এখন আর্ট মুভমেন্ট বলে কিছু রইল না, প্রদর্শনীর সফলতা বোঝায় কত টাকা বিক্রি হল সেটার ওপর
মুর্তজা বশীর
মোহাম্মদ আসাদ
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিত্রশিল্পী। গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অব আর্টসের (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) দ্বিতীয় ব্যাচের শিল্পী মুর্তজা বশীর। জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট রমনা, ঢাকা। বাবা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মা মরগুবা খাতুন।
বাবার খরচে ইতালিতে শিল্পকলায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আবার থিতু হয়েছেন মাতৃভূমিতে। অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদে। তার ক্যানভাসে বিষয় বদল করেছেন একের পর এক। এঁকেছেন দেয়াল সিরিজ, এপিটাফ অব মার্টার, প্রজাপতির পাখা, কালিমা তাইয়্যেবা।
তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ শিল্পধারার প্রবর্তক। একাধারে দক্ষ লেখক, মুদ্রাসংগ্রহক, চলচ্চিত্র গড়ার কাজও করেছেন তিনি। মুর্তজা বশীর ভাষাসৈনিক, যুক্ত ছিলেন দেশ স্বাধীন করার কাজেও। একাত্তরের মার্চে চারুশিল্পীদের ‘স্বাধীনতা’ র্যালির তিনি ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। ১৯৮০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ৮৮ বছর পূর্ণ হওয়ার দুই দিন আগে ১৫ আগস্ট সকাল ৯টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই দেশের শিল্প আন্দোলন নিয়ে ২০১৮ সালে স্বাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন -মোহাম্মদ আসাদ
আপনি এই দেশের শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎদের একজন। এই আর্ট মুভমেন্ট কীভাবে এগিয়ে ছিল?
: প্রথম আর্ট মুভমেন্ট বলতে যেটা বুঝায় এর সঙ্গে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা সেটা কিন্তু শুরু হল ১৯৫০ সালে। প্রথম ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রদর্শনী হয় লিটন হলে। এ প্রদর্শনী দেখতে স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঘোড়ার গাড়ি করে এসেছে। লাইন দিয়ে প্রবেশ করে তারা প্রদর্শনী দেখেছে। আমরা তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র।
আপনাদের পরবর্তী প্রদর্শনী ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি?
: ১৯৫২ সালে আর্ট গ্রুপের যে প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল সেদিনই পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। তখন জাতীয় জাদুঘর ছিল নিমতলীতে(যেখানে এখন এশিয়াটিক সোসাইটি)। সেখানে আমাদের চিত্রপ্রদর্শনী হওয়ার কথা। সেই প্রদর্শনী ওপেনিং করবেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের স্ত্রী লেডি ভিকারুন নিসা নূন(যার নামে ভিকারুন নিসা স্কুল)। আমার এখনও মনে পড়ে এক্সিবিশনটা একুশ তারিখে ওপেন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমিনুল ইসলামরা বলছে ২২ তারিখ। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি বলে যে সংকলনটি সেখানে একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর আমার একটি লিনোকাট আছে।
এটি কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রকাশিত প্রথম শিল্পকর্ম। সেখানে আমি ২১ তারিখেই প্রদর্শনী উদ্বোধনের কথা লিখেছি। সেখান থেকেই আন্দোলনে যোগ দেই মেডিক্যালের সামনে গিয়ে। রক্তাক্ত বরকতকে আমি নিয়ে গিয়েছি হসপিটালে। তারপর ছুটে এলাম নিমতলীতে আমাদের আর্ট এক্সিবিশন বন্ধ করার জন্য। জয়নুল আবেদিন তখন লন্ডনে।
আমি নাম বলব না, তখন যারা শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন তারা বলল যেহেতু লেডি নূন ওপেন করবেন, অতএব এক্সিবিশন ওপেন করে বন্ধ করে দেয়া হোক। আমি রাজি হলাম না। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি বললাম তাইলে আমার ছবি আমি রাখব না। তখন আমার পিছে পিছে কাইয়ুম চৌধুরী, বিজন চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী আরও কয়েকজন গেল। সে অবস্থায় আমার জামায় রক্ত। সেদিন সেই প্রদর্শনী বন্ধ হয়েছিল।
আর্ট গ্রুপ পরবর্তীতে আর কোনো প্রদর্শনী করেনি?
