আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা
প্রাইভেট আইসিডিতে ২৩ শতাংশ বর্ধিত চার্জ আদায় শুরু
ট্যারিফ কমিটির তোয়াক্কা না করেই চার্জ বৃদ্ধি
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রাইভেট (বেসরকারি) আইসিডিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ এক লাফে ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি মানতে রাজি নন আমদানি-রপ্তানিকারকরা।
এতে ব্যবসায় ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন। কারণ পণ্য রপ্তানি অনেকটাই আইসিডি-নির্ভর হয়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইসিডি মালিকরা চাইলেই চার্জ বাড়াতে পারেন না। এর জন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একটি ট্যারিফ কমিটি রয়েছে। চার্জ বাড়ানোর আগে ওই কমিটির অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। তাই অনুমোদন ছাড়াই ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অবৈধ।
প্রাইভেট আইসিডির অন্যতম ব্যবহারকারী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইসহ বিভিন্ন পক্ষ এরই মধ্যে চার্জ বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে। দাবি জানিয়েছে সিদ্ধান্ত বাতিলের।
তবে আইসিডি মালিকরা বলছেন, চার্জ বৃদ্ধি যৌক্তিক। কারণ ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ব্যয় বেড়েছে। তাই আগের চার্জে আর পণ্য হ্যান্ডলিং সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণে চার্জ বাড়াতে হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিটি নিয়ে আইসিডি মালিকদের আপত্তি আছে। উচ্চ আদালতে ট্যারিফ কমিটির কার্যক্রম নিয়ে আপিলও করা হয়েছে, যা বিচারাধীন।
এরই মধ্যে বর্ধিত চার্জ আদায় শুরু করেছে আইসিডিগুলো। ৪ নভেম্বর থেকে যেসব কনটেইনার আইসিডিতে রয়েছে, সেগুলোর বর্ধিত চার্জ নেওয়া হচ্ছে। সোমবার বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বাকডা) এক সভায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২৩ শতাংশ চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ৪ নভেম্বর থেকেই কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাঁচটি ক্যাটাগরিতে চার্জ বাড়ানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর বন্দরকে কেন্দ্র করে একের পর এক বেসরকারি আইসিডি গড়ে উঠতে থাকে।
বর্তমানে ১৯টি আইসিডি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের প্রায় শতভাগ এবং আমদানি পণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে থাকে। ফলে বন্দরে কনটেইনারের চাপ কমলেও আইসিডিগুলোয় মাত্রাতিরিক্ত চার্জ নেওয়া হয় বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ তোলেন ব্যবসায়ীরা।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও নৌমন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠকও হয় অতীতে। সাধারণত রপ্তানি পণ্য ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানে করে আইসিডিতে এনে রাখেন ব্যবসায়ীরা। আইসিডিতে তা কনটেইনারে বোঝাই করে (স্টাফিং) শুল্ক কর সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানির জন্য বন্দরে পাঠানো হয়। একইভাবে ৩৭টি আইটেমের আমদানি পণ্যও আইসিডিতে এনে রাখার পর সেখান থেকে ডেলিভারি নিতে পারেন ব্যবসায়ীরা।
প্রাইভেট আইসিডির অন্যতম ব্যবহারকারী বিজিএমইএ। আইসিডি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, এর সিংহভাগই তৈরি পোশাক। বিজিএমইএ চার্জ বৃদ্ধিকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। বিজিএমইএ-এর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আইসিডিতে’ আকস্মিকভাবে বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির কারণে পোশাক খাতে রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে এই শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চার্জ বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। একতরফাভাবে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মোটেও যুক্তিসংগত এবং ব্যবসাবান্ধব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার অনুমোদিত বেসরকারি আইসিডি/সিএফএস নীতিমালা ২০১৬-এ বলা আছে-আদায়যোগ্য ট্যারিফ নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় গঠিত ট্যারিফ কমিটি নির্ধারণ করবে, যা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে কার্যকর হবে। তাই এই কমিটির অনুমোদন না নিয়ে রপ্তানি কনটেইনারের বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাইভেট আইসিডির যে কোনো চার্জ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবশ্যই মন্ত্রণালয় গঠিত ট্যারিফ কমিটির অনুমোদন নিতে হবে।
বর্ধিত চার্জ মানা সম্ভব নয় জানিয়ে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়ুল আলম সুজন যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রাইভেট আইসিডি কর্তৃপক্ষ কিছুদিন পরপরই নানা অজুহাতে চার্জ বাড়াচ্ছে। এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ তারা ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে চার্জ ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। এতে রপ্তানিতে সংকট সৃষ্টি হবে। কেননা রপ্তানি পণ্যের প্রায় শতভাগই আইসিডির মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। ব্যবসায় ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। পাঁচটি খাতে চার্জ বাড়ানোর কথা বলা হলেও এর মধ্যে স্টাফিংসহ কয়েকটি খাতের সঙ্গে ডিজেলের কোনো সম্পর্ক নেই।’
বিভিন্ন প্রাইভেট আইসিডি এরই মধ্যে বর্ধিত চার্জ আদায় শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিকডা সচিব রুহুল আমিন শিকদার। তিনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘যে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে চার্জ বাড়ানো হয়েছে, তার সবকটির সঙ্গে ডিজেলের সম্পর্ক আছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কনটেইনার আনা-নেওয়া, লিফট অন, লিফট অফ, পণ্য স্টাফিংয়ের পর আবার কনটেইনারটি নির্ধারতি শেডে রাখা এবং সেখান থেকে গাড়িতে করে বন্দরের উদ্দেশে পাঠাতে হয়। যারা মানতে চাইছেন না, তারা বলুক, আমাদের কোন খাতের চার্জটি অযৌক্তিক। ’
ট্যারিফ কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই কমিটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আইসিডি মালিকরা ট্যারিফ কমিটি চান না। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের চার্জ সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে কেন? গত ছয় বছরেও এই কমিটি কোনো চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। আমরা নিজেরাই চার্জ বাড়িয়েছি। সেই চার্জ তো ব্যবহারকারীরা পরিশোধ করছেন। সেটাও কি অবৈধ? ট্যারিফ কমিটির কার্যক্রম নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে, যা বিচারাধীন। এই কমিটি কবে চার্জ বাড়াবে, সেজন্য বসে থাকতে হলে তো সব আইসিডি বন্ধ করে দিতে হবে। লোকসান দিয়ে কে ব্যবসা করবে।’
