আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার: এনবিআরের কাছে তথ্য চেয়েছে দুদক
মামলা না হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে * সরকারি ও ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা জড়িত
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের শনাক্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এজন্য বিগত কয়েক বছরের এ সংক্রান্ত তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং ও মিস ডিক্লারেশনের (মিথ্যা ঘোষণা) ঘটনায় শুধু জরিমানা ব্যতীত কোনো মামলা রুজু না হওয়ার কারণও জানতে চাওয়া হয়।
সম্প্রতি এনবিআরকে দুটি পৃথক চিঠির মাধ্যমে উল্লিখিত বিষয় জানতে চায় দুদক। এ বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, কমলাপুর আইসিডি, বেনাপোল, মোংলা ও পানগাঁও কাস্টম হাউস কমিশনারকে অবহিত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়ে দুদক সক্রিয় হলে এটি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি আমি। কারণ, অর্থ পাচারের দুটি পথ- একটি হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং, অপরটি আন্ডার ইনভয়েসিং। এ বিষয়ে দুদক কাজ করলে ভালো হবে। কারণ, বছরে ৯-১০ বিলিয়ন অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বিদেশে অর্থ পাচার করে দিচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। দুই প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। সেখানে আরও বলা হয়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশ ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি। এ ব্যাপারে জিএফআইর সিনিয়র ইকোনমিস্ট রিক রাউডেন ই-মেইলে জানান, অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে তথ্য দিয়ে আসছে। কিন্তু ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি দেশটি।
এনবিআরের কাছে পাঠানো দুদকের চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালামাল আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা সংঘটিত করে থাকে। এক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে কিছু সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তা। এ ধরনের মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় সরকারি কর্মচারী সরাসরি বা পরোক্ষভাবেও জড়িত থাকে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে এরূপ ওভার ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা উদ্ঘাটনের পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিশেষ করে জরিমানা আদায়, মামলা রুজু, লাইসেন্স বাতিলের মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, বেশি অর্থ পাচার হয়ে থাকে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির অন্তরালে। বিশেষ করে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। চিঠিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, আমদানি ও রফতানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে ৫৯২ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অধিকাংশ অভিযোগই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এর আগে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা মামলা রুজু না হওয়ার বিষয়ে তথ্য জানানোর জন্য একাধিকবার অনুরোধ করা হয় এনবিআরকে। এছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই তিন মাসে দেশের ভেতর ওভার ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা জড়িত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাঠানোর জন্যও কমিশনার এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, কমলাপুর আইসিডি, বেনাপোল, মোংলা ও পানগাঁওয়ের কাস্টম হাউসকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সেখানে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট দফতরকে অধিচয়নকৃত তথ্য দ্রুত দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হল।
দুদকের অপর চিঠিতে বলা হয়, এনবিআর কর্তৃক ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি বা মানি লন্ডারিংয়ের যেসব ঘটনা উদ্ঘাটন হয়েছে, এর তালিকা সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর আন্ডার ইনভয়েসিং ও মিস ডিক্লারেশনের কিছু তথ্য প্রেরণ করেছে। এই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আন্ডার ইনভয়েসিং ও মিস ডিক্লারেশনের ঘটনায় জরিমানা আদায় করা হলেও অপরাধ সংঘটনের দায়ে কোনো মামলা রুজু করা হয়নি। ফলে কেন মামলা রুজু করা হয়নি, এর কারণ দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয় ওই চিঠিতে।
