দুদকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তার দাপট
শরীফের দুর্নীতি মামলার আসামি পাঁচ শিশুও
রোহিঙ্গা সাজিয়ে পরিবারের ১০ সদস্যের পাসপোর্ট বাতিল * উচ্চ আদালতের রায়ের পর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন (চাকরিচ্যুত) দুর্নীতি মামলায় পাঁচ শিশুকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আসামি করেছিলেন। কেবল দুর্নীতি মামলার আসামি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। গোটা পরিবারটিকে রোহিঙ্গা সাজিয়ে তিনি ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনের পাসপোর্ট বাতিলেরও ‘ব্যবস্থা’ করেন। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার পরিবারটির সদস্যরা পাসপোর্ট ফিরে পেয়েছেন। রায় পাওয়ার পর হয়রানিমূলক মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন তারা। মামলা ও পাসপোর্ট বাতিল হওয়ায় তারা সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অভিযোগ-দুদক কর্মকর্তা শরীফ তার মায়ের নামে চাঁদপুরে মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ অথবা ২০ লাখ টাকার ‘আবদার’ করেছিলেন। সেই আবদার রক্ষা না করায় এলাকার বাসিন্দা নয় এবং ভুয়া এনআইডি-জন্মনিবন্ধন কার্ড দিয়ে পাসপোর্ট গ্রহণ করা হয়েছে-এমন অভিযোগ করা হয়। এসব অভিযোগে ২০২১ সালে দুদক চট্টগ্রাম অঞ্চল-২-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন মামলা করেন। মামলায় একই পরিবারের ১৩ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন-কক্সবাজার জেলার সদর থানার আউলিয়াবাদ গ্রামের জালাল আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ তৈয়ব, মোহাম্মদ ওয়ায়েস, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মোহাম্মদ রহিম, মেয়ে আমাতুর রহিম তার স্বামী হাফেজ নুরুল আলম, আবু তৈয়বের স্ত্রী নুর হামিদা তাদের তিন সন্তান আবদুর রহমান (১৩), আবদুস শাকুর (৯) ও নুর হাবিবা (৫), নুরুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ ওসামা (১৫), আসমাউল হোসনা (৫) ও আমাতুর রহমান (১২)। একই মামলায় চার সরকারি কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়। তারা হলেন-কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক তিন পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এসএম মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ রুহুল আমিন ও প্রভাষ চন্দ্র ধর এবং কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন। তবে যে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন বা জাতীয়তা সনদ দেওয়া হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে এনআইডি ও পাসপোপর্ট দেওয়া হয়েছে সেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বার কাউকে রহস্যজনক কারণে মামলার আসামি করা হয়নি। এছাড়া তৈয়ব, নুর হামিদা, আবদুর রহমান, আবদুশ শাকুর, নুর হাবিবা, নুরুল আলম, আমাতুর রহিম, আমাতুর রহমান ওসামা ও আসমাউল হোসনার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়।
মামলায় শিশুদের আসামি করা প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো অবস্থাতেই শিশুকে মামলার আসামি করার সুযোগ নেই। এটা কেউ করে থাকলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করেছেন। ভুয়া জন্মনিবন্ধন বা আইডি কার্ড নিলে তার জন্য দায়ী মা-বাবা অথবা পরিবারের কর্তা। কোমলমতি শিশুদের আসামি করা বেআইনি। কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন (বর্তমানে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা) বলেন, ভোটার হওয়ার জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ, জমির খতিয়ান, পরিবারের সদস্যদের জাতীয়তা সনদসহ যা যা দরকার, সবকিছুই তাদের আছে। এমনকি আলোচ্য পরিবারের সদস্যদের কারও বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ রয়েছে। এসব দেখে তিনি তাদের পক্ষে প্রতিবেদন দেন। কিন্তু সঠিক প্রতিবেদন দেওয়ার পরও তাকে মামলার আসামি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের প্রধান মোহাম্মদ তৈয়ব অভিযোগ করে বলেন, দুদক কর্মকর্তা শরীফ তার মায়ের নামে গ্রামের বাড়িতে একটি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের আবদার করেছিলেন। এছাড়া ভবনের পরিবর্তে তিনি ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। এ আবদার রক্ষা ও দাবি পূরণ করতে না পারায় শরীফ তার ওপর খ্যাপে যান। এরপর এলাকার প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শরীফ তার পুরো পরিবারকে রোহিঙ্গা সাজানোর মিশনে নামেন।
এনজিও কর্মকর্তা মোহাম্মদ তৈয়ব একসময় সাতকানিয়ার এমপি ড. আবু রেজা নদভীর এনজিও প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণসহ ইসলামিক নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তৈয়ব যুগান্তরকে জানান, পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়টি অবৈধ। তারা যে রোহিঙ্গা নয়, শত বছর ধরে এলাকায় বসবাস করে আসছেন তার সব তথ্যপ্রমাণ দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। রিটে রায় তাদের পক্ষে আসে। মামলা প্রত্যাহার ও হয়রানি বন্ধে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর তিনি লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনে তিনি শরীফের টাকা দাবির বিষয়টি উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে শরীফ উদ্দীনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তারও তিনি উত্তর দেননি।
