চরম দায়িত্বহীনতায় ঝুলছে ২৯৩ প্রকল্প
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শুরুতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হলেও প্রকল্প শেষ করার দিকে আগ্রহ হারাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ঝুলে আছে ২৯৩টি উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। কিন্তু সময় মতো সংশোধন বা সমাপ্ত করার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে ‘স্টার’ (তারকা) চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে। তবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি ছাড়া এসব প্রকল্পের অর্থছাড় কিংবা ব্যয় কোনোটিই করা যাবে না। এটা চরম দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে-প্রতি বছর একই রকম ঘটনা ঘটলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় না। যে কারণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বারবার।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঝুলে থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে এক যুগেরও বেশি অর্থাৎ ১৩ বছর ধরে চলছে এমন প্রকল্প রয়েছে দুটি। এ ছাড়া ১২ বছর ধরে চলমান আছে তিনটি, ১১ বছরের প্রকল্প দুটি এবং ১০ বছর ধরে চলছে দুটি প্রকল্প। এগুলোর বাইরে ৯ বছর ধরে চলমান রয়েছে সাতটি প্রকল্প। আট বছরের প্রকল্প ১৩টি এবং সাত বছরের রয়েছে ১৬টি উন্নয়ন প্রকল্প। গড়ে এসব প্রকল্প দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প যথাসময়ে শেষ না করায় মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে অবশ্যই অটোমেটিকভাবে (সংক্রিয়ভাবে) ব্যয়ও বেড়ে যায়। ফলে অর্থের অপচয় ঘটে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রকল্প সংশোধন না করাটা সংশ্লিষ্টদের চরম দায়িত্বে অবহেলার বহিঃপ্রকাশ। প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রতি যে উদাসীনতা এগুলো তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। অবশ্যই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ দায় কিছুটা আমার মন্ত্রণালয়ের হলেও প্রকৃত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের।
সূত্র জানায়, সংশোধিত এডিপিতে ‘স্টার’ চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ২৫৩টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ৪০টি। ১৭টি খাতের চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে এরকম মেয়াদ উত্তীর্ণ প্রকল্প সবচেয়ে বেশি রয়েছে গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ৪৯টি প্রকল্প। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে শিক্ষা খাতে ৩৪টি এবং তৃতীয় অবস্থানে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৩৩টি প্রকল্প। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের মধ্যে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ২৩টি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাতে ২৩টি এবং ধর্ম, সংহতি ও বিনোদন খাতে ২২টি প্রকল্প। আরও আছে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে ১৯টি, কৃষিতে ২০টি এবং সাধারণ সরকারি সেবায় ১৪টি প্রকল্প। স্বাস্থ্য খাতে ১৪টি, সাধারণ সরকারি সেবায় ১৪টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ১০টি, সামাজিক সুরক্ষায় ১৫টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চারটি এবং প্রতিরক্ষা খাতের প্রকল্প রয়েছে দুটি।
পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, ২০১৬ সালের পরিপত্রে স্পষ্টভাবে এ বিষয়ে বলা আছে। অর্থাৎ কোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই সংশোধনের প্রস্তাব করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইএমইডি ও পরিকল্পনা কমিশন দুই জায়গায়ই প্রস্তাব দিতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম মানা হয়নি। ফলে এসব প্রকল্প স্টার চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন অনেকটাই জবাবদিহি করা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে বলা হচ্ছে কোন কোন প্রকল্পের কোথায় কী ধরনের সমস্যা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বৈঠকগুলোতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ১২ বছর ধরে চলছে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এটির। কিন্তু এখনো সংশোধন করা হয়নি। গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ২২৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে এক লাখ টাকার নামমাত্র বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সূত্র জানায়, লেকের উন্নয়ন করে এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন, সৌন্দর্য বর্ধন ও নগরবাসীর বিনোদন সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। মূল প্রকল্পটি ২০১০ সালের ৬ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক। তখন এর ব্যয় ছিল ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে নানা কারণে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভার সিদ্ধান্ত মেনে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে চার হাজার ৮৮৬ কোটি ১১ লাখ টাকা ধরে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। ওই বছরের ১১ অক্টোবর প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। কিন্তু সেখানে অনুমোদন না দিয়ে কড়াইল বস্তি হতে কত পরিবারকে উচ্ছেদ করা হবে, তাদের কোথায় এবং কিভাবে পুনর্বাসন করা হবে ইত্যাদি বিষয়ে স্টাডি করে পরিকল্পনাসহ পুনরায় একনেকে উপস্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এসব নির্দেশনা মেনে আবারও প্রস্তাব করা হলে ২০১৯ সালের ১ জুলাই একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২০ সালের শেষ দিকে আবারও অনুষ্ঠিত হয় পিইসি সভা। ওই সভার সুপারিশগুলো এখনো প্রতিপালন হয়নি। এ প্রসঙ্গে কথা হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (ইঞ্জি.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীর (অব.) সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে আর কোনো সমস্যা যাতে না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছি। যেমন ইতোমধ্যেই ডিপিডিসি এবং এমআরটি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গেও বৈঠক করা হচ্ছে। ক্লিয়ারেন্স পেলেই সংশোধিত ডিপিপি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড (পতেঙ্গা হতে সাগরিকা পর্যন্ত) প্রকল্প। এটি শুরু হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে। তিন বার সংশোধন করার পর গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয় সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ। প্রকল্পটির মোট ব্যয় দুই হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ১১৬ কোটি টাকা। ঝুলে থাকা তালিকায় রয়েছে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি (তৃতীয় সংশোধিত)। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্প। রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরী প্রকল্প। উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প এবং পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রকল্প। আরও আছে এস্টাবলিস্টমেন্ট অব শেখ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজ, গোপালগঞ্জ, বিভাগীয় ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ এবং ১০০টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন প্রকল্প।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার বেশ কিছু কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান। যেমন সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব অন্যতম। এ ছাড়া যেনতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে উন্নয়নসহযোগীদের সময়ক্ষেপণও দায়ী। পাশাপাশি রয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি ইত্যাদি।
