Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

ফরিদুর রেজা সাগরের

দেশপ্রেম

Icon

রেজাউদ্দিন স্টালিন

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশপ্রেম

বাংলাভাষার অনন্য শক্তির প্রমাণ পেয়েছিলাম প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে। তার ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’; ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ বাংলভাষার এই গ্রন্থ দুটি আধুনিক বাংলা গদ্যের পথপ্রদর্শক। প্রাকৃত ভাষাই প্রকৃত ভাষা। মধুসূদনই প্রথম আঞ্চলিক প্রান্তিক মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিয়ে যুগান্তর তৈরি করেছিলেন। মধুসূদন পরবর্তী বাংলা গদ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে আভিজাত্য পেয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রাকৃতজনের জিহ্বায় তেমন ঠাঁই পায়নি। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথই বাংলা গদ্যে মধ্যবিত্ত মানুষের রুচিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ তার মতো ক’জন করতে পেরেছে। বলাই, ছুটি, ডাকঘর, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা- এসব গল্পের জুড়ি নেই। বাংলা ভাষার হাসির গল্পেরও রয়েছে এক বনেদি ঐতিহ্য। এর মধ্যে শিবরাম চক্রবর্তী অনন্যসাধারণ। আর ঠাকুরমার ঝুলি তা কি শুধু ছেলে ভোলানো দৈত্যদানবের গল্প তা’ কিন্তু না- সেখানেও আছে দেশপ্রেম, পরাশক্তির ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতীকী জগৎ। নিজের প্রিয়জনকে উদ্ধারের সংকল্প। রাক্ষস নিধনের নানা কৌশল। এক স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি হয়েছে সেখানে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরেক যুগান্তকারী লেখক। শ্রীকান্ত উপন্যাসে ইন্দ্রের যে অভূত সাহস আর মানবপ্রেম তার সংকীর্তন করতেই হয়। রোমাঞ্চকর কত আনন্দদায়ী ছড়া কবিতা আর গল্প আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে তা’ দু-এক পৃষ্ঠায় শেষ হওয়ার নয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা শিশুসাহিত্যের বিকাশ হতে থাকে ৬০ দশক থেকেই। আমরা লক্ষ করি রাহাত খানের দিলুর গল্প। সেখানে একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্ব এবং একটা রহস্যময়তা। হাসান আজীজুল হকের ‘শকুন’ গল্প একদল কিশোরের অভিযান। এমনকি আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়িতে যে শিশু-কিশোর চরিত্র তাও সামাজিক বাস্তবতাজাত। সত্তর দশকের শুরুতেই ইমদাদুল হক মিলনের হাতে ‘চিতা রহস্য’ নামে একটি অসাধারণ লেখা আমরা পাই। কিশোর বাংলায় প্রকাশ পেয়েছিল। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদ কিশোরদের নিয়ে অসাধারণ সব লেখা তৈরি করেন। এমন সব চরিত্র বানালেন যে- আমাদের সমাজের ছেলেরা তার তৈরি চরিত্র হিমু হতে চাইল। কী আছে হিমুর মধ্যে আছে মানবপ্রেম কিন্তু জীবনযাপনে কোথায় যেন উদাসীনতা বর্তমানের প্রতি সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা। নতুন কোনো সমাজের চিন্তা- যেখানে মানুষ হবে নিঃস্বার্থ আর ভালোবাসার প্রতীক। এই সত্তর দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাঙালির জাতীয় জীবনে। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তির স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী আকাক্সক্ষা মানুষের মতো বাঁকা। কিন্তু সব দেশে সবকালে যা’ হয়- স্বাধীনতার শত্রুরা সুবিধাখোর চরিত্রের মানুষেরা ওঁৎ পেতে থাকে। তারা গোপনে দুর্নীতি অনাচার আর কালোবাজারির মাধ্যমে বিত্তবৈভবের মালিক হয় এবং বঞ্চিত হয় সাধারণেরা। যারা রক্ত দিয়েছিল শোষণহীন সমাজের জন্য। দেশপ্রেমের মতো খাঁটি মূল্যবান সম্পদ আর কী আছে? এ সত্তর দশকেই আরেকজন লেখকের আবির্ভাব ঘটে- ফরিদুর রেজা সাগর। একই সঙ্গে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং লেখালেখির পাশাপাশি নানা সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিভায় বহুমুখীনতা ফরিদুর রেজা সাগরকে সমাজে পরিচিত করে তোলে। পিতা চলচ্চিত্র নির্মাতা ফজলুর রহমান, মা বিখ্যাত কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন। পারিবারিক এ পরিমণ্ডল ফরিদুর রেজা সাগরকে শিখিয়েছে দেশকে-মানুষকে ভালোবাসতে। তার বন্ধু কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, নাট্যব্যক্তিত্ব ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন, কৃষি ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ প্রমুখ। এ সময়কাল এবং পরবর্তী আশির দশকজুড়ে ফরিদুর রেজা সাগর নিরবচ্ছিন্ন লিখতে থাকেন নানা ধরনের কিশোর কাহিনী। পাশাপাশি প্রযুক্তির বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় তৈরি করেন চ্যানেল আইয়ের মতো যুগোপযোগী বেসরকারি চ্যানেল। ফরিদুর রেজা সাগর ‘মানুষের মুখ’ শিরোনামে সিরিজগ্রন্থ লিখেছেন। তার পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা আর মানুষ দেখার কৃৎকৌশল ফরিদুর রেজা সাগর শিখেছেন জীবন ও জগৎকে ভালোবাসার মাধ্যমে। যেখানেই গেছেন বাংলাদেশকে বুকে নিয়ে গেছেন। তার সময়ের প্রতিটি দুর্গম পথে আছে তার পর্যটন। তার প্রতিটি গ্রন্থে দেশপ্রেমের যে ছোঁয়া পরিদৃষ্ট তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। বিশেষ করে তার গোয়েন্দা উপন্যাস কাকাবাবু সিরিজের লেখাগুলো। প্রতিটি কাহিনীতে দেশবিরোধী শক্তির অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য কাকাবাবু নামক গোয়েন্দার বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতি। দেশবিরোধী চক্রকে পরাহত করা এবং বিজয়ের সাফল্যে দেশপ্রেমকে সম্পৃক্ত করা- এসব নানা কৌশল আছে অর্থাৎ যাকে আমরা টেকনিক বলি। দুনিয়াখ্যাত এক কিশোর অ্যাডভেঞ্চার ইউলিয়াম গোল্ডিংয়ের লর্ড অফ দা ফ্লাইস’ উপন্যাস। এর মধ্যে এক কিশোর খুনের সঙ্গে যুক্ত। কী সাসপেন্স আর ড্রামা এ রহস্যপোন্যাসের। নোবেল পেয়েছিল এ উপন্যাসের জন্য ইউলিয়াম গোল্ডিং। ফরিদুর রেজা সাগরের নিজস্ব এক ভাষাভঙ্গি আছে- যা সরল আর বোধগম্য এবং সুখকর। স্টিভেনসন বলেন আনন্দদায়ক পাঠের বাইরে সবই মূল্যহীন। এ কথা মনে রাখলে ফরিদুর রেজা সাগরের প্রতিটি গ্রন্থ সুখপাঠ্য এবং আনন্দদায়ী।

