ইসিতে প্রথম দিনের শুনানি
আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেলেন ৫৬ জন
ভয় দেখালে ভোট বন্ধ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আপিল শুনানিতে ৫৬ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসাবে নির্বাচনে লড়বেন। বাকি ২৩ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন-আওয়ামী লীগের একজন, জাতীয় পার্টির পাঁচ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের চার, তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির তিন, বিএনএফ ও বিএনএমের দুই এবং বিকল্প ধারা, জাকের পার্টি ও ইসলামী ফ্রন্টের একজন করে রয়েছেন।
রোববার নির্বাচন ভবনে আপিল শুনানির প্রথম দিনে ৯৪টি আপিলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আপিলে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এদিন ৫৬ জন প্রার্থীর আপিল মঞ্জুর করা হয়। এর ফলে তারা বৈধ প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। ৩২টি আপিল নামঞ্জুর এবং ছয়টির সিদ্ধান্ত অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের হলরুমে শুনানি করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার কমিশনার। শুনানিতে প্রার্থী ও তাদের আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে শুনানিকালে সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি। শুনানির পর রায় ঘোষণা করে কমিশন। নির্বাচন কমিশন প্রাঙ্গণে স্থাপিত বড় স্ক্রিনে রায় দেখানো হয়। শুনানিতে নেত্রকোনা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের বিকল্প ধারার প্রার্থী মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বগুড়া-৪ আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেস জোটের আশরাফুল আলম (হিরো আলম) ও পাবনা-২ আসনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রার্থী ডলি সায়ন্তনী প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিলের আবেদনের ওপর শুনানি হলেও রায় দেয়নি কমিশন। ওই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকের করা আপিলের রায় কমিশন দেয়নি। এছাড়া কক্সবাজার-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আপিলের শুনানি হলেও সেটির রায় হয়নি। এগুলোসহ সব মিলিয়ে ছয়টি আপিলের রায় হয়নি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা হওয়া মনোনয়নপত্র ১-৪ ডিসেম্বর যাচাই-বাছাই করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এতে ৭৩১টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। আইন অনুযায়ী বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্র বৈধ করা এবং বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করা যায়। এ সংক্রান্ত ৫৬১টি আপিল নির্বাচন কমিশনে জমা পড়ে। রোববার ৯৪টি আপিল শুনানি হয়। আজ আরও ১০০টি আপিল শুনানি হবে। আপিল শুনানি আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
রোববার আপিলে যারা প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন তারা হলেন-ঢাকা-৫ কামরুল হাসান (রিপন), টাঙ্গাইল-২ আসনে ইউনুছ ইসলাম তালুকদার, টাঙ্গাইল-৭ রাফিউর রহমান খান ইউসুফ জাই, জামালপুর-২ জিয়াউল হক জিয়া, গোপালগঞ্জ-১ কাবির মিয়া, চট্টগ্রাম-১ মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম-২ মোহাম্মদ শাহজাহান, চট্টগ্রাম-৮ আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম-১৫ আব্দুল মোতালেব, বরগুনা-১ খলিলুর রহমান, মেহেরপুর-২ মোখলেসুর রহমান, রংপুর-২ বিশ্বনাথ সরকার, ফরিদপুর-১ মাহমুদা বেগম ও মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, মাদারীপুর-২ ইউসুফ আলী সুমন, যশোর-২ এসএম হাবিবুর রহমান, যশোর-৩ মোহিত কুমার নাথ, যশোর-৬ আজিজুল ইসলাম, কুষ্টিয়া-১ ফিরোজ আল মামুন, বরিশাল-৬ মোহাম্মদ শামসুল আলম, কুমিল্লা-৫ সাজ্জাদ হোসেন ও এম এ জাহের, বরগুনা-১ নুরুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর-১ গোলাম মোস্তফা, শরীয়তপুর-২ খালেদ শওকত আলী, নীলফামারী-১ জয়নাল আবেদীন, গাইবান্ধা-২ শাহ সারোয়ার কবীর, গাইবান্ধা-৫ ফারজানা রাব্বী বুবলী, কিশোরগঞ্জ-১ সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম, নেত্রকোনা-৫ আনোয়ার হোসেন, ঝালকাঠি-১ আবুল কাসেম মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ-৬ হালিমুল হক মীরু এবং বগুড়া-৩ আফজাল হোসেন। আপিলে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাসিরুল ইসলাম খান প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির পাঁচজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। তারা হলেন-নোয়াখালী-২ আসনের তালেবুজ্জামান, যশোর-১ আসনের আক্তারুজ্জামান, খুলনা-৬ আসনের শফিকুল ইসলাম মধু, কুমিল্লা-২ আসনের এটিএম মঞ্জুরুল ইসলাম ও গাজীপুর-১ আসনের এম এম নিয়াজ উদ্দিন।
এছাড়া তৃণমূল বিএনপির খুলনা-৪ আসনের শেখ হাবিবুর রহমান, সিলেট-২ আসনে আব্দুর রব এবং সুপ্রিম পার্টির ঢাকা-২০ আসনের মিনহাজ উদ্দিন ও ময়মনসিংহ-১১ আসনের এবিএম জিয়া উদ্দিন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। বিএনএফের মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের মমতাজ সুলতানা আহমেদ ও মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের বাচ্চু শেখের আপিলও মঞ্জুর হয়েছে।
যশোর-৩ আসনের জাকের পার্টির মহিদুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যশোর-৩ আসনের প্রার্থী শেখ নুরুজ্জামান ও পাবনা-২ আসনের ডলি সায়ন্তনীও প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। বাংলাদেশ কংগ্রেসের লালমনিরহাট-২ আসনের মো. দেলাব্বর হোসেন, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের প্রার্থী মো. আব্দুল হামিদ, বগুড়া-৪ আশরাফুল আলম (হিরো আলম) ও নেত্রকোনা-২ আসনের বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মো. আজহারুল ইসলাম খান, ইসলামী ফ্রন্টের ঢাকা-১৩ আসনের মো. জাফর ইকবাল নান্টু এবং জামালপুর-১ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. গোলাম মোস্তফা প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
