করোনার প্রভাব মোকাবেলা
অর্থনীতি স্বাভাবিকে সবার অংশগ্রহণ জরুরি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: টাকার মান ধরে রাখতে সাপোর্ট দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক * ২০২০ সাল হবে সংকটময় এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জিং
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সব খাতের অংশীজনদের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সবার কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক খাতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
কিন্তু প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুবই ধীর। এ কারণে প্যাকেজ থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের কাছে টাকার জোগান যাচ্ছে না। ফলে উদ্যোক্তারা পুরোদমে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারছে না।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজগুলো থেকে মাঠপর্যায়ে দ্রুত ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। তারপরও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো হয়ে গেছে ব্যাংকনির্ভর। ব্যাংকগুলো করোনার আগেই বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছিল না। রাজনৈতিক চাপে নানা ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। ফলে করোনার ক্ষতির মধ্যে এখন ঋণ বিতরণ করে আদায় করা কঠিন হবে।
এ কারণে ব্যাংকগুলো সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এখন দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ঋণ নিলে যৌক্তিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে। না করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করা হবে। তাহলেই কেবল ঋণ বিতরণ বাড়বে।
প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বেসরকারি ব্যাংকের একজন এমডি বলেছিলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ দেব। তবে ঋণ যে আদায় হবে সে বিষয়ে গ্যারান্টি চাই। সূত্র জানায়, এ অবস্থায় মাঠপর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
এতে দেখা যায়, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোদমে সক্রিয় হয়নি। যে কারণে ঋণ পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের যেসব কাগজপত্র বা সদন দরকার সেগুলো তারা সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে ঋণ পাওয়ার শর্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় ব্যাংকগুলোও ঋণ বিতরণ করতে পারছে না।
বিশেষ করে নতুন ও ছোট পুঁজির ব্যবসার ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। তবে বড় শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেয়া হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে দেশের সার্বিক অনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু করোনার পর সেই স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটেছে। এখনও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত পর্যায়ে চালু রয়েছে।
পুরোপুরি চালু হতে আরও সময় লাগবে। অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সরকারি ও বেসরকারি সব খাতের আন্তরিক ও সক্রিয় অংশ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে গতি আনা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২০ সালটি বাংলাদেশের সবার জন্য সংকটময় এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জিং হবে। এর মধ্যে রিয়েল সেক্টরে (শিল্প খাত) উৎপাদন চাঙ্গা করা, পণ্য পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা, অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউসগুলোকে (হাটবাজার, দোকানপাট) আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা হবে বড় চ্যালেঞ্জিং। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে স্বাস্থ্য খাতে।
কেননা করোনার কারণে মানুষ এখন আতঙ্কিত। এ কারণে অনেকেই বের হচ্ছেন না। ফলে মানুষের চলাচল কমে গেছে। এতে সারা দেশে টাকার প্রবাহ ছড়িয়ে পড়তে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি অর্থ একটি শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। ফলে একপক্ষের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, আরেক পক্ষের আয় কমে গিয়ে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। এদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনরা একত্র হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি প্রসারিত না করা পর্যন্ত করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ধরনের আর্থিক পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, পণ্য সরবরাহকারী এবং সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রকদের জাতীয় স্বার্থে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে যথাযথ পরিশ্রম, পরম আন্তরিকতা ও সততার সাথে এগিয়ে আসাটা এখন জরুরি।
প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে, সরবরাহ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে এবং সব খাতকে পুনরুদ্ধার করতে সবার অংশগ্রহণ করতে হবে। তাহলেই অর্থনীতিকে দ্রুত আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পর আরো সমৃদ্ধির জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে নতুন দিগন্তের দিকে এগোনো সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনীতিবিষয়ক একজন গবেষক বলেন, আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতি বা অন্য কোনো কারণে বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে। একসঙ্গে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েনি।
এবার করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে। ফলে সব দেশেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যে কারণে দ্রুত অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় আসার সুযোগ নেই। তবে বিশ্ব ও দেশের অর্থনীতির গতিবিধি পর্যালোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব কিছু খাতকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেভাবেই উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, আমার কথা হচ্ছে আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে ও ক্ষুদ্রঋণ খাতে এখনো আমানত প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে সহজ শর্তে ও কম সুদে টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকির ক্ষেত্রে নীতি সহায়তায় দেয়া হয়েছে বড় ছাড়। ফলে তাদের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বেড়েছে।
এখন মাঠপর্যায়ে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে। এতে আরও বলা হয়, বীমা খাতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। খাতটি বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আমদানি রফতানি বাণিজ্য ও দেশের ভেতরের ব্যবসা বাণিজ্য স্বাভাবিক করার মাধ্যমেই এ খাতটিকে ক্ষতি পুষিয়ে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে গেলেও বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান এখনও স্থিতিশীল আছে। এটা ধরে রাখার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিরাপদ মাত্রায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৎপর রয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ও নামমাত্র বা বিনা সুদের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও লম্বা সময় থাকবে। এতে বিশ্বব্যাপী মুদ্রার মান আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের টাকার ওপরও আসতে পারে। তবে বাজারে যাতে ডলারের দাম না বাড়ে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারকে সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে।