সমসাময়িক অনেক উপন্যাসে দেখি পাঁচ বা দশ পাতার প্রয়োজন হয় কোনো কোনো চরিত্রের গুণাগুণ ফুটিয়ে তুলতে কিন্তু ফরিদুর রেজা সাগরের জন্য কয়েকটি লাইনই যথেষ্ঠ। বাকসংযম, আবেগলিপ্ত বাহুল্য বর্জন, অপ্রয়োজনীয় সংলাপ তৈরি থেকে ফরিদুর রেজা সাগর দূরে অবস্থান নেন। তিনি সচেতনভাবে কেন্দ্রীয় মুহূর্তের দিকে ধাবিত থাকেন। প্রত্যেকটি চরিত্রের প্রতি সুবিচার করার দক্ষতা তার আছে। তিনি দয়ালু এবং মানবিক শাস্ত্রের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। একদিকে মানবিক কোমলতা, যাকে শেক্সপিয়র বলেছেন ‘মানব দয়ালুতার দুগ্ধ’। ফরিদুর রেজা সাগরের গল্পের ভেতর গল্প তৈরি হয় এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায়। প্রায় অনির্দিষ্ট এক ধরনের কৌতূহল। আমরা জানি ভাষা এক নান্দনিক সৃষ্টি। আমরা যখন সাহিত্য পাঠ করি- আমাদের অভিজ্ঞতা সুন্দর হয় কখনা আবার বিষাদিত। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসে রয়েছে এক আদর্শ সমতল, তাতে কাহিনী বাস্তবের রাজ্যের ভেতর স্থাপিত থাকে; পাঠকের জগতে এবং বইয়ের জগতে- সেরভেন্তস বিষয়গত এবং আত্মবাদ নিয়ে টানপোড়েন উপভোগ করেছেন এবং আনন্দ উপভোগ করেছেন। ওইসব অধ্যায়ে যার ভেতর চিত্ত নিজেই অস্থির করে তোলে যেখানে ফরিদুর রেজা সাগর নিরপেক্ষ স্রষ্টা। কুষ্টিয়ায় কিছুক্ষণ, নাটক নাটোরে, কুয়াকাটায় কাটাকাটি, চাঁদপুরে চাঁদমারি, এ সিরিজ গোয়েন্দা উপন্যাসগুলো কিশোর পাঠকদের দু’ভাবে প্রশিক্ষিত করে দেয়। প্রতিটি জেলা সম্পর্কে তাদের ধারণা এবং দেশবিরোধী শক্তির অপকীর্তির বিরুদ্ধে সচেতনতা। আমরা একটা উদাহরণে যাব- কুষ্টিয়ায় কিছুক্ষণ গ্রন্থ থেকে-‘এটা জেমস্ বন্ডের ছবি না, শরীফ সিঙ্গাপুরীর পকেটের এইট ইন ওয়ান। সরাসরি সিঙ্গাপুর থেকে ইমপোর্টের মধ্যে ছুরি, স্ক্রুডাইভার, বোটল ওপেনার ছাড়াও আছে পাঁচটি জিনিস। প্রয়োজনের সময় এটি এইট ইন ওয়ান নয় এইটটিন ইন ওয়ান হয়ে যায়। শরীপ সিঙ্গাপুরীর কথাটা কতখানি যে সত্যি সেটা টের পেয়েছিলেন সত্যি সত্যি যখন এইট ইন ওয়ানটা কাজে লেগেছিল তখন।’ বাক্য বিনির্মাণে ফরিদুর রেজা সাগর নির্ভার নির্মোহ। কিন্তু অন্তর্দাহও গভীর এবং কৌতূহলোদ্দীপক। ফরিদুর রেজা একজন ভাল পাঠক। ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর নানা দেশ। সমুদ্রের কোলে আশ্চর্য দ্বীপ, এরবার পিরামিড, আমিশদের সঙ্গে। এ ভ্রমণ কাহিনীর পরতে পরতে দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর যে প্রান্তেই গেছেন খুঁজেছেন বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে। বাংলাদেশের প্রতি তার দায়বদ্ধতাও আমাদের আপ্লুত করে। তার গোয়েন্দা কাহিনীগুলোয় জেগে থাকে বাংলাদেশের প্রকৃতি। কুয়াকাটায় কাটাকাটিতে তিনি লেখেন- এর আগে কখনও আমার কুয়াকাটায় যাওয়া হয়নি। আমার ধারণা ছোটকাকু কখনও যাননি। আর শরীফ সিঙ্গাপুরীর তো প্রশ্নই ওঠে না। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের বড় বৈশিষ্ট্য হল- এখানে একই সঙ্গে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা সম্ভব, ফরিদুর রেজা সাগরের চোখ কান খোলা। তিনি দার্শনিকভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেন- চৌধুরী সাহেব বলেন, ‘শুধু বলতে চাচ্ছি, মানুষ প্রথম দৃষ্টিতে যে চেহারায় জিনিসগুলো দেখে, শেষ পর্যন্ত সেরকম নাও থাকতে পারে জিনিসগুলো। সময় সবকিছু যে বদলে দেয় এ চিরায়ত কথাটি চৌধুরীকে দিয়ে বলিয়ে নেন তিনি। ‘কুয়াকাটায় কাটাকাটি’ গ্রন্থে ছেলেধরার নৌকা, সুড়ঙ্গ আবিষ্কার এবং অবশেষে ছেলধরারা ভয় পেয়ে বাবুলকে ছেড়ে দেয়। সিকোয়েন্স তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ফরিদুর রেজা সাগর ও কি ভ্রমণ কাহিনীতে কি গোয়েন্দাগল্পে। ফরিদুর রেজা সাগরের নিজের চরিত্র স্বাক্ষরও পাওয়া যায় কয়েকটি চরিত্রের সংগঠনে। সব ছাড়িয়ে তার মধ্যে দেশ, দেশের মানুষ আর প্রকৃতি প্রেম প্রজ্বল হয়ে ওঠে। হারম্যান মেলভিলের ‘মবিডিক’ বিখ্যাত উপন্যাস। তিনি শিকারি। ক্যাপ্টেন আহাবের পা কেটে নেয় এক শ্বেত তিমি যাকে সবাই বলে মবিডিক। সেই মবিডিক হত্যার নেশায় জিঘাংসাপ্রসূত আহাব ঘুরতে থাকে সমুদ্রে। অবশেষে এ অভিযানে তার মৃত্যু হয়- কিন্তু মবিডিককে সে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। লেখক শেষে বলেন, মবিডিক প্রকৃতির অংশ তাকে হত্যা অসম্ভব। আমি মনে করি ফরিদুর রেজা সাগরের প্রতিটি গ্রন্থে প্রকৃতিপ্রেম ও দেশপ্রেম অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সুতরাং পাঠক হৃদয় থেকে ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা মুছে ফেলা যাবে না। এই দেশপ্রেমের যে মন্ত্র তিনি গ্রোথিত করেন তা এই স্বাধীন বাংলার উত্তরাধিকার এবং আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কেউ তাকে প্রতিহত করতে পারে না। ফরিদুর রেজা সাগরের এ দেশপ্রেম আমাদের সাহিত্যে শক্তির জায়গা তৈরি করে দিয়েছে যা পরবর্তী লেখকদের অনুকরণীয় আদর্শ হবে বলে মনে করি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম