কোন্দলের প্রভাব সরকারি দপ্তরেও
কে কার লোক দ্বন্দ্বে পুড়ছে বাউফল আওয়ামী লীগ
আকতার ফারুক শাহিন, বাউফল (পটুয়াখালী) থেকে
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাউফল আওয়ামী লীগ অফিস। ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জেলা শহর পটুয়াখালী কিংবা বিভাগীয় সদর বরিশাল থেকে বাউফলে যেতে পার হতে হয় বগা নদী। এখানে পারাপারের জন্য রয়েছে ফেরি ও খেয়া নৌকা। রোববার দুপুরে খেয়া চেপে নদী পারাপারের সময় কথা হয় নৌকায় থাকা দাসপাড়া এলাকার বাসিন্দা শামিম মুন্সির সঙ্গে। একটিমাত্র উপজেলা বাউফল নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-৪ নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের কী অবস্থা জানতে চাইলে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে।
ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘এখানে তো কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। সবাই আবার এমপি হতে চান। বর্তমান এমপি তো আছেনই, পাশাপাশি দলের মনোনয়ন চান উপজেলা চেয়ারম্যান আর পৌর মেয়র।’ হাতের আঙুল গুনে মোট ৮ জনের নাম উলেখ করে বলেন, ‘এসব নেতাদের চক্করে আমাদের এখন প্রাণ যায়। যে কোনো কাজের জন্য এমপি-মেয়র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে গেলে শুরুতেই বোঝার চেষ্টা চলে যে আমি কার লোক। কোনোভাবে যদি চিহ্নিত হয় যে তার নই তো ব্যস, আমার কাজটা আর হবে না। বাউফলের প্রায় সব মানুষ এখন ভুগছে এই সমস্যায়।
রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে যার কাছেই আপনি যাবেন তার লোক হতে হবে। নয়তো নিজের বিপদ সামলাতে হবে নিজেকে।’খেয়া পার হলেই বগা ফেরিঘাট বাজার। সেখানে ডাব বিক্রি করেন এক ব্যক্তি। ঘাটের কাছেই বাড়ি। এর উত্তর পাশে বাউফলের উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব হাওলাদারের ইটের ভাটা। একসময় শ্রমিকের কাজ করেছেন সেখানে। পত্রিকায় নাম-পরিচয় না লেখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পেটের দায়ে মতলেব আলাদারের ব্রিক ফিল্ডে কাম করছি। এহন সবাই কয় আমি নাকি হের লোক। এমপি মেয়রের লগে যারা থাহে তারা কেউ-ই মোরে এহন আর বিশ্বাস হরে না।’
বগা থেকে বাউফল পৌর শহরে পৌঁছতে পার হতে হয় ৭ কিলোমিটার সড়ক। যাত্রীবাহী বাস যেমন চলে তেমনি চলে ভাড়ার মোটরসাইকেল আর থ্রি-হুইলার। নেতাদের দ্ব›েদ্ব কীভাবে পুড়ছে আওয়ামী লীগ সেটা বুঝতে শেয়ারিং অটোতে গন্তব্যে যাত্রা শুরু। সহযাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেল এই নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি আর মনোনয়ন লড়াইয়ে মাঠে থাকা রথী-মহারথীদের নাম। যার প্রথমেই আছেন ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে থাকা ৭ বারের এমপি সাবেক চিফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ। আরও আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব হাওলাদার, পৌর মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জুয়েল, কৃষক লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রেজা খন্দকার, তথ্য অধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আ. মালেক, শিল্পপতি ফিরোজ আলম ওরফে জাপান ফিরোজ, সাবেক ছাত্র নেতা জোবায়দুল হক রাসেল এবং স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তমের ছেলে শিল্পপতি হাসিব আলম তালুকদার। এদের মধ্যে মনোনয়ন প্রার্থী হিসাবে নতুন হাসিব আলম। বাউফলের উন্নয়নসহ নানা সেবামূলক কাজে তার পরিবার বহু বছর আগে থেকেই সহযোগিতায় থাকলেও প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি বছরখানেক আগে সামনে এনেছেন হাসিব। এখন পর্যন্ত বাউফলের দ্ব›দ্ব সংঘাতকেন্দ্রিক রাজনীতিতে পুরোপুরি না জড়ানো হাসিবকে নিয়ে খুব একটা জটিলতাও নেই বলে জানান সহযাত্রীরা। দলীয় মনোনয়ন আর রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ৮ জন থাকলেও ৩ জনের প্রভাব এখানে সবচেয়ে বেশি। এরা হলেন- এমপি ফিরোজ, উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব ও মেয়র জুয়েল। এই ৩ নেতার দ্বন্দ্বেই এখন ক্ষতবিক্ষত আওয়ামী লীগ।
কথাবার্তা আর আলোচনার মধ্যেই ত্রি-চক্র যান গিয়ে পৌঁছায় বাউফল থানার সামনে। ফেরিঘাট থেকে আসা বাহনের গন্তব্য এটুকুই। যে পথে বাউফল আসা সেটি ছিল মসৃণ সুন্দর। পথের অভিজ্ঞতায় বাউফল উপজেলা বেশ উন্নত হবে মনে হলেও সেই ধারণা ভাঙে শহরে পৌঁছে। সড়কের দুপাশে থাকা সারি সারি দোকান পাট, ভাঙাচোরা অভ্যন্তরীণ সড়ক আর নানা পুরোনো ভবনের প্রমাণ দেয় অনুন্নত জনপদের। পরে অবশ্য জানা যায়, যে সড়ক ধরে বাইফলে পৌঁছা সেটি সড়ক ও জনপথের। উপজেলা শহরের অনেকেই বলেন, ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্র আর পুরোনো শহর হলেও এখনো লাগেনি উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া। ৭ বারের এমপি আ.স.ম ফিরোজের ওপর এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে অনেকের। বাউফলের প্রবেশ দ্বার হিসাবে পরিচিত বগা নদীতে একটি সেতু নির্মিত না হওয়ার বিষয়টিকেও তার (ফিরোজ) ব্যর্থতা হিসাবে দেখেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে আ.স.ম ফিরোজ বলেন, ‘বগা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইও শেষ পর্যায়ে। নবম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু হচ্ছে এখানে।’
বাউফল থানা থেকে খানিকটা সামনে এগোলেই উপজেলার আওয়ামী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত জনতা ভবনের অবস্থান। আ.স.ম ফিরোজের মালিকানাধীন এই ভবনেই চলে দলীয় সব কর্মকাণ্ড। ছোটখাটো সভা-সমাবেশ হয় ভবনের সামনে। এটি ছাড়াও আরেকটি কার্যালয় রয়েছে এখানে। শহরের কুন্ডুপট্টি এলাকায় থাকা ওই কার্যালয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন মেয়র জুয়েল। এই কার্যালয় ঘিরে এমপি ফিরোজবিরোধী কার্যক্রম চালান জুয়েল। একসময় আ.স.ম ফিরোজের লোক হিসাবে পরিচিত মোতালেব হাওলাদারও মাঝে কিছুদিন আলাদাভাবে পালন করেছেন দলীয় কর্মসূচি। যদিও বর্তমানে তিনি তা করছেন না। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, ‘এই ৩ জনের বিরোধেই তিন ধারায় বিভক্ত বাউফল আওয়ামী লীগ। হামলা সংঘর্ষ মামলা এমনকি খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে এখানে। আমরা যারা শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার রাজনীতি করি তারা পড়েছি বিপাকে। এখানে আওয়ামী লীগ মানে ফিরোজ-জুয়েল কিংবা মোতালেব লীগ। এর বাইরে গেলেই কোণঠাসা হওয়া থেকে ছিটকে পড়তে হবে দল থেকে। এ ছাড়া অন্য যারা মনোনয়ন চান তারা অবশ্য গ্রুপিং প্রশ্নে এতটা প্রকাশ্য নন।’
নেতাদের এই বিরোধের প্রভাব পড়ে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলোতেও। উপজেলা শিক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা প্রশ্নে প্রতিনিয়তই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। দেখা গেল একই ইস্যুতে ৩ পক্ষে অবস্থান নিয়ে ফোন করেন ৩ নেতা। তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।’ উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়েই কেবল নয়, এই ৩ নেতা আমাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দিয়েও নানা বিষয়ে ফোন করান। তখন মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই।’
নেতাদের এই দ্ব›দ্ব আর বিভক্তির কারনে দল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা নিয়ে যে নেতাদের খুব একটা মাথাব্যথা আছে তেমনটা মনে হয় না। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পৌর এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘এদের মধ্যে এমন নেতাও আছেন যিনি চাইলে সোনায় মুড়িয়ে দিতে পারেন পুরো বাউফল। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এখানে হয়নি আওয়ামী লীগের একটি নিজস্ব কার্যালয়। উপজেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অবস্থাও তথৈবচ। এদের যন্ত্রণায় এখন সত্যিকার অর্থেই বিরক্ত দলের সাধারণ কর্মী সমর্থক আর ভোটাররা। এরা যদি দল আর এলাকার ভালো চাই তো তাহলে বাউফল হতে পারত দক্ষিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ উপজেলা শহর। বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে স্বীকার করে মেয়র জুয়েল ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব বলেন, ‘দ্ব›েদ্বর কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে আছে এমনটা নয়। এখানে পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের আওতায় সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। তাছাড়া নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে কোনো মানুষও বিপদে পড়ছে না। সবার সব সমস্যাতেই তাদের পাশে থাকছি আমরা।’