শুনানি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ : আপিল শুনানি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন টাঙ্গাইল-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী এটিএম আনিসুর রহমান বুলবুল। তার অভিযোগ, তার আপিলের ওপর নির্ধারিত সময়ের ৩৮ মিনিট আগেই শুনানি হয়। এ কারণে তিনি শুনানিতে অংশ নিতে পারেননি। পরে তিনি বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য দিতে গেলে তাকে শুনানিস্থল থেকে পুলিশ দিয়ে বের করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পরে তিনি নিজেই বেরিয়ে যান।
বুলবুল আরও বলেন, আমি শুনানির আধা ঘণ্টা আগেই এসেছি। ভেতরে যাওয়ার পর আমাকে বলা হলো আপনার হেয়ারিং হয়ে গেছে। আমার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার শুনানি ১২টায় ছিল। কিন্তু সিইসি বলেন নো, আপনি হাইকোর্টে যান।
প্রার্থিতা ফিরে পাওয়াদের প্রতিক্রিয়া : স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মোট ভোটারের এক-শতাংশ সমর্থন জমা না দেওয়াসহ নানা কারণে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনে আপিলের মাধ্যমে রোববার অনেকে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এ সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
জনগণ আমার জন্য অপেক্ষা করছে : প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী বলেন, এতদিন প্রার্থিতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। শিগগিরই ঢাকা থেকে পাবনার উদ্দেশে রওনা হব। নির্বাচনি এলাকা জনগণ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্রেডিট কার্ডের খেলাপি ঋণে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল।
আর কোনো বাধা নেই : বগুড়া-৪ আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেস জোটের গণঅধিকার পার্টির প্রার্থী আলোচিত ইউটিউবার আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম বলেন, বিশ্বাস ছিল নির্বাচন কমিশনে প্রার্থিতা ফিরে পাব। এখন আর কোনো ভয় বা বাধা নেই। ডাব প্রতীক পাওয়ার পর মাঠে নামব। তিনি দাবি করেন, কিছু লোকের ষড়যন্ত্রে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী দাবি করায় এবং মোট ভোটারের এক-শতাংশ সমর্থন জমা না দেওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল।
স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বনাথের কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস : রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কৃষিবিদ বিশ্বনাথ সরকার বিটু বলেন, আমার প্রার্থিতা বাতিলের খবরে বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলার মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছিল। তবে আমি প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় দুই উপজেলার কর্মী-সমর্থকরা উচ্ছ্বসিত। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও আসনটি দলীয় সভাপতিকে উপহার দেব। বিটু কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। এ আসনে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) প্রার্থী মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিনের আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে।
সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হব : ফরিদপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমান দোলন বলেন, মহান আল্লাহ সহায় থাকলে সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হব।
জনগণের জয় হয়েছে : কুমিল্লার-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন ও আবু জাহের। প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ মাধ্যমে জনগণের জয় হয়েছে।
বাধাগ্রস্ত হলে কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হবে : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন কী কী কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ হতে পারে এমন কয়েকটি নির্দেশনা তুলে ধরে একটি পরিপত্র জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
রোববার বিকালে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমানের সই করা পরিপত্রটি সারা দেশের রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে যদি কোনো সময় ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত বা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তা ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুনরায় শুরু করা সম্ভব না হয়, তাহলে তিনি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ২৫-এর বিধান অনুসারে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেবেন। বিষয়টি স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি রিটার্নিং কর্মকর্তাকেও জানাবেন।এছাড়া ভোটকেন্দ্রে ব্যবহৃত কোনো স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রিসাইডিং কর্মকর্তার হেফাজত থেকে বেআইনিভাবে ও জোরপূর্বক অপসারণ করা হলে বা দুর্ঘটনাক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা হলে বা হারিয়ে গেলে বা এরূপ ক্ষতিগ্রস্ত বা বিকৃত হলে সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্রের ফলাফল নির্ধারণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রেও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেবেন।
