|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ বই ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’। বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক অবিস্মরণীয় নাম। রবীন্দ্রনাথের মতে- ‘আমাদের দেশের লোকেরা একদিক দিয়ে তাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে পারেননি বটে; কিন্তু বিদ্যাসাগর তার চরিত্রের যে মহত্তগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবল তার দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতি দ্বারা তারা ঢেকে রাখতে চান।’ বিদ্যাসাগরের চরিত্রের এ মহৎ গুণ হচ্ছে সেক্যুলারিজম বা ইহজাগতিকতা। ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নবজাগরণের অন্য মনীষীদের চেয়ে বিদ্যাসাগরকে স্বতন্ত্র করেছিল। অথচ বিদ্যাসাগরের এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের দেশে আলোচনা নেই বললেই চলে। এ অভাব মোচনের দুরূহ দায়িত্ব পালন করেছেন কৃতী প্রাবন্ধিক রাজীব সরকার। ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ বইয়ের সূচনা প্রবন্ধে তিনি উপযুক্ত তথ্য ও যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের জীবনব্যাপী ইহজাগতিকতার সাধনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ মননের অধিকারী বিদ্যাসাগরের অবিচল আস্থা ছিল মানবধর্মের প্রতি। লেখক যথার্থই বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের সমস্ত আঘাত, সংঘাত, সাফল্য ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী জীবনদর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানসম্মত জীবনসাধনার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক।’ ‘সমকালীনদের চোখে বিদ্যাসাগর’, ‘বিদ্যাসাগর: নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে রাজীব সরকার দেখিয়েছেন অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব নিয়ে কীভাবে বিদ্যাসাগর সমকালীন মনীষীদের ছাড়িয়ে নিঃসঙ্গ শীর্ষবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ‘আত্মজৈবনিক রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘আমার ছেলেবেলা’ সম্পর্কে প্রাঞ্জল আলোচনা করেছেন লেখক। মহৎ প্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সার্বজনীন হয়ে ওঠা। লেখক আক্ষেপ করে বলেছেন, পরিপূর্ণ আত্মজীবনী কেন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন না। এ বইয়ের অন্যতম চিন্তাউদ্দীপক প্রবন্ধ ‘মহামারী ও রবীন্দ্রনাথ’। মহামারি করোনার থাবায় বিপর্যস্ত হয়েছে জনজীবন। রবীন্দ্রনাথের সময়ে প্লেগ, বসন্ত, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারিতে অগণিত প্রাণহানি ঘটেছে। রাজীব সরকার সাফল্যের সঙ্গে রবীন্দ্রসাহিত্য মন্থন করে মহামারি সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের উল্লেখ করে করোনাকালে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন। বাংলাসাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অসামান্য কীর্তি ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা।
রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পত্রিকাটির ‘রবীন্দ্রসংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। নজরুল সম্পর্কে চারটি প্রবন্ধ রয়েছে আলোচ্য বইটিতে। বর্তমানকালের অন্যতম চিন্তানায়ক যতীন সরকারের নজরুল মূল্যায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ তা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। সদ্যপ্রয়াত বরেণ্য অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখকের মূল্যায়ন বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। অন্য প্রবন্ধগুলোতেও তার গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে। ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ নিঃসন্দেহে এবারের বইমেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই। চিন্তাশীল পাঠকের কাছে বইটি সমাদৃত হবে। ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’, কথা প্রকাশ ২০২১, প্রচ্ছদ-সব্যসাচী হাজরা, ১১২ পৃষ্ঠা, মূল্য ২০০ টাকা।
