বরিশাল সিটি নির্বাচন
প্রচারে সাবেক মেয়র হিরন বন্দনা
সবাই চান তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জীবিত হিরনের চেয়ে মৃত হিরন যে এখনো কতটা শক্তিশালী, তা আবার প্রমাণ হলো বরিশালের নির্বাচনি প্রচারে। নৌকার প্রার্থীর প্রচারে যেমন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে এই নেতার নাম, তেমনই একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিরনের পথ অনুসরণ করে উন্নয়ন করার কথা বলছেন লাঙ্গলের প্রার্থী তাপস।
এই দুজনার প্রচারেই কেবল নয়, সাধারণ ভোটারদের মুখেও শওকত হোসেন হিরন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে নিজে হেরে পুরো বরিশালকে হারিয়ে দেওয়া হিরনের মতো একজনকে এবার মেয়র হিসাবে চাইছেন বরিশালবাসী। সাধারণ মানুষের এই চাওয়া বুঝতে পেরে নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীরা বলছেন হিরনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার কথা।
নব্বই-পরবর্তী সময়ে প্রায় কোনো নির্বাচনেই বরিশালে জয়ের মুখ দেখেনি আওয়ামী লীগ। ২০১৮-এর নির্বাচনে সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র হলেও তখন ভোট নিয়ে ছিল বিস্তর অভিযোগ। নিরপেক্ষ নির্বাচনে বরিশালকে প্রথম ও শেষবারের মতো জয়ের মুখ দেখিয়েছিলেন সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন। ২০০৮-এর ওই নির্বাচনে মাত্র ৫১৮ ভোটের ব্যবধানে জিতে মেয়র হলেও পরবর্তী সাড়ে ৪ বছরে তিনি বরিশালকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৭ বছর পর উন্নয়ন প্রশ্নে পৌরসভার রূপ থেকে বেড়িয়ে নগরের মর্যাদা পায় বরিশাল। সড়ক বিভাজন, ফুটপাত, দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতি আর ডজনের বেশি পার্ক নির্মাণ করে নগরের চোহারাই ঘুরিয়ে দেন তিনি। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক বরিশাল তথা হিরনের নাম।
কেবল উন্নয়নই নয়, মানবিক সহায়তা, সব দলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে মুহূর্তেই মিশে যাওয়ার অনন্য যোগ্যতায় হিরন হয়ে ওঠেন রাজনীতির এক নতুন ধারার প্রতীক। যে কোনো মানুষের মন জয় করার অসাধারণ ক্ষমতা থাকা এই মানুষটি ২০১৩-এর নির্বাচনে হেরে যান বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আহসান হাবিব কামালের কাছে। ভোটের মাত্র কদিন আগে ঢাকায় হেফাজত-কাণ্ড আর নিজ দলেরই একটি অংশের শঠতার কারণে তখন হিরন হেরে যান বলে ধারণা নির্বাচন বিশ্লেষকদের।
সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর দলীয় মনোনয়নে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হলেও বেশি দিন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেননি হিরন। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল এক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু হয় জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক নেতার। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নির্বাচনে হারলেও বরিশালের মানুষের কাছে ঠিক কতটা প্রিয় ছিলেন হিরন, এর প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অনুষ্ঠিত জানাজায়। বিশাল ওই উদ্যানে হিরন ছাড়া আর কারও জানাজা হয়নি আজ পর্যন্ত।
লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেয় ওই জানাজায়। পরিস্থিতি এমন ছিল যে জনতার ঢল সামলাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই জানাজা শেষ করতে বাধ্য হন উপস্থিত নেতারা। সেই থেকেই জীবিত হিরনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে আছেন মৃত হিরন। উন্নয়ন তথা রাজনীতি প্রশ্নে হিরনের সঙ্গে অন্যদের তুলনা করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন বরিশালের মানুষ। একই পরিস্থিতি আবার ফিরে এসেছে এবারের নির্বাচনে। সাদিক মেয়র হওয়ার পর আওয়ামী রাজনীতিতে কোণঠাসা ছিলেন হিরন অনুসারীরা। মৃত্যুর পর হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা এমপি হলেও হিরনপন্থিদের চাওয়া পূরণ করতে পারেননি তিনি। খোকন সেরনিয়াবাত দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে নির্বাচনি মাঠে নামেন হিরন অনুসারীরা। প্রচারে হিরনের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন তারা। হিরনের পর বরিশালে আর কোনো উন্নয়ন না হওয়ার কথা বিভিন্ন বক্তব্যে বলছেন খোকন।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হক বলেন, ‘উন্নয়ন ও রাজনীতি প্রশ্নে মেয়র হিরন একজন কালোত্তীর্ণ নেতা। বরিশালের মানুষের মনে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন তিনি। আমাদের প্রার্থীও চাইছেন এখানে তার অভাব পূরণ করতে। হিরনের অভাব পূরণই কেবল নয়, আমি তো মনে করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাই হিসাবে তিনি হিরনের চেয়েও বেশি বরাদ্দ এনে বরিশালকে আরও আধুনিক নগরী হিসাবে সাজাতে পারবেন।’
খোকন সেরনিয়াবাতের মতো জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসও আছেন হিরনবন্দনায়। অবশ্য এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি। কেননা মেয়র হিরন ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আগে হিরন ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসাবে বরিশালের উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। তাপস অবশ্য তখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তার মৃত্যুর পরই রাজনীতির মাঠে নামেন তিনি। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো করছেন মেয়র পদে নির্বাচন। নির্বাচনি মাঠে কেবল অনুসরণ নয়, হিরনকে প্রায় অনুকরণ করছেন তাপস। চলনবলন, পোশাক আর আচার-আচরণেও যেন হিরনের প্রতিকৃতি। সাধারণ মানুষের মাঝে মুহূর্তেই মিশে যাওয়া আর মানবিক সহায়তা নিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গুণ হিরনের মতো রয়েছে তারও। অনেক ভোটারের মতে, হিরনের ছায়াই যেন মিলছে তাপসের মধ্যে।
এ ব্যাপারে আলাপকালে ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, ‘শওকত হোসেন হিরন তো অনুসরণ করার মতোই একজন নেতা। এই শহরের এমন কোনো মানুষ নেই যিনি হিরনের মৃত্যুর পর চোখের পানি ফেলেননি। বন্ধু হিসাবে খুব কাছ থেকে দেখেছি তাকে। বরিশালকে কী করে সাজাবেন, কী করে এই নগরীর উন্নয়ন করবেন-এ নিয়েই ছিল তার ভাবনা। এমন একজন মানুষের সমান তো আর হতে পারব না। তবে চেষ্টা করছি কাছাকাছি যাওয়ার। বরিশালের মানুষ যদি আমাকে মেয়র নির্বাচিত করে, তাহলে হিরনের পথ অনুসরণ করেই নগরবাসীর ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করব। এ কথা তো আমরা কেউ কোনোদিনই ভুলতে পারব না যে, আমাদের একজন হিরন ছিলেন, যিনি তার মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত কেবল আমাদের তথা বরিশালের কথাই ভেবেছেন।’
