Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অভিভূত রূপকের কবি আমিনুল ইসলাম

Icon

অসীম সাহা

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রথাগত তালিকার বাইরে যে-সব কবির অবস্থান, তাদের চিনে নিতে কিছুটা সময় লাগলেও শক্তিমত্ত রণাঙ্গনের অভিসারী কবিদের দখলে থাকা মহাকালের রথের চাকা সঠিকভাবে ঘুরতে থাকলেই সেখান থেকে তাদের ছিটকে পড়তেও বেশি সময় লাগে না। জীবনানন্দ দাশের সমকালীন অনেক কবির বিবর্ণ পরিণাম তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

কথাগুলো মনে হল আপাদমস্তক অনেকটাই আড়ালে থাকা কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা পড়ে। সত্যি কথা বলতে কী, বিচ্ছিন্নভাবে পত্রপত্রিকায় তার কিছু কিছু কবিতা পাঠ করলেও একনাগাড়ে তার কবিতা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু পড়তে গিয়ে যে কবিকে আমি আবিষ্কার করলাম, তিনি শুধু কবি নন, প্রথাগত অনেক কবির চেয়েও অনেক বেশি কবি। এটা বললেও বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না যে, আমিনুল ইসলামের কবিতা বিষয়ে যেমন, তেমনি অবকাঠামোতেও ভিন্নধর্মী। আত্মমগ্ন ভুবনের বাসিন্দা হলেও তার কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, পুরাণ কিংবা নতুনের সঙ্গে পুরনো, রোমান্টিকতার সঙ্গে বর্তমান আধুনিকতার এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মিথষ্ক্রিয়ার যে নান্দনিকতা ও প্রাসঙ্গিক মেলবন্ধন তিনি ঘটিয়েছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু তাই নয়, তার কবিতা আধুনিক তো বটেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধুনিকের চেয়েও বেশি আধুনিক। তবে তা কোনোমতেই তথাকথিত উত্তরাধুনিক নয়!

আমিনুল ইসলামের কবিতা তাই আধুনিক হয়েও মৃত্তিকাসংলগ্ন। কারণ তিনি নিজেও একজন কৃষকের সন্তান। তিনি যখন আত্মমগ্নতায় উচ্চারণ করেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ; সাধারণ পরিবারে জন্মলাভ করে সাধারণ পরিবেশে সাধারণের একজন হয়ে বেড়ে উঠেছি।’ ‘যে কোনো অর্থেই আমি জলের সন্তান- কোনো জনমে জলের সন্তান ছিলাম কিনা জানি না।’ এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণের হয়েও একজন অসাধারণ মানুষের পরিচয় দিয়েছেন। কারণ এমন স্বীকারোক্তি সবাই দিতে পারেন না। পারেন না, কারণ ভয় কিংবা হীনমন্যতা। সেখান থেকে একজন আমিনুল ইসলাম নিজেকে শুধু ব্যক্তি হিসেবে নয়, কবি হিসেবেও অনেক উচ্চতায় স্থাপন করতে পেরেছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা তার প্রমাণ।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে তিনি তার কবিতাকে নিয়ে খেলেছেন, ছুড়ে ফেলে আবার লুফে নিয়েছেন; কিন্তু কখনও কবিতার শিল্পমান্যতাকে গৌণ করে দেখেননি। তার মধ্য দিয়েই তিনি নিজের কবিতার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের কবিতা নিয়ে তিনি যদি জীবনানন্দের ভাষায় বলেন, ‘আমার মতন আর কেহ নাই’- তা হলে তিনি খুব বেশি কিছু বাড়িয়ে বলবেন, তার কবিতা পড়ে আমার অন্তত তা মনে হয়নি। তার কবিতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে কবিতার বিষয় ও তার বিনির্মাণে এক অভিভূত অনুরণন সৃষ্টির ক্ষমতা। যে কোনো কবিতা পাঠ করলেই পাওয়া যাবে চমক, যা কখনও স্টান্টবাজির পর্যায়ে পড়েনি। উপমা ও উপমানের মধ্যে এক বিস্ময়কর ভারসাম্য রক্ষা করে তিনি তার কবিতাকে করে তুলেছেন কখনও মৃন্ময়, কখনও তন্ময়।

সে-‘ভালোবাসার ভূগোল’- এই হোক কিংবা ‘অভিবাসী ভালোবাসা’তেই হোক। কবিতায় ইউ টার্ন নেয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। আমিনুলের আছে। এ-ধরনের মোড় ঘোরানোতে ঝুঁকি আছে। এতে দুর্ঘটনার ভয় থাকে, তার কোনো কোনো কবিতায় সেই দুর্ঘটনার ক্ষত থাকলেও অধিকাংশ কবিতাতেই নেই। একজন কবির জন্য এটাও কিন্তু কম, শ্লাঘার ব্যাপার নয়।

আমিনুল ইসলাম প্রেমের কবিতায় অনুরাগের সরল পথে হাঁটতে গিয়ে যখন বলেন :

যে আগুনে পুড়ি আমি, তার আঁচ লাগে তোমারও গায়ে

আমি তো ভালোবেসেই আগুন বাড়াই

বাড়ানো আগুনের ছিটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বন্ধ্যা সাঁঝ;

বন্ধ্যা সাঁঝকে আঁকড়ে ধরে বুকে

দাদির আমলের বালতি নিয়ে

এমন আগুনে জল ঢালো কেন?

[অন্য আগুন : ভালোবাসার ভূগালে]

আসলে যে প্রেমের দহনে জ্বলে যায় কবির হৃদয়, তাকে প্রশমিত করতে গিয়ে দাদির আমলের বালতি যে কোনো কাজেই লাগবে না, সেই অন্তর্নিহিত সত্য প্রেমিক হৃদয় ছাড়া বেশি আর কে বোঝে?

বস্তুত শুধু প্রেমের নয়, আমিনুল ইসলামের সব ধরনের কবিতাতেই নতুনত্বের এই চমক পাঠক হৃদয়কে কখনও কখনও শিহরিত করে তুলবে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, তার উপমা ব্যবহারের কৌশল ও দক্ষতা। অবজেকটিভ বিষয়কে সাবজেকটিভ করে তোলার সুনিপুণ কারিগর আমিনুল ইসলাম। একই সঙ্গে আধুনিকতার সব শর্ত পূরণ করেই বিশেষণকে বিশেষে পরিণত করে তিনি যখন তার কবিতাকে এক ধরনের নতুনত্ব দান করেন, তখন প্রচলিত কবিতার সব অনুরাগকে ছাপিয়ে ভূগোলের অদৃশ্য দরোজা উন্মোচিত হয়ে এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হওয়া ছাড়া পাঠকের আর উপায় থাকে না। তিনি যখন বলেন : ‘নৈকট্য আর দূরত্ব চুমু খায় পরস্পরের গালে’ কিংবা ‘অনুমানের হাওয়া খেয়ে ছোট ছোট ঢেউ তোলে-/রাজধানী ছুঁয়ে-থাকা উঁকিমারা স্বভাবের গুটিকয় নদী’, ‘তুমিই প্রথমে চুমু দিলে/অভিমানী সময়ের গালে।’-তখন এক অভিভূত বিস্ময়ের জাদুতে শিহরিত হতে হয়। বাংলাদেশের কবিতায় বাস্তব ও কল্পনার এমন সংমিশ্রণ বলতে গেলে অনেকটাই নতুন।

আমিনুল ইসলামের কবিতা আর একটি বিশেষ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। তা হল আমাদের চেনাজানা জগতের বস্তুগত উপদানগুলোকে কবিতার ভেতরে অনিবার্যভাবে সংযোজন করা।

১। তোমার ব্লাউজ বদলানোর দৃশ্য দেখে

ওয়ালটনের ড্রেসিং টেবিল; না জানুক

এটাই হিমালয়সত্য যে-

প্রস্ফুটিত প্রতিভার মতো সুন্দর কিছুই নেই।

[দ্বিধান্বিত দরজায় দাঁড়িয়ে : অভিবাসী ভালোবাসা]

২. প্রণয়ের ঘরে দরজা-জানালা খোলাই থাকে,

তালাচাবি-মন নিয়ে ব্যক্তিগত কাশিমপুর কারাগারের জেলার হওয়া যায়, প্রেমিক নয়!

[একটি শাড়ি অথবা ওথেলীয় সন্দেহের রুমাল : অভিবাসী ভালোবাসা]

লক্ষণীয়, ওয়ালটনের ড্রেসিং টেবিল, ব্যক্তিগত কাশিমপুর কারাগারের জেলার

এ দুটি পরিচিত বস্তু বা বিষয়কে অনায়াস দক্ষতায় আমিনুল তার কবিতায় তুলে ধরেছেন! এই রূপককে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত পথে হাঁটেননি। বরং তিনি নিজের জন্যই নির্মাণ করেছেন এমন এক রূপক, যাকে রূপক হিসেবে মেনে নিতে অনেককেই দ্বিধান্বিত হবেন। আপাতদৃষ্টিতে একে উপমা বলে মনে হলেও এটা সত্যিকার অর্থেই স্বতন্ত্র রূপক, যা আমিনুলের একান্ত। এ রকম অজস্র উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিংবা রূপকের ব্যবহার আমিনুল ইসলামের কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে!

আধুনিক কবিতার যে মৌলিক শর্ত, শব্দের ব্যবহারে প্রাচীনতাকে পরিহার, আমিনুল তাকে সব সময় মূল্য দেননি। তাতে কি তার কবিতা প্রাচীন হয়ে গেছে? নাকি নব্য-আধুনিকতার সন্ধানে তার যে মন উন্মুখ হয়ে ছিল, তাকেই বিজয়ের রথে চাপাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন! এই নব্য-আধুনিকতা কী দাবি করে? রোমান্টিকতা থেকে মুক্তি? যদি তাই হয়, তা হলে আমিনুল সেই দাবিকে কতটা মেটাতে সক্ষম হয়েছেন, সে প্রশ্নই অনিবার্যভাবে এসে যায়! একই সঙ্গে উত্তরাধুনিকতার যে দাবি একবিংশ শতাব্দীতে এসে এক ভিন্নতর যোজনার উত্তেজনায় দিকহারা হয়ে গেছে। আমিনুল ইসলাম তা থেকে নিজেকে কতটা বিচ্ছিন্ন রেখে আত্মমগ্নতার কাছে আত্মসমর্পণ করে হয়ে উঠেছেন একালের কবি, এ-প্রশ্নও নিশ্চয়ই সমালোচকদের নখাগ্রে চলে আসতে দেরি করবে না।

সেদিক বিবেচনায় রেখেই ঐতিহ্য-পরম্পরার আধুনিকতম কবি হিসেবে আমিনুল ইসলামকে মেনে নিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। প্রেমের কবিতা হোক, প্রকৃতির কবিতা হোক কিংবা সামাজিক অসঙ্গতি- তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে অতিশয় সুকৌশলে, প্রতীকী বিন্যাসে, শিল্পের দাবি অক্ষুণ্ণ রেখেও তিনি বিষয়কে কবিতা করে তুলেছেন। এটা সুকঠিন কাজ। বিবৃতধর্মী কবিতার যে প্রচলিত সহজ পথ, তাকে উপেক্ষা করেই আমিনুল ইসলামের দুর্গম কাব্যযাত্রা। তার প্রতিটি কবিতাতেই তার ছাপ লক্ষ করে বিস্ময়-জাগানিয়ার বিভ্রম কখনও কখনও আমাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, কার সঙ্গে তার কবিতার সাদৃশ্য আছে? যদি বলি, কারোর সঙ্গেই নয়, তা হলে প্রচল কবিদের হাতের শিরা ফুলে উঠতে পারে, উদ্ধত হতে পারে হাতের মুঠো। কিন্তু সত্য এমন কঠিন, যা কবিতার সত্যিকার সাধককে কখনও স্পর্শও করতে পারে না। তাই আমিনুল যত লেখেন, তার খুব বেশি হয়তো তেমন আলোর মুখ দেখে না। কিন্তু যখন সূর্যোদয় হয়, তখন তার আলোর বিচ্ছুরণকে ঠেকাতে পারে, এমন সাধ্য কার? আমিনুল যখন তার ‘শুয়ে আছে সুন্দর’ কবিতায় খুব ক্যাজুয়ালি বলতে পারেন :

