বাজেট ২০২৩-২৪
করজাল বিস্তারে একগুচ্ছ প্রস্তাব
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকি ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আর একদিন বাকি। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটে নির্বাচনকালীন জনতুষ্টির চেয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন আয়কর আইন প্রণয়ন ও করজাল বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হয়েছে।
গরিব, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে কর আদায়ে ছক এঁকেছেন অর্থমন্ত্রী, ছাড় দিয়েছেন উচ্চবিত্ত ধনীদের। করজাল বিস্তারে একগুচ্ছ প্রস্তাব থাকছে আগামী বাজেটে।
করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার টাকা কর : আগামী অর্থবছর থেকে সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-পাঁচ লাখ টাকা বেশি ঋণ নিতে; সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে; জমি-ফ্ল্যাটের দলিল করতে; গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে স্লিপ বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হয়।
এই স্লিপ পেতে ১ জুলাইর পর থেকে করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতে হবে। মূলত গরিব, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষকেই এ কর দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী মনে করেন, রাষ্ট্র থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে ন্যূনতম কর দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব।
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে : মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। একইভাবে মহিলা করদাতাদের ৪ লাখ টাকা, তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধীদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ লাখ টাকা করা হচ্ছে।
ন্যূনতম কর আগের হারেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার জন্য পাঁচ হাজার টাকা, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতার জন্য চার হাজার টাকা এবং সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্যান্য এলাকার করদাতার জন্য তিন হাজার টাকা থাকছে।
ব্যাংক বেশি জমালে বেশি কর ছাড় : ব্যাংক ডিপিএসে (ডিপোজিট পেনশন স্কিম) কর রেয়াতের সীমা বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকে বেশি টাকা জমালে বেশি কর ছাড় পাওয়া যাবে। বর্তমানে ৬০ হাজার টাকা (মাসিক পাঁচ হাজার) পর্যন্ত ডিপিএসে কর রেয়াত পাওয়া যায়, এটি বাড়িয়ে এক লাখ ২০ হাজার (মাসিক ১০ হাজার) টাকা করা হচ্ছে। নতুন আয়কর আইনে বিষয়টি উল্লেখ থাকছে।
একাধিক গাড়ি থাকলে পরিবেশ সারচার্জ : একাধিক গাড়ি থাকলে রেজিস্ট্রেশন বা ফিটনেস নবায়নে ‘পরিবেশ সারচার্জ’ আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে একাধিক গাড়ি রেজিস্ট্রেশন বা ফিটনেস নবায়নে দ্বিতীয় গাড়ির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বাড়তি অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। এর সঙ্গে কার্বন সারচার্জ যুক্ত হতে যাচ্ছে। ১৫০০ সিসি বা ৭৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির জন্য ২৫ হাজার টাকা, ১৫০০ সিসি (৭৫ কিলোওয়াট) থেকে ২০০০ সিসির (১০০ কিলোওয়াট)
গাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ সিসি (১০০ কিলোওয়াট) থেকে ২৫০০ সিসির (১২৫ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি (১২৫ কিলোওয়াট) থেকে ৩০০০ সিসির (১৫০ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩০০০ সিসি (১৫০ কিলোওয়াট) থেকে ৩৫০০ সিসির (১৭৫ কিলোওয়াট) গাড়ির জন্য দুই লাখ টাকা এবং ৩৫০০ সিসি (১৭৫ কিলোওয়াট) বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা কার্বন সারচার্জ দিতে হবে।
ধনীদের কর ছাড় : ধনীদের ওপর করের বোঝা কমানোর প্রস্তাব থাকছে। এখন বিত্তশালীদের তিন কোটি টাকা বেশি সম্পদ বা একাধিক গাড়ি বা আট হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের গৃহসম্পত্তি থাকলে সারচার্জ বা সম্পদ কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আগের হারেই কর দিতে হবে। এতে ধনীদের কম আয়কর দিতে হবে।
করপোরেট করে পরিবর্তন নেই : টানা ৩ বছর কমানোর পর আগামী বাজেটে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে না। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত; ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান; মোবাইল কোম্পানি এবং সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চলতি বছরের হারেই করপোরেট কর দিতে হবে।
জমি রেজিস্ট্রেশনে উৎসে কর বাড়ছে : কর আদায় বাড়তে জমি রেজিস্ট্রেশনের উৎসে কর বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় দলিলে লিখিত মূল্যের ১ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি, ১ দশমিক ৫০ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক,
এলাকাভেদে স্থানীয় সরকার কর ২-৩ শতাংশ এবং রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ও সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) অন্তর্ভুক্ত এলাকার জন্য ৪ শতাংশ, অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার জন্য ৩ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে জমি রেজিস্ট্রেশনে উৎসে কর ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে রাজউক ও সিডিএ অন্তর্ভুক্ত এলাকার জমি রেজিস্ট্রেশনে বাড়তি হারে কর দিতে হবে।
ভ্রমণ কর বাড়ছে : ভ্রমণ কর বাড়ানো হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে আকাশপথে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে, এতদিন দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ কর দিতে হতো না। বর্তমানে স্থলপথে বিদেশ গমনে ৫০০ টাকা ও নৌপথে ৮০০ টাকা কর বহাল রয়েছে, এটি বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে এক হাজার ২০০ টাকা কর আছে, এটি বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হচ্ছে।
অন্য দেশ ভ্রমণে তিন হাজার টাকা কর আছে, এটি চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আকাশপথে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও তাইওয়ান ভ্রমণে যাত্রীপ্রতি চার হাজার টাকা ভ্রমণ কর আছে, এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হচ্ছে।
স্বর্ণের বার আনায় নতুন নিয়ম : ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করতে ব্যাগেজ রুল সংশোধন করা হচ্ছে। বর্তমানে ২৩৪ গ্রাম (২০ ভরি) ওজনের স্বর্ণের বার ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে আনা যায়।
বাজেটে স্বর্ণের বার আনায় লাগাম টানা হচ্ছে। ১১৭ গ্রাম (১০ ভরি) ওজনের একটির বেশি স্বর্ণের বার আনা যাবে না। একটির বেশি বার আনলে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। একইসঙ্গে ভরিপ্রতি ৪ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। অবশ্য আগের নিয়মেই একশ গ্রাম স্বর্ণালংকার আনা যাবে, এজন্য শুল্ক দিতে হবে না।
