চন্দ্রপাহাড় ঘিরে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প
হোটেল নির্মাণে বিরোধিতা
মাসুদ করিম, বান্দরবান থেকে
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চন্দ্রপাহাড়ের মেঘগুলো যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ ফুট উপরে পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রপাহাড়। উপরে বিস্তৃত নীল আকাশ। নিচে সবুজের গালিচা। সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং থেকে শুরু করে যেদিকে চোখ যায়, দিগন্তরেখা পর্যন্ত শুধু ছোট-বড় পাহাড়।
গোধূলির আলো-আঁধারিতে সূর্যাস্তের লাল আভার সঙ্গে ভেসে উঠে সাগরের ঢেউ, নোঙর করা জাহাজের সারি। সূর্যোদয়ের সময় তাকালে চোখে পড়ে সাঙ্গু নদীর আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ জলের ধারা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন এক অপার সৌন্দর্য অবগাহনের স্থান চন্দ্রপাহাড়, যাকে ঘিরে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প।
শুধু ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হাতছানি দেয়। কোভিড-১৯ মহামারীকালেও পাহাড়ে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। হালকা শীতের আমেজে আনন্দ উপভোগের ব্যাকুলতা থাকলেও হোটেলসহ আধুনিক পর্যটন সুবিধার অভাব প্রকট।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও পোশাক পর্যটকদের কাছে সহজে বিক্রি করতে পারবে। পর্যটনভিত্তিক ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। পর্যটকদের চলাচলে পরিবহন খাতে কর্মসংস্থানসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নতি হতে পারে। তবে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, শিল্পের কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জুমচাষ ব্যাহত হতে পারে। এ কারণে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা; বিশেষ করে হোটেল ও রিসোর্টে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনো কোনো মহল বিরোধিতা করছে। যারা আগে এ অঞ্চলে মেডিকেল কলেজসহ অন্যসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিরোধিতা করেছিলেন, এবার তারা পর্যটনের জন্য পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণেও বিরোধিতা করছেন। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মনে করে, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এ কারণে গ্রুপগুলো বিরোধিতার পাশাপাশি মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে স্থানীয় জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তাদের সঙ্গে কোনো কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি সুর মেলালেও মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্রের সঙ্গে পর্যটন বিরোধীদের তথ্যের কোনো মিল পাওয়া যায় না। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো আরও বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবছর ৪০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। অঞ্চলটির উন্নতি হলে চাঁদাবাজির পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। উন্নয়ন বিরোধিতার সঙ্গে এরও যোগসূত্র থাকতে পারে।
২০১৫ সালে সরকার বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গাজুড়ে বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের অনুমতি দেয়। ২০১৬ সালের ১২ জুন আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে আরএনআর গ্রুপ পাঁচতারকা ম্যারিয়ট হোটেল স্থাপনে চুক্তি করে। সম্প্রতি হোটেলটির নির্মাণকাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে।
বিরোধিতাকারীদের দাবি, ম্রো সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু সরেজমিনে চন্দ্রপাহাড়ে গিয়ে জানা যায়, পাহাড় কিংবা তার আশপাশে কখনোই কোনো বসতি ছিল না। এটি জনবসতিহীন পাহাড়। জায়গাটি নীলাচল রিসোর্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে।
চন্দ্রপাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে পাশের কালেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য অর্জুন ম্রো যুগান্তরকে বলেন, এখানে কোনো বসতি ছিল না। তবে পাহাড়টি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি ম্রো পল্লী আছে। সেখানে ৩০টি পরিবার বসবাস করে। তাদের উচ্ছেদের কোনো প্রশ্নই আসে না। তিনি মনে করেন, পাঁচতারকা হোটেল হলে এলাকার গরিব মানুষের উপকার হবে। তিনি বলেন, এখন এক মণ পেঁপে তারা ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু এ অঞ্চলে পর্যটকরা এলে প্রতিটি বড় আকারের পেঁপে তারা ১০০ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি করতে পারবেন। তিনি বলেন, পাঁচতারকা হোটেল ও রাস্তা হওয়ায় তারা খুশি। তবে হোটেলটির জন্য লিজ নেয়া ২০ একর জায়গা ভবিষ্যতে যেন আর বাড়ানো না হয়।
অর্জুন আরও জানান, হেডম্যান ও কারবারীরা নিরীহ ম্রো সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে জুমচাষের জন্য পাহাড় ভাগ করে দেন। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ম্রো সম্প্রদায় দূরে বসবাস করলেও জুমচাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিলে ধোঁয়া ও উত্তাপ আসতে পারে। তিনি বলেন, ম্রো সম্প্রদায় খুবই গরিব। তিনি নিজেও দরিদ্র মানুষ। সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য মিশনারিদের সাহায্য পেতে তাই তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
হোটেল নির্মাণের জন্য ১০ মাস ধরে স্থানটিকে প্রস্তুত করছেন ম্যারিয়ট হোটেল ও রিসোর্টের সাইট ম্যানেজার রাজু। পশ্চিম দিকে আঙুল উঁচিয়ে তিনি বলেন, ওই দেখুন সাগর, সাগরে জাহাজ। দক্ষিণ পাশে লামা, থানচি ও আলীকদম। আলীকদমের পাহাড়গুলো দেখা যায়। এখানে পর্যটকরা মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। অনেক সময় আমাদের শরীরও মেঘে ঢাকা পড়ে। পূর্ব পাশে সাঙ্গু নদীর ভিউ আছে। তাজিংডং ও কেওক্রাডং পাহাড় দেখা যায়। পর্যটকরা কোথাও যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তিনি আরও জানান, পাঁচতারকা এ হোটেলে স্টাফসহ ৩০০ থেকে ৪০০ পর্যটক থাকতে পারবেন। ২৫টি কটেজ হবে। প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট থাকবে। পাঁচটি বড় ভবন হবে। গেমিং জোন হবে। ক্লাব ঘর, ফুড কর্নার ও বিলিয়ার্ড থাকবে। বাচ্চাদের গেমিং সুবিধা থাকবে। পর্যটকদের জন্য হেলিকপ্টারসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
ম্যারিয়ট হোটেলের জন্য প্রায় ৮০০ একর জায়গা নেয়া হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ অস্বীকার করে হোটেলের সার্ভেয়ার মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ২০ একর জায়গাজুড়ে হোটেল ও রিসোর্ট হবে। সাইট ইঞ্জিনিয়ার শহীদুজ্জামান বলেন, নীলগিরি থেকে চন্দ্রপাহাড় পর্যন্ত ক্যাবলকার করতে অস্ট্রিয়া থেকে প্রকৌশলী আনা হবে।
চন্দ্রপাহাড় থেকে থানচির পথে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর লোকালয়ের দেখা পাওয়া যায়। সেখানে বলীবাজারে রাস্তার পাশে মুদি দোকানি পুচিং মারমার (৫১) সঙ্গে কথা হয়; যিনি একসময় শান্তিবাহিনীতে ছিলেন। জানতে চাইলে পুচিং মারমা বলেন, হোটেল হলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে জুমচাষে ক্ষতি হবে। আমরা চাই-এলাকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা হোটেল ও রিসোর্টে যেন চাকরি পায়।
