Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

শওকত আলীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য

Icon

আলী রীয়াজ

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শওকত আলীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য

সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শওকত আলীর জীবনাবসানে বাংলাসাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তার অসুস্থতার খবর পেয়ে যে কথাগুলো লিখেছিলাম আজ আবার তা বলতে চাই, এ অসামান্য কথাসাহিত্যিকের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে :

কিছু কিছু লেখক আছেন যারা জীবন সম্পর্কে, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেন; আমাদের তারা যা দেন তা হচ্ছে দেখার চোখ, সমাজকে বোঝার যুক্তি এবং অনুভব করার মতো হৃদয়। এ ধরনের লেখকদের মধ্যে সৃষ্টিশীল লেখকরাই অন্যতম। অন্ততপক্ষে আমার জীবন, আমার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এমন প্রভাব রেখেছেন কিছু লেখক। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী তাদের অন্যতম। তাকে খুব কাছে দেখার সুযোগ হয়নি আমার, যে সামান্য সময়ে তাকে আমি কাছে থেকে দেখেছি তাকে আমি স্যার বলেই সম্বোধন করতাম। ‘করতাম’ বললাম কেননা স্যারের সঙ্গে এক দশকের বেশি সময় ধরে দেখা হয়নি। কিন্তু তার প্রভাব তার লেখার কারণে, আমি তাকে দেখেছি লেখার মধ্য দিয়ে। কিংবা বলতে পারি শওকত আলী নন, কথাসাহিত্যিক শওকত আলী আমাকে নির্মাণ করেছেন। সেটা তার জানার কথা নয়, কেননা এ রকম অসংখ্য মানুষ, অসংখ্য পাঠককে তিনি দিয়েছেন তাদের পৃথিবী। ১৯৭৬, ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে তার তিনটি উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন, কূলায় কালস্রোত এবং পূর্বদিন পূর্ব রাত্রি- প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। এ ত্রয়ী উপন্যাসের আগে ‘পিঙ্গল আকাশ’ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে; কিন্তু এ তিন উপন্যাস আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ষাটের দশকের উত্তাল আন্দোলনের পটভূমি কেবল ইতিহাসের ধারাবাহিক বর্ণনার মধ্যে নেই। যে জাগরণের উত্তরাধিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ তা কেবল ঘটনা পরম্পরা নয়, সমাজের ভেতরে যে বদল ঘটেছিল ধীরে ধীরে তাকে অনুভব না করে ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টার মধ্যে অপূর্ণতা থাকবে সেই সত্য আমি শওকত আলীর উপন্যাস পড়ে উপলব্ধি করি। এই যে উপন্যাসের মধ্যে, রাখির জীবনের মধ্যে, তার ব্যর্থতার, অপূর্ণতার মধ্যে, দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই একটা জনপদের মানুষের ইতিহাস লেখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারি; কিন্তু উপন্যাসের যে শিল্পরূপ তাকে বাদ দিয়ে নয়। হৃদয় দিয়ে ইতিহাসকে বোঝার অর্থ যে সমাজের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করা নয়, সে কথা আমাকে আমার মতো করে বোঝার পথ করে দিয়েছিল এ তিনটি উপন্যাস। কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর জন্য তা যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় সেটা তার পাঠকরা জানেন। ‘ওয়ারিশ’, ‘উত্তরের খেপ’ এবং ‘দলিল’ যারা পাঠ করেছেন তারা শওকত আলীকে বোঝেন কোথায় তার শেকড়। আশ্চর্য এই নয় কী যে, ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতায় একার্থে তিনি উন্মুল; কিন্তু তার লেখার ভেতরে তিনি শেকড় গেড়ে বসে আছেন শহরের আলো থেকে দূরে এমন এক জীবনে যেখানে আমাদের বড় সংখ্যক লেখকরা কখনও যান না? যে মানুষদের কথা তিনি লেখেন তারা ব্রাত্যজন। যে জনপদের কথা তিনি লেখেন সেটি উত্তর বাংলার মানুষের জীবন- যাকে আমরা তার কলমেই চিনি। শওকত আলী আমাদের ইতিহাসচারী হতে বলেছেন, অন্যথায় কেন তিনি ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখবেন? একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন এটা ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়’। কিন্তু ইতিহাস বলতে আমরা কী বুঝব- কেবল ঘটনার বর্ণনা নাকি তার মর্মবস্তু? কথাসাহিত্য আমাদের ইতিহাসের ধারাক্রম বোঝায় না; কিন্তু ফিকশন আমাদের জানিয়ে দেয় সমাজের ভেতরে কী ধারাগুলো প্রবাহিত হয়েছিল। একে অপরের বিকল্প নয়; কিন্তু সমাজের ভেতরে আমাদের নিয়ে যেতে পারেন কথাসাহিত্যিকরা। সবাই পারেন আমি সেই দাবি করি না; কিন্ত শওকত আলী পারেন সেটা তার উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত। আমি সেভাবেই শওকত আলীকে বুঝি। সেভাবেই শওকত আলী আমার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উপস্থিত থাকেন।

শওকত আলী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম