোম্পানিটি পরিচালনার জন্য স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেন।
আইএলএফএসএলের ৭ বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত চেয়ে করা মামলার শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ আদেশ দেন। পিকে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি কোটি কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পালিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানি আপিলে যায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) স্বাধীন চেয়ারম্যান (হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত) খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তাকে আসতে বলেন আপিল বিভাগ।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বাস্তবিক পক্ষে অর্থনৈতিক অবস্থা কী রকম আছে, অবসায়ন হওয়ার মতো অবস্থায় আছে কি না, আর্থিক অনিয়ম হলে কোন পর্যায়ে আছে, অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়ে সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব-উল আলম। আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
মঙ্গলবার সকালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, শাহ আলম লিখিত আকারে মত তুলে ধরেন। আদালত নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আদালতে বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড খুবই ভালো মতো চলছিল।
২০১৬ সাল থেকে এর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে ‘কি পারসন’ (মুখ্য ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। তার সঙ্গে আরও অনেকেই রয়েছে। এরা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। বের করে দেয়া মানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পিকে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছে। এটা খতিয়ে দেখতে অনুমতি দেয়া হয়নি। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই।
টাকা কোথায় আছে, সেটা আনট্রেসেবল (হদিস পাওয়া যাচ্ছে না)। দেশে থাকতে পারে, দেশের বাইরেও যেতে পারে। তবে এই টাকা উদ্ধার করতে রিকোভারি অ্যাজেন্ট নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের অ্যাজেন্ট দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর বলেন, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডকেও অবসায়ন করা হয়, তাহলে আর্থিক খাতে ধস নামতে পারে। আবার এ অবস্থায় এটাকে কতটা দাঁড় করানো যাবে, সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
আমি তো এই কোম্পানির কোনো শেয়ারহোল্ডার নই। হাইকোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারব! শরষের মাঝে ভূত থাকলে আমি কী করতে পারি! তখন প্রধান বিচারপতি কোম্পানিটির আমানতকারীদের অবস্থা জানতে চাইলে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, টাকা তো নেই। তারা চাইলেও টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, তিনি অসুস্থ। কনিষ্ঠ একজনকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় আছে- তিন মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত কাউকে দায়িত্বে রাখা যায় না। এটা বেআইনি না অনিয়ম। আমি প্রথম বৈঠকেই বলেছি দ্রুত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম আদালতকে বলেন, এই (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড) কোম্পানিটির মূলধনে ৪৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে।
ব্যাংক ঋণ আছে ৯৫৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সর্বমোট ঋণ হচ্ছে ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এই পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, প্রধান বিচারপতি তা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, আমারা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা দিয়েছি। কখনও কখনও বাস্তবায়ন করেছে, কখনও কখনও করেনি।
বিধিবহির্ভূতভাবে টাকা নিয়ে যাওয়ায় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনটিলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে।
মোট ৪৮টি ঋণ হিসাবের সঙ্গে ১২টি প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ব্যক্তির বিপরীতে মোট ১৫৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ বিতরণে পরিচালক পর্ষদের ডিউ ডিলিগেন্সের ঘাটতি ছিল। এই ৪৮টি ঋণ হিসাবের লেনদেন ভাউচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী কারা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, পিকে হালদারসহ অন্যরা এই কোম্পানি থেকেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আমরা পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আদালত জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা তাদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছি, শোকজ করেছি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এরপর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন তুলে ধরেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা শেয়ার নিয়ে কোম্পানিটি দখল করেছে, তারা ডাকাতির জন্যই এসেছিল। বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নেচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড একই সময়ে ২০১৫ সালের ১১ মার্চ একই পরিমাণ মূলধন ২০ লাখ টাকা নিয়ে ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ার কেনে।
পরবর্তী সময়ে পরিচালনা পর্ষদে এই চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। পরের তিন বছরে আগ্রাসী ঋণ বিতরণের মাধ্যমে এক কোটি টাকার বেশি ১৩৩টি ঋণের নামে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কিছু লোক কিছু লেখাপড়া শিখে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য। এরা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এদের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেয়া। পিকে হালদার কীভাবে চলে গেল, সেটা আপনাদের (আদালতের) দেখা উচিত। কোম্পানি চলবে কি চলবে না, এ বিষয়ে আপনারা সিদ্ধান্ত নিন।
তিনি বলেন, আগে তো ব্যাংক ছিল না। মানুষ গোলায় ধান রাখত। এটাই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখে। এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য।
