Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিলুপ্তপ্রায় ‘ঠার’ ভাষা: সংগ্রাহক হাবিবুর রহমান

Icon

কায়েস আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিলুপ্তপ্রায় ‘ঠার’ ভাষা: সংগ্রাহক হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন মূলত দুটি ভাষায় কথা বলেন। বাংলা ভাষার পাশাপাশি তারা নিজস্ব মাতৃভাষা ‘ঠার’ ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। ‘ঠার’ মূলত কথ্যভাষা। যা অন্য ভাষাভাষী মানুষের বোধগম্য নয়। ‘ঠার’ ভাষার কোনো বর্ণ বা লিপি নেই। এ ভাষার ওপর কোনো বইও নেই। ভাষাটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণাও হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন ‘ঠার’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদেরই একজন হলেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে তার লেখা বই- ‘ঠার, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হবে।

ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। ১৬৩৮ সালে আরাকানরাজ বলালরাজের সঙ্গে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের ভাষা- ‘ঠার’ বা ‘ঠেট’ বা ‘থেক’ ভাষা। বেদেরা আবার বিচিত্র জাতের। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও আচার-আচরণে তারা পুরোপুরি হিন্দু। তারা অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী। তাদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতো। বেদেরা শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেদে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। ৫৩টি জেলায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সামাজিকভাবেও তারা চরম অবহেলিত। নৌকায় তাদের জন্ম, নৌকায় বেড়ে ওঠা, নৌকাতেই মৃত্যু। তবে ভূূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীনালা শুকিয়ে যাওয়ায় বেদেরা জীবিকা নির্বাহের জন্য জল ছেড়ে এখন ডাঙায় উঠে এসেছেন। নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত বেদেদের বেশিরভাগেরই বসতি নদীর পাড়, সেতুর নিচে অথবা বস্তির খুপরি ঘরে।

পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েও হাবিবুর রহমান সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। ‘ঠার, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইয়ে তিনি প্রান্তিক বেদেপল্লির নিজস্ব ভাষা ‘ঠার’-এর আদ্যোপান্ত ফুটিয়ে তুলেছেন। বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার উদ্ভব, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন তিনি। বইটি থেকে বিপন্নপ্রায় ভাষাটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক ধারণা পাওয়া যাবে।

প্রায় অজানা ‘ঠার’ ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণ সম্পর্কে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় বেদে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের রীতি চালু করি। এতে বেদে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। লক্ষ করি-তারা নিজেদের মধ্যে ভিন্ন ভাষায় কথাবার্তা বলেন। যা আমাকে কৌতূহলী করে। পরে জানতে পারি- ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অংশ। গবেষকদের কেউ কেউ একে ‘ঠার’ বা ‘ঠের’ ভাষা বলেন। ভাষাটির লিখিত কোনো রূপ নেই। তিনি বলেন, তথ্যানুসন্ধান ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করে জানতে পারি-‘ঠার’ বেদেদের স্বতন্ত্র ভাষা। এ ভাষার সঙ্গে আরাকানদের ভাষার মিল রয়েছে। কেউ কেউ আবার ভাষাটির সঙ্গে ‘চাক’ ও ‘কাডু’ ভাষার সামঞ্জস্যতার কথাও বলেন। তবে ‘ঠার’ নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে-এর বেশিরভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ থেকে উদ্ভূত। ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র বা গবেষক না হয়েও কৌতূহলী মন আমাকে ভাষাটি সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করেছে। এ থেকেই বইটি লেখার পরিকল্পনা করি। তিনি আরও বলেন, ‘ঠার, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইটি দীর্ঘ আট বছর গবেষণার ফসল। পাঁচ শতাধিক বেদে প্রতিনিধির সঙ্গে তিনি আট বছর যোগাযোগ করেছেন। তাদের মাধ্যমে ভাষাটির শব্দ ও ব্যাকরণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন।

বিলুপ্তপ্রায় ‘ঠার’ ভাষার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হাবিবুর রহমান জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। তার সহকর্মীরা তাকে সহায়তা করেছেন। গবেষণা কাজে তাকে সহায়তা করেছেন গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক আমানত মোল্লা এবং সাভারের পোড়াবাড়ীর বেদেপল্লির সদস্য আমজাদ হোসেন। এছাড়া ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘ঠার’ ভাষাবিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের বেদে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান ও চীনের ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক আনিসুর রহমান। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমেদ। সম্মেলনে ঠারভাষী প্রতিনিধিদের সম্মতিক্রমে ভাষাটির শব্দ, উচ্চারণ, বাক্যগঠন এবং ব্যাকরণ ইত্যাদি যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

ঠার ভাষার বইয়ের উন্মোচন আজ : আজ মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ‘ঠার, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইটির প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হবে। পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসাবে উপস্থিত থাকবেন কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসাবে থাকবেন কবি কামাল চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসাবে থাকবেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি ও লেখক মিনার মনসুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে বইটির ভাবনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন লেখক হাবিবুর রহমান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি মানবসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। অবহেলিত বেদে ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে তিনি নিরলস চেষ্টা করছেন। ব্যক্তি উদ্যোগ ও উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অবহেলিত বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানবতার আলো। মূল পেশার (প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা) বাইরে এনে বেদেদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের জন্য বুটিক, পার্লারসহ নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তাদের জন্য মিউজিয়াম তৈরি হচ্ছে। ডিআইজি হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও এনজিও এগিয়ে আসছে। সমাজ পরিবর্তনে, মানুষের কল্যাণে, মানবতার স্বার্থে পুলিশের কার্যকর ভূমিকায় ব্যতিক্রমী অবদান রেখে চলেছেন তিনি।

‘ঠার, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইটি পাঞ্জেরী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়ক প্রকাশ করেছেন। এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। বইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষক, শিক্ষক, ছাত্র সবাইকে তিনি অশেষ ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।

সংগ্রাহক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম