Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু

প্রতিদিন টোল না দিয়ে পার হয় হাজার গাড়ি

বছরে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে পৌনে তিন কোটি টাকা * ইউপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও আ.লীগ নেতারাও নিচ্ছেন সুযোগ

Icon

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিদিন টোল না দিয়ে পার হয় হাজার গাড়ি

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাহ আমানত (তৃতীয়) সেতুতে প্রতিদিন গড়ে অন্তত এক হাজার গাড়ি টোল না দিয়ে পার হচ্ছে। কেবল ডিউটিতে থাকা সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স টোল ফ্রি সুবিধা বা এক্সাম্পশান পাওয়ার কথা। অথচ কর্ণফুলী সেতু দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-পাতিনেতারা প্রতিনিয়তই টোল না দিয়ে বীরদর্পে পারাপার হচ্ছেন। টোল দাবি করলেই তাদের অনেকে হামলে পড়ছেন আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের লোকজনের ওপর।

এছাড়া পুলিশ, সাংবাদিক, এমনকি বিচার বিভাগের লোকজনও ৭৫ থেকে ১০০ টাকা গাড়ির টোল না দিতে যেন সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন এ সেতুতে এসে। এক্ষেত্রে এগিয়ে কর্ণফুলী উপজেলার লোকজন। এ উপজেলাতেই বসেছে টোলবক্স। এলাকার চেয়ারম্যান, নেতা-পাতিনেতারা টোল দিয়ে সেতু পার হতে একবারেই নারাজ। ফলে টোল আদায়কারীরা ঝামেলা এড়াতে তাদের গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। যদিও প্রতিদিন কতটি গাড়ি, কার নামে নিবন্ধিত গাড়ি পার হয়েছে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে সফটওয়্যারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোল না দেওয়ায় প্রতিবছর সরকারের গচ্চা যাচ্ছে পৌনে তিন কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা যুগান্তরকে বলেন, এমন কোনোদিন নেই টোল আদায়কারীদের সঙ্গে ফ্রি পারাপারের সুযোগ নিতে চাওয়াদের ঝামেলা হয় না। এজন্য ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) সিস্টেমে যাওয়ার চেষ্টা করছি। অক্টোবরের মধ্যেই সব গাড়ি টোলবক্সে রেজিস্ট্রেশন শেষ করবে সড়ক বিভাগ। তখন আর ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে টাকা আদায়ের সুযোগ থাকবে না। তাতে টোল না দিয়ে পার হওয়ারও সুযোগ পাওয়া যাবে না। কেবল যারা আইনিভাবে টোল ফ্রি সুবিধার আওতায় থাকবেন তাদের গাড়িই টোল না দিয়ে পার হতে পারবে।

চলতি সেপ্টেম্বরের ৬ দিন টোল না দিয়ে কী পরিমাণ গাড়ি পার হয়েছে তার একটি চিত্র যুগান্তরের হাতে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, ৪ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৬টি গাড়ি টোল না দিয়ে পার হয়েছে। এর মধ্যে ফ্লিট বা ভিআইপি গাড়ি ছিল ১৭টি। ৫ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ১২৬টি গড়ি পার হয়েছে। এর মধ্যে ভিআইপি গাড়ি ছিল ২টি। ৬ সেপ্টেম্বর ৮৭৯টি গাড়ি ফ্রি পার হয়েছে।

এর মধ্যে ভিআইপি ছিল ৬টি। ৭ সেপ্টেম্বর ১০৩৮টি গাড়ি টোল না দিয়ে পার হয়েছে। এর মধ্যে ভিআইপি গাড়ি ছিল ১৮টি। ৮ সেপ্টেম্বর টোল না দিয়ে পার হওয়া ৯৪৬টি গাড়ির মধ্যে ভিআইপি ছিল ২১টি। ৯ সেপ্টেম্বর ১০৫১টি গাড়ি ফ্রি পার হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ছিল ভিআইপি। এখানে ভিআইপি হিসাবে দেখানো হচ্ছে মন্ত্রী, হুইপ, এমপিসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি।

সূত্র জানায়, পদ্মা ও যমুনা সেতুতে পারাপারের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন আছে। এ দুই সেতুতে একমাত্র দেশের রাষ্ট্রপতি টোল ফ্রি পারাপার হতে পারেন। অথচ কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুতে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার গাড়ি ফ্রি পার হচ্ছে। এতে গড়ে ৭৫ টাকা করে দৈনিক কমপক্ষে ৭৫ হাজার টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। যা মাসে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

‘শিবির’ বলে মারধর : ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্রলীগের সমাবেশে যোগ দিতে আগের দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে কয়েকটি বাসে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এসব বাসের টোল দাবি করলে ছাত্রলীগের ২০-২৫ নেতাকর্মী বুথে ঢুকে টোল আদায়কারী সনজিত কুমার দাশকে শিবির আখ্যায়িত করে মারধর করেন। এছাড়া বান্দরবান চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একটি গাড়ি থেকে ১০০ টাকা টোল আদায় করে মামলার আসামি হয়েছেন দুই টোল আদায়কারী আবদুল মান্নান ও অশোক কুমার ভট্টাচার্য। ২০২১ সালের এপ্রিলে এ ঘটনা ঘটলেও এখনো মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন তারা। অশোক কুমার যুগান্তরকে বলেন, গাড়িতে থাকা একজন নিজেকে নাজির পরিচয় দিয়ে গাড়িটি ম্যাজিস্ট্রেটের বললে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলি। এটিই ছিল আমাদের অপরাধ।

টোল না দেওয়ায় চ্যাম্পিয়ন চেয়ারম্যানরা : জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানরা টোল না দেওয়ায় যেন চ্যাম্পিয়ন। অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও ৭৫-১০০ টাকার টোল না দিয়েই পারাপার হন। কেবল বর্তমান চেয়ারম্যানই নন, কখনো চেয়ারম্যান ছিলেন বা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এমন ব্যক্তিরাও টোল দিতে চান না। অন্যের নামে নিবন্ধিত গাড়িও চেয়ারম্যানদের নামে সেতু পার হচ্ছে ফ্রিতে।

আরও জানা গেছে, পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার, সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ মোতালেব সিআইপি, কর্ণুফলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী, পটিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপির ইদ্রিচ মিয়া, বাঁশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান গালিব সাদলি, লামা উপজেলা চেয়ারম্যান, পটিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান তিমির বরণ চৌধুরী, কর্ণফুলী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমির আহমদ টোল না দিয়ে সেতু পার হন। এছাড়া রয়েছেন পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান ফৌজুল কবির কুমার, একই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, পটিয়ার জঙ্গলখাইন ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সবুজ, কর্ণফুলীর ৩ নম্বর শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোলাইমান, আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসনাইন জলিল চৌধুরী শাকিল, বারশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম শাহ, ছনহরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ। এ চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ আবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সরকারি দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও রয়েছেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক হায়দার আলী রনিও টোল দেন না।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি এহেসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল যুগান্তরকে বলেন, জেলা প্রশাসন বা সরকারি কোনো সভায় যোগ দিতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানরা টোল ফ্রি সুবিধা পেতে পারেন। ব্যক্তিগত কাজে পারাপারে এ সুবিধা পাবেন না। যদি টোল না দিয়ে থাকেন তবে তারা ঠিক করেন না।

কথিত সাংবাদিকরাও কম যান না : প্রেস কিংবা নামসর্বস্ব পত্রিকা, টেলিভিশনের স্টিকার লাগিয়েও দাপটের সঙ্গে টোল না দিয়ে সেতু পার হয় অনেক গাড়ি। তাদের কেউ রীতিমতো টোল বুথে ঝগড়া লাগিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। হুমকি-ধমকিতে তটস্থ রাখেন টোল ম্যানেজমেন্টকে।

পুলিশ সদস্যদের বহনকারী অটোরিকশা : ভাড়া করা সিএনজি অটোরিকশায় সেতু পার হয়ে প্রতিদিন কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন অন্তত ৩০-৪০ পুলিশ সদস্য। তাদের বহনকারী এসব সিএনজি অটোরিকশা টোল দেয় না। টোল দাবি করলেই গাড়ি থেকে নেমে এসে দাপট দেখান পুলিশ সদস্যরা।

সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা কর্তব্যরত অবস্থায় টোল ফ্রি যাতায়াত করতে পারেন। তবে কোনো পুলিশ সদস্য যদি ব্যক্তিগত বা ভাড়ায় চালিত গাড়িতে সেতু পার হতে টোল না দেন সেটা ঠিক নয়। এ বিষয়ে তাদের সাবধান করা হবে। আবার পদ-পদবির প্রভাব খাটিয়ে জোর করে কেউ যদি টোল না দিয়ে সেতু পার হতে চায় বা বিশৃঙ্খলা করে সেটিও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে যদি সড়ক বিভাগ বা ইজারাদার চায় আমরা তাদের সহযোগিতা করব।

এ সেতুর টোল আদায়কারী ইজারাদার প্রতিষ্ঠান শেল-ভান জেভির অপারেশন ডাইরেক্টর প্রকৌশলী অপূর্ব সাহা জানান, পদ্মা ও যমুনা সেতুর জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কর্ণফুলী সেতুর জন্য আলাদা কোনো নীতিমালা নেই। যে কারণে সবাই যে যেভাবে পারেন, নানা পরিচয়ে টোল ফ্রি পারাপারের সুযোগ নিচ্ছেন। এতে সরকার যেমন কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি আদায়কারী হিসাবে তারাও নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাচ্ছেন। এ সেতুর ক্ষেত্রেও যদি সরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে তবে কাউকেই আর সমস্যায় পড়তে হবে না। তিনি বলেন, বিষয়গুলো সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমেরও জানা আছে। তারা বিভিন্ন সময় টোল আদায় কার্যক্রম মনিটরিং করতে এসে এসব চিত্র দেখেছেন। নিশ্চয় সরকার এ বিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম