Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সানেমের পর্যালোচনা

গতানুগতিক ধারার প্রস্তাবিত বাজেট

Icon

যুগান্তর রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গতানুগতিক ধারার প্রস্তাবিত বাজেট

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক ধারার- এমন মন্তব্য করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে বাজেটটি যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমন হয়নি। শনিবার ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংস্থাটির ভার্চুয়াল পর্যালোচনায় বক্তরা এসব মন্তব্য করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের নেতৃত্বে আলোচনার প্যানেলে ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সংস্থাটির পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ও সানেমের গবেষণা ফেলো মাহতাব উদ্দিন ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ইশরাত শারমীন। ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ জুমের মাধ্যমে এ বাজেট পর্যালোচনায় প্রায় সত্তর জন অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষক, উন্নয়ন কর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী যুক্ত ছিলেন।

ড. সেলিম রায়হান বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজেট প্রণয়নের চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যেমন হওয়া দরকার ছিল, তেমন হয়নি। বাজেট অন্যবারের মতো গতানুগতিক ধারাতেই প্রণয়ন করা হয়েছে, যেটি বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে সেটি প্রশংসনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়নের ওপর নিয়মিত তথ্য প্রদান করা উচিত। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকৃত বাজেটের সঠিক ব্যবহারের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সক্ষমতার অভাব নিয়ে আলোচনা করা দরকার ছিল। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পাওয়া এবং জনগণের কাছে সেটি সহজলভ্য করে তোলার জন্যও বাজেটে বরাদ্দ থাকার দরকার ছিল। ড. রায়হান আরও বলেন, বাজেটের বেশকিছু ধারায় তথ্য-উপাত্তের অসঙ্গতি চোখে পড়ে। এটি নিয়ে সাবধান হওয়া উচিত। যেহেতু ভুল তথ্য-উপাত্তের ফলে ভুল নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ হতে পারে।

নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন যারা, তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু নেই এবং এক্ষেত্রে আরও বিস্তৃতভাবে নগদ ও খাদ্য সহায়তা, বেকার ভাতা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত।

কালো টাকা সাদা করা নিয়ে ড. রাহয়ান বলেন, এই ধরনের পদক্ষেপ অতীতেও কোনো সুফল বয়ে আনেনি, বরং সৎ লোকদের নিরুৎসাহিত করেছে। একই সঙ্গে এই ধরনের পদক্ষেপ সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। তিনি বলেন, বাজেটে পোশাক শিল্পকে যে পরিমাণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অন্য রফতানি শিল্পকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ব্যাংকিং সেক্টরের সংকট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে বাজেট ও প্রণোদনা প্যাকেজ উভয়েরই আংশিক অর্থায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টরের যে সংকটগুলো আছে, সেটির মধ্যে থেকে এটি সম্ভব কি না সেটি একটি প্রশ্ন। বাজেটে এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা থাকা দরকার ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি হলেও সেটি তেমন কোনো সমস্যা নয়।

তবে বাজেট অর্থায়নের জন্য রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট ধরা হয়েছে সেটি অবাস্তব। এজন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফএর কাছ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার ওপর জোর দিয়ে আলোচনা করতে হবে। তবে রাজস্ব আদায়ের জন্য স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ মোকাবেলা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্টের অর্থায়ন কর্তন করতে হবে।

ড. রায়হান সানেমের প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ তিন বছর দেরি করানো দরকার। কারণ এলডিসি উত্তরণ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বেশকিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে, যেটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলতে পারে। এ প্রসঙ্গে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব। বাজেটে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। কিন্তু সেটিকে কাজে পরিণত করাই চ্যালেঞ্জ। রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাবের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু হলে এমন হতে পারে যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেমনটা ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় হয়েছিল।

ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাজেটে শহরের ভাসমান দরিদ্রদের জন্য তেমন কিছুই নেই। অন্যদিকে যুব এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যও যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি । তিনি বলেন, প্রণোদনা দেয়ার পরও পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ছাঁটাই হয়েছে। বাজেটে নারীদের জন্য, বিশেষ করে বর্তমান সংকটে দুরবস্থায় পড়া নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট তেমন কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। পারিবারিক সহিংসতা মোকাবেলায় শক্তিশালী পদক্ষেপের ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল বাজেটে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন ব্যবসায় প্রণোদনা ও মোবাইল ব্যবহার সুবিধাজনক করার জন্য বাজেটে ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। প্রশিক্ষণের ওপর আরও জোর দেয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, এটি প্রশংসনীয় যে, বাজেটে ন্যানো টেকনোলজি এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ওপর মনোযোগ দেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল। তিনি আরও বলেন, জাতীয় পর্যায়ে কৃচ্ছ তাসাধন যেমন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কর্তন ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় ভাতা কর্তন ইত্যাদি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার ছিল।

মহামারীর ফলে মধ্য আয় ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর সন্তানদের শিক্ষার ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেটি নিয়ে আলোচনা করেন মাহতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, মহামারীর পরে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে। বাল্যবিয়েও বাড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশনে দেরি হলে সেটি তাদের সারা জীবন প্রভাবিত করবে। স্কুল ভর্তি কমে গেলে প্রজন্মান্তরে এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জগুলো বাজেটের গতানুগতিক ধারার চিন্তা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

ইশরাত শারমীন বলেন, যে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের দেশীয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাজেটে আরও মনোযোগ দেয়া দরকার ছিল।

বাজেট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম