করোনার মধ্যেই ভ্যাট রিটার্ন, ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ
ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগের আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক : মোহাম্মদ আলী খোকন
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাসের ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে; কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মার্চ মাসের ভ্যাট রিটার্ন ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ব্যবসায়ীদের জমা দেয়ার তাগিদ দিয়েছে।
তা না-হলে আইন অনুযায়ী জরিমানা গুনতে হবে। এ জন্য ভ্যাট কমিশনারেটগুলো খোলা রাখতে এনবিআর বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে ভ্যাট দেয়ার এই নির্দেশনা ব্যবসায়ীরা মেনে নিতে পারছেন না।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর কয়েকজন নেতা যুগান্তরের কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, যেখানে সবকিছু বন্ধ; মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না, সেখানে এখন ভ্যাটের দেয়া-নেয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয়।
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বিভিন্ন প্যাকেজ সহায়তা নিয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এনবিআরকেও এখন সে রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে।
এই সংকট কবে কাটবে এবং ততদিনে শিল্পকারখানাসহ সামগ্রিক অর্থনীতির কী হবে-সেটিই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশ এ রকম চিন্তাকে সামনে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আপৎকালীন সময় কাটিয়ে উঠতে ভারত জিএসটি (পণ্য ও পরিষেবা কর) হিসাব জমা থেকে সাময়িক ও বিলম্ব সুদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তাই এসব ভ্যাট শুল্ক আদায়ের পরিবর্তে আমাদের এখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বেশি সময় দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ১০ এপ্রিল ভ্যাটের দাখিলপত্র জমা দেয়ার সুবিধার্থে এনবিআর ১২ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের সব ভ্যাট সার্কেল অফিস সীমিত পরিসরে অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এ সময়ে কর্মকর্তারা করোনাসংক্রান্ত সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিশনাররা এ বিষয় মনিটর করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এখন মহাদুর্যোগ চলছে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী জরুরি ছুটি দিয়ে সবাইকে ঘরে থাকতে বলেছেন। অনেক জায়গা লকডাউন অবস্থায় আছে।
এই অবস্থায় কীভাবে ভ্যাট রিটার্ন দেয়া সম্ভব, তা বোধগম্য নয়। অফিসই খুলব কীভাবে, আর কর্মকর্তারা আসবেন কীভাবে? তিনি আরও বলেন, ছুটি শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্যবসায়ীদের রিটার্ন জমা দিতে আপত্তি নেই। তবে এই সময়ে কোনোভাবেই রিটার্ন জমা দেয়া যাবে না।
ভ্যাট আইনের ৬৪ ধারায় বলা আছে, প্রত্যেক নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত বা নিবন্ধনযোগ্য বা তালিকাভুক্তিযোগ্য ব্যক্তিকে এনবিআর নির্ধারিত পদ্ধতিতে করমেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে দাখিলপত্র জমা দিতে হবে।
অন্যদিকে আইনের ৮৫ ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে এককালীন ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। পাশাপাশি ১২৭ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত তারিখে কর পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে নির্ধারিত তারিখের পরদিন থেকে মাসিক ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ পরিশোধ করতে হবে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের প্রতিটি সংস্থা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় যার যার অবস্থান থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করেছে।
খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য দিয়েছেন।
এ বিষয়টি এনবিআরকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা ট্যাক্স-ভ্যাট দিই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যবসায়ী সমাজ যদি টিকে থাকতে না পারে, তাহলে তারা কার কাছ থেকে সুদ-আসলে এসব অর্থ আদায় করবেন?
মোদ্দা কথা, সরকার ঘোষিত ছুটিকালীন কোনো জরিমানা আদায় তো পরের কথা, আপৎকালীন পুরো সময়ের সব পাওনা তাদের মওকুফ করা উচিত।
বিটিএমএ-র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, একদিকে সরকার বলছে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, অন্যদিকে এনবিআর ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়ার কথা বলছে। বিষয়টি তো নির্বাহী বিভাগের আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তাছাড়া জীবনের চেয়ে কী আইন বড় হয়ে গেল? তিনি আরও বলেন, সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণের স্বার্থে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-কারখানা বন্ধ রেখেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে। কাজ ছাড়া শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে।
সেখানে এনবিআর কেন সামান্য আইন সংশোধন করতে পারে না। তিনি জানান, বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আমরা এনবিআরে চিঠি দিয়েছি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে মার্চ মাসে দোকান মালিকরা ব্যবসা করতে পারেননি। সরকার এবং চিকিৎসকরাও এপ্রিল মাসকে সংকটপূর্ণ মাস বলছেন। জীবনমরণ যুদ্ধ চলছে।
এ অবস্থায় কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষেই রিটার্ন জমা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, কোনো কর্মচারী নেই, কাগজপত্রও নেই। তাহলে কীভাবে দেবেন? ফলে জুন মাসে ব্যবসায়ীরা রিটার্ন জমা দেবেন এবং ভ্যাট পরিশোধ করবেন।
তিনি আরও বলেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। এখন করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। তাই রাজস্ব লক্ষ্য পূরণে এনবিআর ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখাতে পারে না।
এদিকে গত ৯ এপ্রিল এফবিসিসিআই থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে রিটার্ন জমার সময়সীমা পেছানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করা অনেক করদাতার পক্ষেই সম্ভব হবে না।
এ অবস্থায় জরিমানা ব্যতীত রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানায় ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠন।
ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে রিটার্ন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে আইনে বিকল্প রাখা হয়নি। এ কারণে রিটার্ন জমার সময় পেছাতে পারছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আইনে বিষয়টি রাখা হয়েছে।
তারা বলছেন, এনবিআরের উচিত হবে, এ সংকটকালীন মুহূর্তে প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারি করে রিটার্ন দাখিল বন্ধ রাখা। এতে ব্যবসায়ী এবং কর্মকর্তা উভয় পক্ষই উপকৃত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভ্যাট কমিশনারেটের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তারা যুগান্তরকে বলেন, পিপিই ছাড়া চিকিৎসকরা যেখানে বর্তমানে সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে ভয় পাচ্ছেন, সেখানে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ ছাড়াই ভ্যাটদাতাদের সেবা দিতে বলা হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাবা উচিত। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের মূসক বাস্তবায়ন অণুবিভাগের সদস্য জামাল হোসেন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
অবশ্য নাম প্রকাশ না-করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ভ্যাট আইনটি নতুন। এটি এ বছরই প্রথম চালু হয়েছে। আইনটিতে এনবিআরকে রিটার্ন দাখিল করার সময় বর্ধিত করার জন্য ক্ষমতায়ন করা হয়নি। আগামী বাজেটের সময় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে।
রিটার্নের তথ্য জানতে সার্কেলে চিঠি : এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী রোববার ভ্যাট সার্কেল অফিসগুলো সীমিত আকারে খোলা রাখা হয়। একজন ক্যাডার কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা রিটার্ন গ্রহণ করেন।
এনবিআর থেকে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা জানতে ভ্যাট কমিশনারেটগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে সার্কেল সংখ্যা, সব সার্কেল খোলা ছিল কি না, জমা পড়া দাখিলপত্রের পরিমাণ, রাজস্ব আদায়, কর্মরত কর্মকর্তারা করোনা সম্পর্কিত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন কি না এবং কোনো সমস্যা ছিল কি না, তা পৃথক চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়।