: পরবর্তীতে সাধারণের কাছে শিল্পকর্ম নিয়ে যাওয়ার জন্য আর্ট গ্রুপের প্রদর্শনী কুমিল্লা, চট্টগ্রামে হল। সে আর্ট মুভমেন্ট ৫৪ সালের পর আর এগোয়নি। ১৯৫৬ সালে আমরা যখন প্রদর্শনী করছি, কেউ এসে ক্যাটালগ চাইছে। বলছি না ক্যাটালগ নেই। ছবি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছে, বলতে আগ্রহী হচ্ছি না। কারণ সে বায়ার না। কিন্তু যখনই কোনো বিদেশি এলো, খুব কেতাদুরস্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছে যাই। হাতে ক্যাটাল
গ ধরিয়ে দিয়ে পিছে পিছে হেঁটে বলছি এটা আমার আঁকা ছবি। এভাবে আর্টিস্ট সেলসম্যান হয়ে গেল। যে যত ভালো সেলসম্যান হবে, সে তত ছবি বিক্রি করতে পারবে। এখন আর্ট মুভমেন্ট বলে কিছু রইল না। এখন প্রদর্শনীর সফলতা বোঝায় কত টাকা বিক্রি হল সেটার ওপর।
আর্ট মুভমেন্টে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল?
: শিল্পকলাকে সাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। সেটা হল সারা দেশের জেলা শহরে একটি বাসের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। এটা একটা ভালো কাজ ছিল। সবার তো আর ঢাকায় এসে ছবি দেখা সম্ভব হয় না। এ ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর কারণে সারা দেশে আর্টের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা কী কারণে বন্ধ হল আমার জানা নেই।
পেইন্টার্স ইউনিট বলে আমি, সৈয়দ জাহাঙ্গীর কাইয়ুম চৌধুরীরা একটা সংগঠন করেছিলাম ৫৬ সালে। সেটার একটা প্রদর্শনী হয়েছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে। আমি ইতালি চলে যাওয়ায় সেটা আর এগোয়নি।
বাংলাদেশের আর্ট মুভমেন্ট এ পর্যায়ে এলো কী করে?
: বাংলাদেশ হওয়ার পর একটা নিউ ইন্ডাস্ট্রি রাইজ করল। প্রচুর বিত্তবান হল গার্মেন্টস সেক্টরে। এ গার্মেন্টস মালিকরা বিদেশ যাচ্ছে, অবসরে মিউজিয়াম-টিউজিয়ামে যাচ্ছে। অথবা কোন অফিসে দেখে তাদের আর্টের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মেছে। তারা দেখল রিয়ালিস্টেট বিজনেসের চেয়ে আর্টের বিজনেস অনেক লাভজনক। আজকে যেটা পাঁচ হাজার দিয়ে কিনব, পরবর্তীতে সেটার দাম ৫০ হাজার। বর্তমানে যারা ছবির বায়ার তারা বেশিরভাগই গার্মেন্টস সেক্টরের মালিক। তাছাড়া এরই মধ্যে কিছু কালেক্টরও গ্রো করেছে। যারা ভালোবেসেই ছবি কালেকশন করে। এখন কিন্তু শিল্প আন্দোলন নাই।
এখন ধর মোটামুটি আমার ছবি বিক্রি হয়। হয়তো কিছুটা নামের জন্য, অনেকে ভাবে বয়স ৮৬ বছর কখন যানি মরে যায়। মরে যাওয়ার পর ছবি হয়তো অনেক দাম হয়ে যাবে। ১৯৭৬ সালে জয়নুল আবেদিন মারা যাওয়ার আগে হাসপাতালে যখন ছিল তখন আমি এক্সিবিশন করছি জাদুঘরে। আমি সেখান থেকে ডেইলি তাকে হসপিটালে দেখতে আসতাম। সে সময় আমার ছবি বিক্রি হতো পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা।
জয়নুল আবেদিনের ছবিও বিক্রি হতো পাঁচ থেকে ১০ হাজার। আজকে আমার ছবি হল পাঁচ লাখ। জয়নুল আবেদিনের ছবি হল ৫০ লাখ টাকা বা আরও বেশি। এই হল ডিফারেন্স।
মুর্তজা বশীর
জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৩২
মৃত্যু ১৫ আগস্ট ২০২০
আলোকচিত্রী মঈন আহমেদ