“আরে ও বঙ্গোপসাগর, তুমিও তো চেটে খাচ্ছো

উজ্জ্বল এক্সপোজার! খাও,- তবে প্রভাতসূর্যের

দোহাই,- তোমার জিহ্বা নিও না হাঁটুর ওপরে!

ওই সংরক্ষিত সৌন্দর্য শুধু কবির জন্যে প্রকল্পিত।

একটি রোমান্টিক প্রেমের কবিতাকে তিনি কথোপকথনের ভঙ্গীতে এমন সহজ কিন্তু গম্ভীরভাবে উপস্থাপন করেছেন, যার ভেতরে রয়েছে একটি বিশেষ ব্যঞ্জনা। যৌনতার দিকে ধাবিত একটি রূপকল্পকে তিনি অনায়াসে কামহীন সৌন্দর্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির কৃতিত্ব এখানেই।

এ-ধরনের কথ্যভঙ্গীর আরও একটি কবিতা ‘কবির জন্মদিন’:

ও সোনার চামচ- ও রুপোর চামচ- ও খাটপালঙ্ক!

তোমরা না হয় বন্দি ছিলে

চৌধুরীবাড়ির ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে,

তাই বলে চারণ কবির ভিটায় একটি কঞ্চির কলমও থাকবে না কেন?

এ-প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তিনি একটি জ্বলন্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তা হলো মানবসত্য। বন্দিত্বের নামে দায় এড়ানোর কৌশলকে তিনি যেভাবে শনাক্ত করেছেন, সেটা কবি বা সত্যদ্রষ্টার কাজ।

একটি কবিতার নাম ‘সম্পাদনা’। যখন তিনি বলছেন :

পান্তা বেশি না নুন কম- এ-কথার উত্তর পেতে হলে

খলনায়কের মন নিয়ে হেসে ওঠে দুর্ভাগ্য- তার চোখে

উপহাসখচিত অন্ধকার; তোর যেভাবেই হোক- কমবেশি

হয় বলে প্রতিদিন পান্তা ও নুনের অনুপাত দেখে নিতে হয়!

‘খলনায়কের মন নিয়ে হেসে ওঠে দুর্ভাগ্য’ কিংবা ‘উপহাসখচিত অন্ধকার’ পঙ্ক্তিদ্বয় দিয়ে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন? এক ঘনীভূত রহস্যের জালে আটকা পড়ে যায় যায় পাঠকক হৃদয়! তা উন্মোচনের দায়িত্ব পাঠক বা সমালোচকের, কবির নয়। কারণ তিনি ‘সম্পাদনা’ করতে গিয়ে যে-জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা ‘পান্তা ও নুন কমের’ জীবন, যাকে তিনি আত্ম-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অবলোকন করেছেন এবং প্রতি মুহূর্তে অনুভূতির ঘ্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করেছেন বা অভিজ্ঞতা দিয়ে আহরণ করেছেন। তারই প্রতিপাদ্য সঞ্জীবিত হয়েছে এখানে। ফলে কবির কবিতা হয়ে উঠেছে সত্যিকার জীবনের কাব্যিক ভাষ্য।

আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে আমিনুল ইসলাম অতুলনীয়। উপমান আর উপমেয়কে এক করে দেখে তিনি যে-সব উপমা ব্যবহার করেছেন, তার মুনশিয়ানা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ খুব কম। তার সূচনাপর্বের কাব্যগ্রন্থ থেকে মোট ন’টি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা তার পরিমিতিবোধ। অকারণ শব্দ ব্যবহারে বা চিত্রকল্প নির্মাণের শৌখিন বাহাদুুরিতে তিনি অভ্যস্ত নন।

বাংলা কবিতার পরম্পরার কথা মনে রেখে আধুনিকতার উত্তরসূরি হিসেবে তিনি নানামুখী কবিতা নির্মাণ করেছেন; কিন্তু প্রবহমান অক্ষরবৃত্তই তার মূল আধার। তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দেও কবিতা লিখেছেন। সেখানেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার কবিতায় ছন্দপতন এবং অর্ধমিলের ব্যবহার চোখে স্তব্ধতা আনলেও সেটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না তার অন্যান্য কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগে। গতির প্রলম্বিত বৈঠায় টান মারতে মারতে তার কবিতা বহুদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় পাঠকদের। তবে এ কথা সত্যি, আমিনুলের কবিতা বোদ্ধা পাঠকদের প্ররোচিত করলেও যারা কবির অন্তস্থল স্পর্শ করার যোগ্যতা রাখেন না, তারা তার কবিতার নদী সাঁতরে কিছুতেই পার হতে পারবেন না।

আমিনুল পৃথিবীর সব মানচিত্রের দুর্দান্ত পর্যটক। তাই তার দৃষ্টি আর দশজনের মতো নয়! তিনি দেখেন না, অন্তর্গত আলো ফেলে অবলোকন করেন। তার জন্য যে অতলান্ত দুটি চোখ ও মন থাকা দরকার, তা তার আছে। আর আছে তার দুঃসাহস। সরকারি একজন বড় কমকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অসঙ্গতিগুলো ধরিয়ে দেন, তা তির্যক ভাষায় প্রকাশ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেন না।

আমলারা চেয়ার পেলে নিজেদের মানুষ মনে করেন না। সাধারণের কাতার থেকে সরে যেতে তাদের মুহূর্তমাত্র সময় লাগে না। কিন্তু এ চেয়ার যে ক্ষণস্থায়ী, আমিনুল নিজে একজন আমলা হয়েও চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেন। তাই তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারেন :

সেদিন আজকের এই চেয়ারটা-

কোমল অন্তর্বাসের আনুগত্যে

তোমার পাছার সাথে যাবে না

[আমি চেয়ার বলছি : অভিবাসী ভালোবাসা]

চেয়ারের গরমে নিজেদের পশ্চাদ্দেশের ওজন বাড়িয়ে ফেলতে যারা দ্বিধা করেন না, এ-কবিতা তাদের জন্য এক মারাত্মক কশাঘাত! আমিনুল যখন বলেন :

কিন্তু চেয়ারের গরমে অত ওজন বাড়িও না পাছার

যেদিন চেয়ার থাকবে না, সেদিনও

ওই মাংসের ভাগ বহন করতে হবে তোমাকে।

[আমি চেয়ার বলছি : অভিবাসী ভালোবাসা]

তখন এক বিবেকবান ও সত্যনিষ্ঠ মনের সাক্ষাৎ পাই আমরা। জীবিকা যাই হোক, কবিকে যে সত্যদ্রষ্টা হতে হয়, এই কবিতা তার প্রমাণ।

সবশেষে বলি, আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে আরও বহুমুখী আলোচনা হওয়ার দরকার। এ সামান্য পরিসরে তার সবদিক তুলে ধরা অসম্ভব। তবু আমি আনন্দিত যে, তার মতো একজন নির্লোভ কবির কবিতা নিয়ে কিছুটা হলেও আলোকপাত করার সুযোগ পেলাম।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম