Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মাদারীপুরে মানব পাচার চক্রের ৩০ সদস্য সক্রিয়

লাশ হয়ে ফিরছেন অনেকে * আবার কেউ হারিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগরে

Icon

খোন্দকার রুহুল আমিন, টেকেরহাট (মাদারীপুর)

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদারীপুরে মানব পাচার চক্রের ৩০ সদস্য সক্রিয়

সুমী বেগম, জুলহাস তালুকদার, নাসির সিকদার, সিরাজ মাতুব্বর, জাহিদ খান, ইমাম হোসেন।

মাদারীপুরে আন্তর্জাতিক মানব পাচারচক্রের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ইতালি, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিরীহ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রথমে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে তারা ইউরোপ গমনেচ্ছুকদের বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়া পাঠায়।

এরপর যেখান থেকে নৌকায় করে ইউরোপের দেশ ইতালি পাঠায়। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটে অনেক ঘটনা। বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন আর সেই নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ পাঠানোর সময় নৌকাডুবিতে মৃত্যু-এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটছে। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগরে। চক্রের সদস্যরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরও লোক পাঠাচ্ছে।

আফ্রিকার তিউনিশিয়ার উপকূল ও ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে অভিবাসনপ্রত্যাশী কিশোর-যুবকদের সংগ্রহ করে থাকে। এই দালালচক্রে অনেক নারী সদস্য রয়েছে। এ পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশ বেশকিছু নারী-পুরুষ দালালকে গ্রেফতার করেছে। তবুও থেমে নেই অবৈধ পথে মানব পাচার।

অনুসন্ধানে এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যাত্রাকালে ৫ বছরে নৌকাডুবিতে মাদারীপুরের ৪ উপজেলার (মাদারীপুর সদর, রাজৈর, শিবচর ও কালকিনি) অর্ধশত কিশোর-যুবক মারা গেছেন। নিখোঁজ আছেন কয়েকশ। গ্রামের সহজসরল কিশোর-যুবকদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন আর রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ জনের দেশীয় দালালচক্র।

স্বজনরা জানান, প্রথমে লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠায় দালালচক্র। পরে নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে যুবকদের বাধ্য করে। এতে প্রাণ হারাতে হয় অনেককে।

এছাড়া দালালদের চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন টর্চার সেলে রেখে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কখনো কখনো তুলে দেওয়া হয় লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে।

মাফিয়ারা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে এবং হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে ভিকটিমদের পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে। এমন অনেক পরিবার আছে, যারা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে এ নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ, তথ্য ফাঁস করে দিলে মাফিয়ারা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলবে।

অনুসন্ধান করে মাদারীপুরে সক্রিয় দালালচক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তারা হলেন-সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ির জামাল খাঁ ও রুবেল খাঁ, শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, কুমড়াখালীর এমদাদ ব্যাপারি, ধুরাইল ইউনিয়নের চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর গ্রামের মহসিন মাতব্বর ও মিজান মাতব্বর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুর এলাকার জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ির রবিউল ওরফে রবি, শাখারপাড় গ্রামের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের কৃষ্ণারমোড় এলাকার শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতব্বর ও সিরাজ মাতব্বর।

এই চক্রে বেশ কয়েকজন নারী দালাল রয়েছে। তারা কমিশনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিশোর-যুবকদের সংগ্রহ করে। গত বছর ৩০ জুন পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সুমি বেগম, দিনা বেগম, নার্গিস বেগম, জুলহাস, হানিফ, সেন্টু শিকদার, জাকির হোসেন, লিয়াকত মেম্বার, নাসিরসহ ১৫ জন।

রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের শাখারপাড় এলাকার পারভীন বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে সুমন মোল্লাকে হাসানকান্দি এলাকায় দালাল হানিফের মাধ্যমে ইতালি পাঠানোর কথা হয়। সেই মোতাবেক সাড়ে ৭ লাখ টাকা হানিফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে লিবিয়া নিয়ে আমার ছেলেকে কয়েক দফা বিক্রি করে দেয় দালালচক্র। পুলিশের হাতে আটক হয়ে আমার ছেলে সুমনসহ অন্তত ৪৫ জন সেখানকার জেলে আছে। এই দালাল হানিফ শ্রীনদীতে তিনতলা বাড়ি করেছে। এছাড়া সে অনেক টাকার মালিক।

একই এলাকার কেরামত আলী ফকির বলেন, ‘দালাল কামরুল মোল্লা আমার ছেলেকে লোভ দেখিয়ে ইতালি পাঠাতে রাজি করে। মাঝপথে লিবিয়া গিয়ে তিন মাস ধরে আমার ছেলে নিখোঁজ। এ ব্যাপারে রাজৈর থানায় মানব পাচার আইনে মামলা করেছি।’

মাদারীপুরে সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি শাহানা নাসরিন রুবি বলেন, ‘দালালচক্র দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পথে মানব পাচার করে এলেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত দালালচক্রকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা।’

জানতে চাইলে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘মূলত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সহজে অভিযোগ দিতে চায় না। কারা কারা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তা বের করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন জানান, দালালচক্রের তালিকা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মানবপাচার চক্র

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম