প্রতিবাদ করলেই কুপিয়ে রক্তাক্ত
পল্লবীতে ভয়ংকর সুমন বাহিনী
মাদক ব্যবসা ও জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্ম * বাহিনীতে আছে নারী সদস্যও
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর পল্লবীতে মাদক ব্যবসা ও জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে জড়িত সুমন বাহিনী। এসবের প্রতিবাদ করলে বা তাদের কথামতো কাজ না করলেই কুপিয়ে মানুষকে রক্তাক্ত করছে তারা। এ নিয়ে এক মাসের মধ্যে পল্লবী থানায় সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কোপানোর ঘটনায় দুটি এবং অতর্কিত হামলার ঘটনায় একটি।
সুমন বাহিনীতে আছে নারী সদস্যও। নারীদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে এদের সহযোগিতা নেয়া হয়। সুমন ছাড়া বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে আপন আহমেদ ওরফে আপন, সিফাত, রনি, জামান আহমেদ জামাল, লিজা, রাজন, সাগর, দুলাল, টিটু, দীপু, কাল্লু, লিটন, আবুল, বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু, রুবেল, জাকির, তাহের, হাবিব প্রমুখ। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
৪ নভেম্বর সুমনসহ তার বাহিনীর নয় সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন শান্তা আক্তার নামে এক নারী। শান্তা যুগান্তরকে বলেন, ২২ অক্টোবর বাবার সঙ্গে রাগ করে উত্তর কালশী ঘাটিপাড়া বস্তিতে বাসা ভাড়া নিই। ওই বাসাটি (মূলত বস্তিঘর) সুমনের সহযোগী আপনের। সেখানে ইয়াবা গণনার সময় আমি লিজা ও রনিকে দেখে ফেলি।
পরে তারা আমাকে ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি না হওয়ায় আপন আমাকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখায় এবং হুমকি দেয়। আমি ভয়ে ওই বাসা ছেড়ে ৩০ অক্টোবর কালাপানি ডুইপ প্লট এলাকায় বাবার বাসায় চলে আসি। ওইদিন বিকালে লিজা কৌশলে ফের আমাকে আপনের বাসায় নিয়ে যায়। সে আমাকে রুমে রেখে খাবার আনার কথা বলে পরিকল্পিতভাবে বের হয়ে যায়।
এই সুযোগে সুমন, আপন, সিফাত ও রনিসহ কয়েকজন ওই রুমে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায়। আপন ধারালো দা দিয়ে আমাকে এলাপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এতে আমার ডান হাতের কবজি গুরুতর জখম হয়। ডান হাতের দুটি আঙুল কেটে পড়ে যায়। হাতের তিনটি রগ কেটে যায়। বাম পায়ে নয়টি কোপ লাগে।
এক পর্যায়ে আমার মৃত্যু হয়েছে ভেবে আসামিরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে স্থানীয়রা আমাকে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন (পঙ্গু) হাসপাতালে ভর্তি করেন। শান্তা আক্তার বলেন, এখনও আমার চিকিৎসা চলছে। সব শেষ শনিবার অপারেশন হয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে আছি। হামলাকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরছে না।
২৪ নভেম্বর মিরপুর ১২ নম্বর সিরামিক রোডে শাহিনুদ্দিন নামে এক যুবকের চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে তাকে কুপিয়ে আহত করে সুমন বাহিনীর সদস্যরা। আগের দিন তারা শাহিনুদ্দিনকে টেলিফোনে হুমকি দিয়েছিল। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানোও হয়। এরপরও তিনি হামলার শিকার হন। হামলার ঘটনায় শাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বাদী হয়ে ২৬ নভেম্বর পল্লবী থানায় মামলা করেন।
এ মামলায় সুমনসহ তার বাহিনীর ১৪ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আকলিমা বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার ছেলে শাহিন মিরপুর ১২ নম্বর উত্তর কালশীর সিরামিক রোড দিয়ে বাসায় ফিরছিল। এমন সময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সুমন ও তাহেরের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসীরা তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়। তিনি বলেন, একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে জমি নিয়ে ঝামেলাকে কেন্দ্র করে সুমন বাহিনীর সদস্যরা এ হামলা চালায়।
২৮ অক্টোবর সুমনকে প্রধান আসামি করে তার বাহিনীর ৬ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করেন মো. বাবু। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, ২৬ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টায় আমি পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশন সিরামিক রোডের চান্দার টেকের বাইরে পাকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এ সময় সুমন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা পূর্বশত্রুতার জের ধরে আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। সন্ত্রাসী জামাল আমার নাকের ওপর ঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে। সুমন আমার ডান চোখের ওপর ঘুষি মারে।
অন্য আসামিরা কাঠের বিট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। আমি চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আসামি জাকির আমার প্যান্টের পকেট থেকে নগদ ২শ’ টাকা এবং আমার ব্যবহৃত ১টি কালো রংয়ের মোবাইল সেট ছিনিয়ে নেয়। এ সময় পথচারীসহ আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
মামলার বাদী বাবুর বাবা আবদুল মালেক মানিক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক মোহাম্মদ সুমন। তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সদস্যরা বস্তিতে মাদক ব্যবসা এবং জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত। জুয়া খেলায় বাধা দেয়ার কারণেই আমার ছেলের ওপর হামলা চালায় সুমন, জামাল ও রুবেলসহ আরও কয়েকজন। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক যুবলীগ কর্মী বলেন, কেউ যদি সুমনের কথামতো না চলে বা তার অবৈধ কাজে সহযোগিতা না করে তাহলেই সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালায়। সিরামিক এলাকায় ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না। বললেই সুমন বলে, ‘ওরা আমার লোক।’ সুমন বাহিনীর ভয়ে আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।
মো. শাহীন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার সম্বন্ধী বাবুর ওপর হামলার ঘটনায় আসামিরা মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। ২৪ নভেম্বর রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে সুমন ফোন করে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। সুমন বলে, ‘শাহিন কি খবর? কই আছ। কি অবস্থা? এবার তোমার পালা। তোমার সম্বন্ধী মামলা তুলে না নিলে তোমার ওপর হামলা হবে। এলাকায় থাইকো তুমি। তোমার কোথাও যাওয়া লাগবে না।’
শাহিন বলেন, ওদের অত্যাচারে এই এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। সিরামিক ব্লক-ট এলাকায় রাজন ও বেগুনটিলা এলাকায় আবুলের নেতৃত্বে মাদক ব্যবসা চলছে। জামাল জুয়ার আসরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, রোববারও জামিনের জন্য আদালতে গিয়েছিল সুমন। এ সময় আমার সঙ্গে থাকা আলামীনকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘জামিন পেয়ে নিই। তারপর তোদের দেখে দেব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, মোহাম্মদ সুমন এক সময় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিল, এখন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। গত দুই মাসে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তিনি পলাতক আসামি। তাকে ধরতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে। তার সহযোগী ইয়াবা বাবুসহ দু’জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছি। বাকিদের বেশিরভাগই জামিনে আছেন।
এদিকে পুলিশ সুমনকে পলাতক বললেও সুমন প্রকাশ্যেই আছেন। তার মোবাইল নম্বরও সচল। তিনি রোববার সন্ধ্যায় টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, লোকজন শত্রুতামূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। একটি ঘটনাস্থলেও আমি ছিলাম না। তারপরও এজাহারে আমার নাম। এ কারণে পুলিশ এজাহার গ্রহণে বেশ কয়েকদিন বিলম্বও করেছিল। তিনি আরও বলেন, যারা আমার নামে মামলা করেছে। তাদের নামে আমার চেয়ে অনেক বেশি মামলা আছে। সে বিষয়টি কেউ বলছে না।
