সরকারি কমিটির প্রতিবেদন
রক্ষণাবেক্ষণ ‘কর্তৃপক্ষ’ নেই রাজধানীর ১২ খালের
ওয়াসার নিয়ন্ত্রণাধীন ২৬টি খালের বিভিন্ন অংশ বেদখল * খালের প্রবাহ না থাকায় ভারি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধ রাজধানী
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় অবস্থিত ১২টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এসব খাল দখল ও দূষণে জর্জরিত। এর বাইরে আরও ২৬টি খাল রয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
এসব খালেরও বিভিন্ন অংশ দখল করে আছে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, হাসপাতাল, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। খালগুলোয় নির্বিঘ্নে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা।
এ তালিকায় রয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনও। কয়েকটি খাল উদ্ধারে গেলে ওয়াসার কর্মীদের বাধা দেয়া হয়। এসব কারণে কয়েকটি খালের প্রবাহ বন্ধ রয়েছে। যেসব খালের প্রবাহ সচল রয়েছে, সেগুলোর বর্জ্য আবর্জনাসহ পানি পড়ে ঢাকার চারপাশের নদী দূষণ করছে। তৈরি করছে নাব্য সংকট।
নদী রক্ষা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভায় জমা দেয়া সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক কমিটির প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খালগুলো পুরোপুরি সচল না থাকায় মাঝারি বা ভারি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীতে। এর দায় চাপছে ওয়াসার কাঁধে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে টাস্কফোর্সের ওই সভায় নদী ও খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত এবং সিটি কর্পোরেশনের ময়লা-আবর্জনা খাল ও নদীতে ফেলা বন্ধের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া খালগুলো আবারও জরিপ করতে স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে ৭টি সংস্থা ও প্রশাসনের যৌথ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর খালগুলোর ওপর একটি প্রতিবেদন টাস্কফোর্সের সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। খালগুলো এককভাবে ওয়াসার তত্ত্বাবধানে নেই, তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছেও পাঠানো হবে। তখন বোঝা যাবে কার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু খাল রয়েছে। তিনি বলেন, খালগুলোর দখল ও দূষণ রোধে নেয়া চলমান পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদনদীর নাব্য ও স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভা ৬ সেপ্টেম্বর নৌ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ভিডিও, স্থিরচিত্র ও পাওয়ার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে খালগুলোর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন এ সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ও নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অনল চন্দ্র দাস।
নদী রক্ষা কমিশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা, পরিবেশ অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতিনিধিরা এ কমিটির সদস্য ছিলেন। তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করার কথা সভায় জানিয়েছেন।
ওই সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংস্থাপ্রধানরা সরাসরি ও ভার্চুয়ালভাবে সংযুক্ত হন।
ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ১২টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। সেগুলো হচ্ছে- গোবিন্দপুর খাল, পুরাতন গাবতলী খাল, রায়েরবাজার খাল, নারিন্দা খাল, অতীতে খননকৃত ধোলাই খাল, জলকুড়ি খাল, শ্যামপুর খাল, কদমতলী খাল, আফতাবনগর লেক, গজারিয়া খাল, আটির খাল ও রানাভোলা খাল। সব খালেই কমবেশি দখল ও দূষণ রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গাবতলী খালটি মিরপুর খাল নামেও পরিচিত। এটি মাজার এরিয়া থেকে কল্যাণপুর হয়ে বেড়িবাঁধ স্লুইচ গেটে শেষ হয়েছে। নিউমার্কেট গাবতলী সড়কের পূর্বপাশের খালের বিরাট অংশ রিয়েল এস্টেট দখল করেছে। আর রোডের পশ্চিম পাশে মেট্রো রেল প্রকল্পের মিক্সার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। নিউমার্কেট-গাবতলী রোডে খালের উপর করা বক্সকালভার্ট স্থাপন ঠিক হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অবৈধ দখল রোধে অভিযানের সুপারিশ করা হয়েছে। রায়েরবাজার খালের ধানমণ্ডি মধুবাজার থেকে কাঁটাসুর পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন রাস্তা নির্মাণ করে এটিকে নর্দমায় রূপান্তর করেছে। ফলে খালের দুই পার দখল হয়েছে। বেড়িবাঁধ থেকে তুরাগ সংযোগ পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানি, সিকদার মেডিকেল দখল করেছে। বস্তি এলাকায় দখল-দূষণ প্রকট। এ খালটি তুরাগ নদ দূষণ করছে। একইভাবে অন্য খালগুলোয় দখল ও দূষণ রয়েছে।
এছাড়া ওয়াসা নিয়ন্ত্রিত ২৬টি খালেও কমবেশি দখল ও দূষণ রয়েছে। এ তালিকায় সিটি কর্পোরেশন, হাসপাতাল, হাউজিং কোম্পানিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত আবদুল্লাহপুর খালে তেমন দখলদার নেই। তবে খালের উত্তরা অংশে প্রচুর ময়লা ফেলা হয়েছে।
মিরপুরে অবস্থিত বাইশটেকী খালের প্রবাহ সচল রয়েছে। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা ফেলে দূষণ করা হচ্ছে। মিরপুরে অবস্থিত বাউনিয়া খালের উপরের অংশে অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এ খালের স্বাভাবিক প্রবাহ নেই। হাতিরঝিল-গুলশান এলাকায় অবস্থিত বেগুনবাড়ি খালের বেশকিছু জায়গা দখল করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ফুটপাত ও ড্রেন তৈরি করেছে।
খালের জায়গায় ময়লার স্টেশন ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে খালটি সচল রয়েছে। ডেমরা এলাকায় অবস্থিত দেবধোলাই খালটি সানারপাড় থেকে মান্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত। খালের পাড় দখল করে রাস্তা বানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। খালের পাশের অস্থায়ী বাজার ও দোকানপাট আছে। এসব বাজার থেকে ময়লা ফেলে দূষণ করা হচ্ছে।
গোড়ান এলাকায় অবস্থিত দিগুন খাল দখল করে ইস্টার্ন হাউজিং ও রামকৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। হাজারীবাগ খালের বেড়িবাঁধের ভেতরের অংশ দখল করা হয়েছে। ময়লা ফেলে এটিকে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। ইব্রাহিমপুর খালে কিছু অবৈধ দখল থাকলেও এটি সচল রয়েছে। মুগদার জিরানী খালের একপাশ দখল করে রাস্তা নির্মাণ করেছে সিটি কর্পোরেশন। রয়েছে কাঁচা বাড়িঘর ও অস্থায়ী বাজার।
কল্যাণপুর প্রধান খালের অংশ দখল করে এসটিএস তৈরি করা হয়েছে। ভাঙা ব্রিজের কাছে অবৈধ দখল রয়েছে।
কল্যাণপুর খাল-১ এর বেশির ভাগ এলাকা দখল করে বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছে। এ খালটি অচল হয়ে আছে। কল্যাণপুর-২ খালের অংশ দখল করে রাস্তা নির্মাণ করেছে সিটি কর্পোরেশন।
কল্যাণপুর-৩, কল্যাণপুর-৪, কল্যাণপুর-৫ ও কাঁটাসুর খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে হাউজিং, জিটিসিএল’র রাস্তা, ট্রাক স্টেশন ও অস্থায়ী বাজার বসানো হয়েছে। মান্ডা খালে সিটি কর্পোরেশন সরাসরি ময়লা ফেলছে। কিছু কিছু জায়গা বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি দখল করে রেখেছে।
রাজচন্দ্রপুর খালের মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির বস্তি ও সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর হাউজিং ও মোহম্মদিয়া হাউজিংয়ের কারণে রামচন্দ্রপুর এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। রামচন্দ্রপুর ও কাঁটাসুর খালের সংযোগ-মুখে জায়গা দখল করে আছে জাকের ডেইরি ফার্ম ও ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি।
মিরপুরের রূপনগর খালের অর্ধেক দখল করে সিটি কর্পোরেশন রাস্তা নির্মাণ করেছে। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ভেতরের অংশে খাল দখল করা হয়েছে। সাংবাদিক কলোনি খাল, সেগুনবাগিচা খাল, শাহজাদপুর খাল, সুভিভোলা খাল ও কাসাইবাড়ী খালের জায়গা দখল করে অস্থায়ী বাজার বসানো হয়। এসব বাজার থেকে ময়লা খালে ফেলানো হয়। তবে ব্যতিক্রম মহাখালী খাল। এ খালটিতে কোনো অবৈধ দখলদার নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান যুগান্তরকে বলেন, খালগুলোর ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশনসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত। খালগুলোর মালিকানা জেলা প্রশাসকের ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সুতরাং সব দায় ঢাকা ওয়াসার ওপর চাপালে চলবে না। এটা ওয়াসার ম্যান্ডেটও নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৃষ্টির পানি খালগুলো দিয়ে যাতে নদীতে বের হতে পারে, শুধু সেই কাজটাই ওয়াসার। ওয়াসা এ বছর ৮০ কিলোমিটার খালের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার পরিষ্কার করেছে। বৃষ্টির সময়ে পানি দ্রুত নামতে স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগ দিয়েছে।
