যুগান্তরকে ফুলপরী খাতুন

আমরা প্রতিবাদ করলেই অন্যায় থেমে যাবে

 সরকার মাসুম 
১৭ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নির্যাতনের শিকার ফুলপরী খাতুনই একমাত্র ভুক্তভোগী নন। এর আগেও ঘটেছে র‌্যাগিং-নির্যাতন। তবে সেই ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ তা সহ্য করতে না পেরে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।

কেউবা ভয়-লজ্জায় নীরবে সব মেনে নিয়েছেন। তবে চুপসে যাননি ফুলপরী। ভ্যানচালক বাবার সাহস আর অনুপ্রেরণায় ক্যাম্পাসে ফিরে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করান নির্যাতনকারীদের। সাহসী ফুলপরী বৃহস্পতিবার কথা বলেছেন যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সরকার মাসুম

যুগান্তর : আপনি কেমন আছেন?

ফুলপরী : জি, ভালো আছি।

যুগান্তর : এখন শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ আছেন?

ফুলপরী : না, এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠিনি। নির্যাতনের সময় তারা আমার মাথায় আঘাত করেছিল। এখনো মাঝেমধ্যে মাথা ব্যথা করে।

যুগান্তর : নতুন হলে উঠে কেমন লাগছে?

ফুলপরী : হলের সবার সঙ্গে আমি ভালোভাবেই মিশে গেছি। এখানে সবাই অনেক ভালো। সবার সঙ্গে মিলেমিশে খুব ভালো সময় কাটছে। হলের সবাই আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। তবে এখন পড়াশোনায় বেশি মনোযোগ দিয়েছি। যেহেতু এক মাস ক্লাসে ছিলাম না, তাই আমি অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছি। এজন্য আমাকে একটু বেশি পড়তে হচ্ছে।

যুগান্তর : শিক্ষক, সহপাঠী ও হলের আবাসিক ছাত্রীদের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?

ফুলপরী : শিক্ষকরা নিয়মিত আমার খোঁজখবর রাখছেন। কিছুদিন ক্লাস না করায় একাডেমিক কার্যক্রম থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় সহপাঠীরা পড়াশোনার বিষয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে।

যুগান্তর : ওই রাতের নির্যাতনের ঘটনা এখনো আপনার মনে পড়ে? তখন কেমন বোধ করেন?

ফুলপরী : আমি চেষ্টা করি এগুলো ভুলে থাকতে। কিন্তু বারবার আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। যখন একাকী বসে থাকি, তখন এগুলো বেশি মনে পড়ে। তখন খুব কষ্ট হয়। আমি হয়তো ধীরে ধীরে সব ভুলে যাব। কিন্তু আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা তো হয়েই গেছে। আমি চাই, আর কারও সঙ্গে যেন এমন ঘটনা না ঘটে।

যুগান্তর : ওই ঘটনা আপনার পড়াশোনায় কেমন প্রভাব ফেলেছে?

ফুলপরী : আমি এক মাস ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এজন্য আমার পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হয়েছে। এখন একটু বেশি পড়াশোনা করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।

যুগান্তর : প্রতিবাদী হয়ে ওঠার মূল অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?

ফুলপরী : অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা আমার অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা আমাকে এমন শিক্ষা দিয়েই বড় করেছেন। আমি ওই রাতেই সিদ্ধান্ত নিই, আমি এর প্রতিবাদ করব। কারণ, যদি আমি এর প্রতিবাদ না করি, তাহলে তারা পাঁচ বছর ধরে আমার সঙ্গে এমন আচরণ করবে। পরে আমি আমার বাবাকে সবকিছু বললে তিনিও আমাকে সাহস দেন। বাবাই আমার বড় অনুপ্রেরণা।

যুগান্তর : পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে আপনাকে কতটুকু প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে?

ফুলপরী : আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা ভ্যানচালক। তার রোজগারই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। আমাদের চার ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ বহন করতে বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমার বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে। আর আমার ছোট ভাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আর্থিক কারণে অনেক সময় সমস্যায় পড়েছি। তবে তা পার করে এসেছি। আমার বাবার স্বপ্ন, আমরা চার ভাইবোন পড়াশোনা করে অনেক বড় হব। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব। শত প্রতিবন্ধকতা এলেও বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।

যুগান্তর : এ ঘটনায় আপনার/পরিবারের সামাজিক অবস্থানে ইতিবাচক/নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েছে?

ফুলপরী : এলাকার অনেক মানুষই এখন আমাদের বাসায় আসেন। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেন। অনেকে তাদের মেয়েকে বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠাতে ভয় পাওয়ার কথা জানায়। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভয় দিয়েছি। আমার ব্যাপারেও পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেক ইতিবাচক।

যুগান্তর : আপনি অভিযুক্তদের কেমন শাস্তি চান?

ফুলপরী : আমি চাই তারা যেন স্থায়ী বহিষ্কার হয়। তা না হলে ওই রাতে তাদের চোখে-মুখে যে ভয়ংকর ক্রোধ দেখেছি তাতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলে অন্য কারও সঙ্গে আবারও একই আচরণ করতে পারে। তাদের থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তি পাক।

যুগান্তর : কোনো ধরনের হুমকি-ধমকি পেয়েছেন?

ফুলপরী : না, এখনো কোনো হুমকি-ধমকি পাইনি।

যুগান্তর : আপনি কি এখনো নিরাপত্তা শঙ্কা অনুভব করেন?

ফুলপরী : আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। কে ছাত্রলীগ করে বা কে কোন দল করে, এসব দেখিনি। ছাত্রলীগ না হয়ে অন্য কোনো সংগঠনের হলেও প্রতিবাদ করতাম। আমার বোনও ছাত্রলীগ করেন। নিরাপত্তা শঙ্কা আছে। তবে আমি এতে ভয় পাই না।

যুগান্তর : ওই রাতের ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে বলুন।

ফুলপরী : আমার সঙ্গে ওই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার যতটুকু বলেছি, এর চেয়েও অনেক খারাপ কিছু আমার সঙ্গে ঘটেছে। আমি সব বলতে পারিনি। ওই স্মৃতি মনে করতে চাই না। আমার সঙ্গে যেটা হয়েছে, সেটা যেন অন্য কারও সঙ্গে না হয়।

যুগান্তর : শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে ভয়ে মুখ খোলে না। তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন?

ফুলপরী : আমার মনে হয়, প্রত্যেকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। হোক সেই অন্যায় ছোট কিংবা বড়। আমরা প্রতিবাদ করলেই অন্যায় থেমে যাবে। না করলে তা চলতেই থাকবে। আমি মনে করি, এ ক্যাম্পাসে আর কোনো র‌্যাগিং, নির্যাতন হবে না।

যুগান্তর : যুগান্তরকে সময় দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।

ফুলপরী : যুগান্তরকেও ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা আমার পাশে থেকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ফুলপরীর ওপর নির্যাতন চালায় শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মী। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে বিচার দাবি করেন তিনি। ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। টনক নড়ে প্রশাসনের। পরে অভিযুক্ত শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, মোয়াবিয়া জাহান, তাবাসসুম ইসলাম, হালিমা খাতুন ঊর্মি, ইসরাত জাহান মীমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাদের বহিষ্ককার করা হয় ছাত্রলীগ থেকেও।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন