চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা!
করোনা রোগীতে ঠাসা বেসরকারি হাসপাতাল
জরুরি না হলে ভর্তি ও অস্ত্রোপচার বন্ধ চমেক হাসপাতালে * চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের দুশ্চিন্তায় নিুআয়ের মানুষ
এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীতে ঠাসা চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে আইসিইউতে ভর্তি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বজনদের। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা যেমন ফাঁকা নেই তেমনি নেই এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) শয্যাও। অথচ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী মঙ্গলবার চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ৯৯ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। নির্ধারিত হাসপাতালে ৫৭ আইসিইউ শয্যা খালি পড়ে ছিল। তবে নগরীর বেশ কয়েকটি কোভিড ডেডিকেটেড বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিইউ শয্যা তো দূরের কথা সাধারণ শয্যায়ও নতুন রোগী ভর্তির সুযোগ নেই। সবশেষ বুধবার এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৩ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। কোভিড রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। এদিন আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে অতি জরুরি ছাড়া সাধারণ রোগীদের ভর্তি সীমিত রাখা এবং জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া রুটিন অস্ত্রোপচার স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, সাধারণ রোগী ও স্বজনের মাঝে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় সাময়িকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে সাধারণ রোগীর চাপ পড়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। তবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নিু আয়ের মানুষেরা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ১২টি ল্যাবে ২ হাজার ৮৬৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৩ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়েছে। চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের পর থেকে এটিই সর্বোচ্চ শনাক্ত। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৫২ জন নগরীর এবং ৩৫১ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় এদিন শনাক্তের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ সময় করোনাক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন নগরীর এবং বাকি ছয়জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার ৭৮৭ জন। মারা গেছেন ৮০০ জন।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ৩ হাজার ১৭৯টি। যার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৯৫০টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ২২৯টি। মঙ্গলবার সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিল ৪১৫ জন। বেসরকারি হাসপাতালে ৭৫৪ জন। খালি শয্যা ছিল ২ হাজার ১০টি। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে ৪৩টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১১৩টিসহ মোট ১৫৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। যার মধ্যে সরকারিতে ২১টি এবং বেসরকারিতে ৭৮টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। এদিন জেলা সিভিল সার্জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৫৭টি আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের করোনা রোগীর জন্য বিশেষায়িত জেনারেল হাসপাতালে বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ১৩০ শয্যার আইসোলেশন বেডে রোগী ভর্তি ছিল ১২৩ জন। তবে ১৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৬টিতেই রোগী ভর্তি ছিল। কেবিন শয্যার ৮টিতে রোগী ভর্তি ছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০০ শয্যার ২৮৪টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ১০ শয্যার আইসিইউ এবং ১০ শয্যার এইচডিইউ বেডের সবকটিতে রোগী ভর্তি ছিল। অপরদিকে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৫ শয্যা এবং হলি ক্রিসেন্ট (জেনারেল হাসপাতাল-২) হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ খাতা-কলমে হিসাব করা হলেও বাস্তবে রোগী ভর্তির জন্য চালু নেই।
বিআইটিআইডি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশিদ বলেন, জেনারেটর স্থাপনের জন্য আইসিইউ শয্যাগুলো কার্যকর করা যায়নি। বর্তমানে জেনারেটর স্থাপনসহ আরও কিছু কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আইসিইউ শয্যায় রোগীরা সেবা পাবেন।
বেসরকারি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা সেলের সদস্য সচিব মো. রেজাউল করিম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালের ১৪০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ডে সবকটি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে। রোগীর চাপ সামাল দিতে আরও ২০টি শয্যা বাড়ানো হয়েছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ১৯ শয্যার আইসিইউ এবং ১০ শয্যা এইচডিইউ বেডের কোনোটিই ফাঁকা নেই। মুমূর্ষু রোগীদের সংখ্যাই বেশি। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে বেশি।
নগরীর পার্কভিউ হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম বলেন, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে ১০ শয্যার আইসিইউ ও এইচডিইউ শয্যার কোনোটিই খালি থাকছে না। কেবিনে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৫৮ জন। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ জন রোগী অপেক্ষমাণ রয়েছেন। শয্যা খালি হলেই ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা।
সাধারণ রোগীর সেবা বন্ধ চমেক হাসপাতালে : চট্টগ্রামে করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে অতি জরুরি ছাড়া সাধারণ রোগীদের ভর্তি সীমিত রাখা এবং জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া রুটিন অস্ত্রোপচার স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ-চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ূন কবীর স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। করোনা বিষয়ক স্বাচিপের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমন্বয়ক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে সাধারণ রোগী ভর্তি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক সেটি স্বাস্থ্য বিভাগের বিবেচনা করা উচিত। এতে হাজার-হাজার অসহায় রোগী দুর্ভোগে পড়বেন। এ ছাড়া গুরুতর করোনা রোগীর চিকিৎসায় খাতা-কলমে থাকা আইসিইউ শয্যা দেখাচ্ছে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্যবিভাগ। বাস্তবে সরকারি পর্যায়ে কার্যকর আইসিইউ রয়েছে ২৮টি।’
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন আহমেদকে সোমবার বিকালে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে শয্যা খালি নেই বলে ফেরত পাঠানো হয়। যখন সংক্রমণ কম ছিল, আমরা সরকারকে বলছিলাম চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত আইসিইউ শয্যা এবং হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা।’
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলছিলাম চট্টগ্রাম ঝুঁকির মধ্যে আছে। বর্তমানে সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে পরিস্থিতি। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তা উদ্বেগের বিষয়।’
