মিনিকেট রহস্য উদ্ঘাটন সমীক্ষার তথ্য
চাহিদানুযায়ী নির্ধারিত হয় চালের নাম
উবায়দুল্লাহ বাদল
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল প্রভৃতি নামে যেসব চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা একই জাতের ধান থেকে তৈরি। এসব নামে ধানের কোনো জাত নেই বাস্তবে। ‘নাইজার শাইল’ নামে এক ধরনের ধান স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও তা পরিমাণে খুবই কম, যা বাজারে মেলে-না সচরাচর।
আধুনিক প্রযুক্তিগুণে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চালই বাজারে ধুমছে বিক্রি হচ্ছে এসব নামে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বস্তাবন্দি হচ্ছে আড়তগুলোয়। যে চাল কুষ্টিয়ায় ‘নাজিরশাইল’ হিসাবে বস্তায় ঢুকছে, ওই চালই হয়তো বগুড়ায় ‘মিনিকেট’ ও শেরপুরে ‘কাজল’ নামে বস্তাবন্দি হচ্ছে ভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডে।
এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে মিনিকেট রহস্য উদ্ঘাটন কমিটির সমীক্ষায়। শিগগির এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে ওই কমিটি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ) মো. তাহমিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ভোক্তাকে কাঙ্ক্ষিত চাল কিনতে সহায়তা করা ও প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে বাজারে পাওয়া বিভিন্ন নাম ব্র্যান্ডের চাল কোন কোন জাতের ধান থেকে তৈরি করা হচ্ছে তা নির্ণয় বা অনুসন্ধানে একটি সমীক্ষা হয়েছে। এ জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছে। শিগগির সুপারিশসংবলিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত চালের ৮৫ শতাংশই মোটা। আর মাত্র ১৫ শতাংশ চিকন চাল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চালকল মালিকরা মোটা চাল চিকন করে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল নামে বাজারজাত করছেন। এতে মোটা চালের ভেতরের অংশ বেশি দামে কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। এ ছাড়া চালের উপরিভাগে যে পুষ্টি থাকে তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তা।
এতে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাষ হয় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান। কিন্তু বাজারে এই নামে কোনো চাল নেই। বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চাল পাওয়া যায়। কিন্তু এই নামে ধানের কোনো জাত নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্রি-২৮ ও কিছু ক্ষেত্রে ব্রি-২৯ ধান কেটে ‘মিনিকেট’ নামে বাজারজাত করা হয়।
একইভাবে ব্রি-২৯ ধান অধিক ছাঁটাই ও পলিশ করে চালের নাম দেওয়া হয় ‘নাজিরশাইল’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. আসাদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘বাজারে আমরা নাজিরশাইল নামে যে চাল কিনি তা প্রকৃত নাইজার শাইল ধানের চাল নয়। এ ধানের চাষ খুবই কম হয়, তাই এর চাল বাজারে তেমন পাওয়া যায় না। আর মিনিকেট নামে তো কোনো ধানের জাতই আবিষ্কার হয়নি।’
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ও প্রচলিত ধারণা আছে, মোটা চাল কেটে চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন এক শ্রেণির অসাধু মিল মালিক। এই অসাধু চক্র ক্রেতার পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এই প্রতারণা রোধে বাজারে থাকা চালের উৎস ধানের জাত নির্ণয়ের উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রচুর ধান উৎপাদন হয়-এমন ২১ জেলায় সমীক্ষা চালায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা।
জেলাগুলো হলো : যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বগুড়া, নওগাঁ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরইমধ্যে তারা জেলাগুলোর মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ শেষে প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করে জমাও দিয়েছেন।
সমীক্ষা পরিচালনাকারীদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল প্রভৃতি নামে যেসব চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা মূলত এক ধরনের জাতের ধান থেকে তৈরি। এসব নামে ধানের কোনো জাত নেই বাস্তবে। আধুনিক প্রযুক্তিগুণে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চালই পলিশ ও চকচকে করে বাজারে ধুমছে বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল প্রভৃতি নামে। ক্রেতার চাহিদানুযায়ী এসব চাল বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডে বস্তাবন্দি হচ্ছে।
কুষ্টিয়ায় যে চাল ‘নাজিরশাইল’ হিসাবে বস্তায় ঢুকছে; ওই চালই হয়তো বগুড়ায় ‘মিনিকেট’ বা ময়মনসিংহে ‘কাজল’ নামে বস্তাবন্দি হচ্ছে। চাল ব্যবসায়ীরা যেখানে যে চালের চাহিদা বেশি, সেই ব্র্যান্ডের নামে ওই চাল বস্তাবন্দি করছে। ফলে একই চাল স্থান-কাল-পাত্রভেদে একাধিক কোম্পানি ও নামে বিক্রি হচ্ছে। তবে মোটা চাল কেটে চিকন করা হচ্ছে-এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, মোটা চাল কেটে চিকন করার কোনো সুযোগ নেই। দেশে এখনো চাল কাটার কোনো মেশিন আসেনি। চাল কাটলে তা আস্ত থাকবে না। তবে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন অটোরাইস মিলে চাল পলিশ (মসৃণ) ও উজ্জ্বল (চকচকে) করার সুযোগ রয়েছে। মূলত সেটাই করে থাকেন অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা। একজন মানুষকে কাপড়-চোপড় পরিহিত অবস্থার চেয়ে কাপড়-চোপড় ছাড়া অবস্থায় তুলনামূলক চিকন দেখা যাবে। তেমনি চালের উপরের আবরণ ফেলে দিলে চিকন দেখা যায়। চালে নানা ধরনের ওষুধ দেওয়ার বিষয়টিও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
সমীক্ষা পরিচালনা কমিটির অপর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, আমরা দেখেছি দেশে চালের ব্র্যান্ডিংটা কীভাবে হচ্ছে। কোন চাল কোন ধানের জাত থেকে আসছে। আমরা এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেব প্রতিবেদনে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে-এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।
