নীতিমালা কঠোর
প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে ধীরগতি
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কঠোর নীতিমালার দোহাই দিয়ে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না ব্যাংকগুলো। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত ৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের ৮২ হাজার কোটি টাকা থেকে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। মাত্র একটি প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অন্য প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে চলছে ধীরগতি। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোদমে কাজ শুরু করেনি।
এদিকে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কঠোর নীতিমালা শিথিল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও একের পর এক নীতিমালা শিথিল করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে চাপ দিচ্ছে দ্রুত ঋণ বিতরণ করার জন্য। এদিকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জোর দাবি উঠেছে।
যেসব ব্যাংক বাস্তবায়নে গড়িমসি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও করা হয়েছে। রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায় প্যাকেজ বাস্তবায়নে ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত তা বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়।
এদিকে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্যাকেজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। এসব শর্ত মেনে দ্রুত ঋণ ছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ঋণ আদায়ের পুরো দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর। কোনো কারণে ঋণ আদায় না হলে প্রণোদনা বাবদ যে অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেবে।
জানা যায়, ব্যাংকগুলোয় প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণের জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আবেদন করলেও তারা ঋণ অনুমোদন ও ছাড়ে গড়িমসি করছে। অনেক শাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত প্যাকেজের নীতিমালার কপিই পৌঁছেনি। ফলে সংশ্লিষ্ট শাখা প্রণোদনার ব্যাপারে কিছুই জানে না। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে ব্যাংকের শাখাগুলো প্রণোদনার আওতায় ঋণ দেয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য ব্যাংকে ধরনা দিয়েও কোনো আশার বাণী পাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সবকিছুই নিয়ম মেনে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগে চুক্তি করা হয়েছে। প্যাকেজের অর্ধেক তারা দেবে আর বাকি অর্ধেক আমরা দেব। এখন ব্যাংকগুলো আবেদন পাঠাচ্ছে। যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। দ্রুত প্যাকেজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কর্মীদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ পুরো বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে শুরুর দিকে শর্তের কারণে টাকা থাকা সত্ত্বেও সব উদ্যোক্তার মধ্যে ঋণ বিতরণ সম্ভব হয়নি শর্ত মানতে না পারার কারণে। এখন পর্যন্ত বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা থেকে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সেবা খাত হিসেবে বাংলাদেশ বিমানেরই রয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ও প্রাক-জাহাজীকরণ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে ধীরগতিতে। এ দুটি তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ হলে দ্রুত আদায় করা সম্ভব। কেননা এর বিপরীতে রফতানি আয়ের গ্যারান্টি থাকে। তবে চাহিদা কম বলে বেশি ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ক্ষুদ্রঋণ খাতে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিলের বিষয়ে ৪০টি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইসব ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে এসব ঋণ দেবে। তারা সেগুলো মাঠপর্যায়ে বিতরণ করবে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ বিতরণ করা হয়নি। সোমবার অনুষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) পর্ষদ সভায় দ্রুত ঋণ বিতরণ করার তাগিদ দেয়া হয়।
চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা জুনের মধ্যে বিতরণ করার কথা। আরও কয়েকটি তহবিলের আকার ২০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
মার্চ-এপ্রিলে এ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ আসে, অনেকেই ঋণের জন্য আবেদন করেছেন, কিন্তু ব্যাংকগুলো অনুমোদন দিচ্ছে না। বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর প্রণোদনার প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
বলা হয়, যারাই ঋণের জন্য আবেদন করেছেন, যাচাই-বাছাই করে ঋণ পাওয়ার যোগ্য হলে দ্রুত ঋণ ছাড় করতে হবে। আর যদি ঋণ পাওয়ার যোগ্য না হন, তা-ও দ্রুত গ্রাহককে অবহিত করতে হবে। দ্রুত বলতে ৫ কার্যদিবসকে ধরা হয়। নতুন গ্রাহককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন নির্দেশনা পাওয়ার পর ব্যাংকগুলো অনেকটা নড়েচড়ে বসে। তারা বিভিন্ন গ্রাহক থেকে প্রাপ্ত ঋণের প্রস্তাব নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদন নিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে শুরু করেছে। তবে যেভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা উদ্যোক্তারা আশা করছেন, সেই গতিতে দেয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, কেবল সবকিছুর চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। শ্রমিকদের বেতনের প্যাকেজ প্রায় শেষ। অন্যান্য প্যাকেজ প্রক্রিয়াধীন। শত শত আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা আছে। সেগুলো অনুমোদন হলে অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, রফতানিমুখী শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দুই মাসের দেয়া হয়েছে। আর চলতি মূলধন ঋণও কিছু দেয়া হয়েছে। বাকিটা প্রক্রিয়াধীন। তবে এসএমই ঋণের প্যাকেজ বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ এখানে অনেক হিসাবনিকাশ করতে হচ্ছে। তাই যাচাই-বাছাই করতে বিলম্ব হচ্ছে। এ টাকা আদায়ে সব দায়িত্ব ব্যাংকারের। সুতরাং যাকে-তাকে ব্যাংকার টাকা দিয়ে বিপদে পড়তে চাইবে না- এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় পর্ষদ সদস্যরা প্রণোদনার প্যাকেজ কী পরিমাণ বাস্তবায়ন হয়েছে, তা জানতে চান। কিন্তু ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ থেকে যে তথ্য দেয়া হয়, তা মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। এতে পর্ষদ ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রণোদনার টাকা কীভাবে দ্রুত ছাড় বা অনুমোদন দেয়া যায়, সেবিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পর্ষদ সদস্য যুগান্তরকে বলেন, এমন মহামারীতে ব্যাংকারদের যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, তার ধারে-কাছেও নেই। বিষয়টি নিয়ে পর্ষদ সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। একই সঙ্গে প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়নে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
