ছাতক গ্যাসফিল্ড আশার আলো
কমপক্ষে সাত ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুদের সম্ভাবনা * কাজ শুরু করলে ৬ মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব * প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে জাতীয় গ্রিডে
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের বিদ্যমান গ্যাস সংকট নিরসনে আশার আলো হয়ে দেখা দিতে পারে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র। সম্ভাবনাময় এ গ্যাসক্ষেত্রে কমপক্ষে সাত ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুদের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক গ্যাস কোম্পানি ও বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমেও এমন তথ্য জানতে পেরেছে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ গ্যাস ওঠানো হলে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব হবে। আর এ জন্য বাড়তি ব্যয় খুবই কম হবে সরকারের। জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের জন্য সব ধরনের অবকাঠামোও প্রস্তুত আছে এ ক্ষেত্রের। তাদের মতে, ছাতক এমন একটি ক্ষেত্র যেটি এখন শুরু করলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে স্থলভাগে ছাতকসহ বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হলেও সরকার মূলত এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কারণে ওই দিকে এগোচ্ছে না। একই সঙ্গে বাপেক্সের মতো ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’- এমন একটি কোম্পানিকে দিয়ে শতাধিক গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যা কোনোভাবে যথাসময়ে আলোর মুখ দেখবে না বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরুল ইমাম যুগান্তরকে বলেন, ছাতক খুবই সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্র। সুরমা বেসিনে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মতোই বড় মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তিনি বলেন, নাইকোর সংগঠিত দুর্ঘটনায় উপরের স্তরের ক্ষতি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়েছে। তবে পুরো গ্যাস কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ফলে এখানে গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। সরকারের উচিত নাইকোর সঙ্গে চুক্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা দ্রুত মিটিয়ে ফেলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ছাতক সম্পূর্ণ প্রস্তুত একটি গ্যাসের কূপ। এখানে দুটি ক্ষেত্র আছে। একটির সঙ্গে বিদেশি একটি কোম্পানির মামলা বিচারাধীন আছে। অপরটি থেকে যে কোনো সময় গ্যাস ওঠানো সম্ভব। তিনি বলেন, যে কূপ খননে কোনো বিরোধ নেই, সেটি নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা শুরু করছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী গত ৮ সেপ্টেম্বর জ্বালানি সপ্তাহ উপলক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ছাতকে বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এ গ্যাস তোলার জন্য ছাতকের একটি ক্ষেত্রের সঙ্গে নাইকোর চুক্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। এ জটিলতা দূর হলে ছাতক হবে দেশের গ্যাস সংকটের সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। তার মতে, যেহেতু সব ধরনের পাইপলাইন ও অবকাঠামো তৈরি হয়ে আছে, সেহেতু এখন শুরু করলে অল্প সময়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস দেয়া সম্ভব হবে।
সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ১২ নম্বর ব্লকের এ ক্ষেত্রটির আয়তন ৩৭৬ বর্গকিলোমিটার। পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ১৯৫৯ সালে এখানে প্রথম গ্যাস আবিষ্কার করে। ১৯৬০ সাল থেকে ছাতকের একটি কূপ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। তখন দৈনিক ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস তোলা হতো। এ গ্যাস ছাতক সিমেন্ট ও পেপার মিলে দেয়া হতো।
১৯৮৪ সালের পর গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ ‘ওয়ার্কওভার’ করা হলেও তা সফল হয়নি। এর পর গ্যাসক্ষেত্রটিতে আর অনুসন্ধান কাজ চালানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে কানাডার কোম্পানি নাইকো ছাতকসহ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র প্রান্তিক (পরিত্যক্ত) দেখিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। ১৯৯৯ সলে নাইকো ও বাপেক্স একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়। সে সময় বাপেক্স ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণার বিষয়ে আপত্তি জানায়। তাদের যুক্তি ছিল, ছাতক পশ্চিম আলাদা গ্যাসক্ষেত্র, সেখানে কিছু গ্যাস তোলা হলেও ছাতক পূর্বে কখনোই কূপ খনন করা হয়নি, তাই এটি প্রান্তিক হতে পারে না। ফলে তৎকালীন সরকার চুক্তি করেনি। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর নাইকো আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের প্রতিষ্ঠান ‘মওদুদ আহমদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ এর পরামর্শে ছাতক পূর্ব ও পশ্চিমকে একটি গ্যাসক্ষেত্র দেখিয়ে পুরো গ্যাসক্ষেত্র প্রান্তিক ঘোষণা করে সরকার। এরপর ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর যৌথভাবে গ্যাস উত্তোলন করতে নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। পাশাপাশি গ্যাস ক্রয় সংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি হয় বাংলাদেশ সরকার ও নাইকোর মধ্যে।
২০০৫ সালে এই ছাতকের টেংরাটিলায় একটি কূপ খনন করতে গিয়ে দুই দফা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায় নাইকো। এতে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। এরপর থেকে পেট্রোবাংলা নাইকোর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। কিন্তু নাইকো এ ক্ষতিপূরণ দিতে গড়িমসি শুরু করে। এ বিষয়ে স্থানীয় আদালতে ২০০৭ সালে একটি মামলাও দায়ের করে পেট্রোবাংলা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নাইকো ইকসিডে (বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত) গিয়ে ক্ষতিপূরণ না দেয়ার জন্য উল্টো মামলা ঠুকে দেয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। চলতি মাসে ইকসিডের এ সংক্রান্ত রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।
এদিকে নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি বাতিলের আবেদন জানিয়ে ২০১৬ জনস্বার্থে রিট আবেদন করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। ২০১৭ সালের আগস্টে এক রায়ে হাইকোর্ট নাইকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। পরে এর রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল করে নাইকো। বিষয়টি এখনও আদালতে বিচারাধীন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, নাইকোর সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছে নাইকো অনেক আগেই সেই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এখন সরকার যে কোনো সময় নাইকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেশি-বিদেশি অপর যে কোনো কোম্পানিকে দিয়ে এ কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের কার্যাদেশ দিতে পারে। অপরদিকে ছাতক যে অংশের সঙ্গে কোনো মামলা নেই সরকার চাইলে সে অংশে যে কোনো সময় গ্যাস উত্তোলনের কাজ শুরু করতে পারে। কারণ দেশে এখন চরম গ্যাস সংকট চলছে। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ দিয়ে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করছে। কিন্তু দেশে মাটির নিচে গ্যাস থাকলেও সেই গ্যাস উত্তোলনে গড়িমসি করছে।
ছাতকের গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ছাতকে বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এ গ্যাস তোলার জন্য নাইকোর সঙ্গে চুক্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা কাটানোর চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে নাইকোর মামলা সংক্রান্ত বাপেক্সের আইনজীবী ব্যারিস্টার মইন গণি যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে কোনো স্থগিতাদেশ দেননি তাই চুক্তি বাতিলের রায় বহাল আছে ধরে নেয়া যায়। ইকসিডের রায়ও এ মাসে আসতে পারে। ফলে সরকার চাইলে এই গ্যাসক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম ৭৫ কিলোমিটার সিসমিক সার্ভে করে ছাতকে গ্যাসের সন্ধান পায়। এরপর ১৯৬০ সালে এখানে প্রথম কূপ খনন করা হয়। দুই হাজার ১৩৫ মিটার পর্যন্ত খনন করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৯০ মিটার থেকে এক হাজার ৯৭৫ মিটারের মধ্যে নয়টি গ্যাসসমৃদ্ধ স্তরের সন্ধান মেলে। এ গ্যাস কাঠামোর মধ্যে একটি ফাটল রয়েছে। তাই এটি ছাতক পূর্ব ও ছাতক পশ্চিম নামে দুই ভাগে বিভক্ত।
অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি ওয়েলড্রিলের ১৯৯১ সালের জরিপমতে, ছাতকে সাত টিসিএফ গ্যাস রয়েছে। এর মধ্যে ছাতক পশ্চিমে সম্ভাব্য মজুদ ১.৯ টিসিএফ এবং ছাতক পূর্বে মজুদ পাঁচ টিসিএফ। বাপেক্স-নাইকোর ২০০০ সালের যৌথ জরিপে ছাতক পশ্চিমে এক টিসিএফ মজুদের কথা বলা হয়। যুক্তরাজ্যের কেয়ার্ন এনার্জির ২০০০ সালের এক জরিপ তথ্যমতে ছাতক পূর্ব ও পশ্চিমে মোট দুই টিসিএফ গ্যাস রয়েছে। এইচএইচএসপি নামের আরেকটি বিদেশি কোম্পানি ১৯৮৬ সালের এক জরিপে জানায়, ছাতক পূর্বে পাঁচ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে।
