৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ
ইতালিতে মানব পাচার
আরও ২০ হোতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডি * লিবিয়ার ১০ শহরে তাদের অর্ধশতাধিক ক্যাম্প রয়েছে
যুগান্তর রিপোর্ট
০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালিতে মানব পাচার চক্রের ছয় হোতার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুরোধে সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়। এবারই প্রথম বাংলাদেশি মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল এই পদক্ষেপ নিল।
রেড নোটিশ জারি হওয়া ছয় মানব পাচারকারী হল- মিন্টু মিয়া, স্বপন, শাহাদাত হোসেন, নজরুল ইসলাম মোল্লা, ইকবাল জাফর ও তানজিরুল ইসলাম। লিবিয়ার ১০টি বড় শহরে তাদের নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে।
সিআইডি বলছে, ভাগ্য বদলাতে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাত্রায় দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নিরুদ্দেশ হচ্ছেন অগণিত বাংলাদেশি তরুণ। নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এদের অধিকাংশেরই সলিল সমাধি ঘটে।
মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের পর লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরে হাওয়াই বোট বা কাঠের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে সব দায় সারে দালালরা। এই নৌকা ভাসিয়ে দেয়াকে তারা বলে ‘গেমিং’।
যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে তারা গেমিংয়ের হোতা। এমন আরও অন্তত ২০ জন ‘গেমিং’ হোতার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিসানুল হক যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি ইন্টারপোল ছয় বাংলাদেশির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার (আজ) সিআইডি প্রধান সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন।
এ কর্মকর্তারা জানান, ২৮ মে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে মিজদা শহরে একটি ক্যাম্পে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। এতে আহত হন আরও ১১ জন।
মানব পাচারকারীরা ৩৮ জনকে ভালো চাকরির কথা বলে ইতালিতে পাচার করার জন্য পরিবারগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে।
আরও বেশি অর্থ আদায় করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতনের ভিডিও বাংলাদেশে থাকা পরিবার বা স্বজনদের কাছে পাঠায়।
এক পাচারকারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অন্য পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হন। আহত হন ১১ জন।
ওই পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল রেড নোটিশ জারি হওয়া ছয়জন। ওই ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা ১২ জনের মধ্যে ৯ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ২৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৫টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন।
সম্প্রতি তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আমরা তথ্য পাই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেক বাংলাদেশি আটকা আছেন। এসব ক্যাম্পের অনেক দালালের বিষয়ে আমরা তথ্যও পাচ্ছি।
তবে তাদের পুরো নাম, ঠিকানা, ছবি ও পাসপোর্ট নম্বর না থাকায় আপাতত রেড নোটিশ জারি করার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে রেড নোটিশ জারি করা হবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, মিজদা শহরে নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বিভিন্ন এলাকার ছয়জন রয়েছে। লিবিয়ায় অবস্থানকারী মানব পাচারকারী তানজিরুল ইসলাম, ইকবাল জাফর এবং স্বপনের বাড়ি ভৈরবে।
তারা দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনজনই এখন লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে তাদের ক্যাম্প রয়েছে।
রেড নোটিশ জারি হওয়া নজরুল ইসলাম মোল্লার বাড়ি মাদারীপুর সদরে। শাহাদাত হোসেনের বাড়ি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। স্থানীয় মাফিয়া এবং মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব ক্যাম্পে বাংলাদেশি তরুণদের আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, লিবিয়ার বেনগাজী থেকে জোয়ারা পর্যন্ত সাগরপাড়ের ১০টি শহরে বাংলাদেশি দালালদের মালিকানাধীন অর্ধশতাধিক নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে।
এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। নির্যাতন করে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে নিরীহ তরুণদের হত্যা করা হয়। এমনকি অর্থ আদায়ের পর তরুণদের অন্য দালাল চক্র বা স্থানীয় মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
তারাও অর্থ আদায় করতে ফের নির্মম নির্যাতন শুরু করে। দালাল চক্র আর মাফিয়াদের চাহিদা পূরণ করার পরের যাত্রা যেন আরও ভয়ঙ্কর।
সব বাধা পেরিয়ে লিবিয়ার জোয়ারায় পৌঁছে হাওয়াই বোটে বা কাঠের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির পথে চূড়ান্ত যাত্রা শুরু হয়। যাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তারা ইতালিতে পৌঁছতে পারেন। বাকিদের সলিল সমাধি হয়।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ইতালিতে মানব পাচার
৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ
আরও ২০ হোতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডি * লিবিয়ার ১০ শহরে তাদের অর্ধশতাধিক ক্যাম্প রয়েছে
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালিতে মানব পাচার চক্রের ছয় হোতার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুরোধে সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়। এবারই প্রথম বাংলাদেশি মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল এই পদক্ষেপ নিল।
রেড নোটিশ জারি হওয়া ছয় মানব পাচারকারী হল- মিন্টু মিয়া, স্বপন, শাহাদাত হোসেন, নজরুল ইসলাম মোল্লা, ইকবাল জাফর ও তানজিরুল ইসলাম। লিবিয়ার ১০টি বড় শহরে তাদের নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে।
সিআইডি বলছে, ভাগ্য বদলাতে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাত্রায় দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নিরুদ্দেশ হচ্ছেন অগণিত বাংলাদেশি তরুণ। নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এদের অধিকাংশেরই সলিল সমাধি ঘটে।
মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের পর লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরে হাওয়াই বোট বা কাঠের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে সব দায় সারে দালালরা। এই নৌকা ভাসিয়ে দেয়াকে তারা বলে ‘গেমিং’।
যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে তারা গেমিংয়ের হোতা। এমন আরও অন্তত ২০ জন ‘গেমিং’ হোতার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিসানুল হক যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি ইন্টারপোল ছয় বাংলাদেশির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার (আজ) সিআইডি প্রধান সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন।
এ কর্মকর্তারা জানান, ২৮ মে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে মিজদা শহরে একটি ক্যাম্পে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। এতে আহত হন আরও ১১ জন।
মানব পাচারকারীরা ৩৮ জনকে ভালো চাকরির কথা বলে ইতালিতে পাচার করার জন্য পরিবারগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে।
আরও বেশি অর্থ আদায় করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতনের ভিডিও বাংলাদেশে থাকা পরিবার বা স্বজনদের কাছে পাঠায়।
এক পাচারকারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অন্য পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হন। আহত হন ১১ জন।
ওই পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল রেড নোটিশ জারি হওয়া ছয়জন। ওই ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা ১২ জনের মধ্যে ৯ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ২৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৫টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন।
সম্প্রতি তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আমরা তথ্য পাই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেক বাংলাদেশি আটকা আছেন। এসব ক্যাম্পের অনেক দালালের বিষয়ে আমরা তথ্যও পাচ্ছি।
তবে তাদের পুরো নাম, ঠিকানা, ছবি ও পাসপোর্ট নম্বর না থাকায় আপাতত রেড নোটিশ জারি করার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে রেড নোটিশ জারি করা হবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, মিজদা শহরে নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বিভিন্ন এলাকার ছয়জন রয়েছে। লিবিয়ায় অবস্থানকারী মানব পাচারকারী তানজিরুল ইসলাম, ইকবাল জাফর এবং স্বপনের বাড়ি ভৈরবে।
তারা দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনজনই এখন লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে তাদের ক্যাম্প রয়েছে।
রেড নোটিশ জারি হওয়া নজরুল ইসলাম মোল্লার বাড়ি মাদারীপুর সদরে। শাহাদাত হোসেনের বাড়ি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। স্থানীয় মাফিয়া এবং মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব ক্যাম্পে বাংলাদেশি তরুণদের আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, লিবিয়ার বেনগাজী থেকে জোয়ারা পর্যন্ত সাগরপাড়ের ১০টি শহরে বাংলাদেশি দালালদের মালিকানাধীন অর্ধশতাধিক নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে।
এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। নির্যাতন করে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে নিরীহ তরুণদের হত্যা করা হয়। এমনকি অর্থ আদায়ের পর তরুণদের অন্য দালাল চক্র বা স্থানীয় মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
তারাও অর্থ আদায় করতে ফের নির্মম নির্যাতন শুরু করে। দালাল চক্র আর মাফিয়াদের চাহিদা পূরণ করার পরের যাত্রা যেন আরও ভয়ঙ্কর।
সব বাধা পেরিয়ে লিবিয়ার জোয়ারায় পৌঁছে হাওয়াই বোটে বা কাঠের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির পথে চূড়ান্ত যাত্রা শুরু হয়। যাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তারা ইতালিতে পৌঁছতে পারেন। বাকিদের সলিল সমাধি হয়।