|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নজরুল শিশুতোষ কবিতার জন্যও বিখ্যাত। তার শিশুতোষ কবিতাগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়। তার শিশুতোষ ‘শিশু যাদুকর’ কবিতাতেও বাস্তব চরিত্রের উৎস আছে। তিনি বাস্তবকে গ্রহণ করে কল্পনার রঙে অনবদ্য এ কবিতাটি রচনা করেন। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে চট্টগ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কবিতা গানে সীতাকুণ্ড তথা চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত নদী-সমুদ্র অপরূপ প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষের অপরিসীম স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা তার কবিতা-গানে কখনো বর্ণিল আবার কখনো বিরহ বেদনায় অসাধারণ কাব্যরূপ লাভ করেছে। নজরুলের জীবনে চট্টগ্রামের কথা এলেই অবধারিতভাবে হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার মাহমুদের নাম চলে আসে, আসে তাদের পরিবারের কথা। এ পরিবারটি ছিল নজরুলের নিজের পরিবারের মতো। এ পরিবারে স্নেহ মমতায় তিনি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। চট্টগ্রামে এলে তিনি এ বাড়িতেই থাকতেন। চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকরাও তখন এ বাড়িতেই নজরুলকে ঘিরে কবিতা-গানে মেতে উঠতেন। নজরুল নিজেও নতুন নতুন গান কবিতা রচনা করে, তা গেয়ে ও আবৃত্তি করে প্রাণখোলা হাসিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। পুরো চট্টগ্রামই যেন নজরুলের গানে ও কবিতায় নতুন এক প্রাণে জেগে উঠত। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে নজরুল এ বাড়িতে দু’বার গিয়েছেন। তিনি যে কয়দিন থাকতেন, সেই কয়দিন এ বাড়িটি চট্টগ্রামের মধ্যমণি হয়ে উঠত। সভা-সমিতিতে, বক্তৃতায়, গানে যেমন সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতেন, তেমনি সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে, ঝর্ণায়, নদীতে, সমুদ্রে তিনি বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতেন। বাড়িতে ফিরেও তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি আড্ডা কবিতা গান আর পানের আসর বসিয়ে পার করিয়ে দিতেন মধ্যরাত। মধ্যরাতের পরে মগ্ন হয়ে পড়তেন সৃষ্টির নেশায়- খাতা ভরে উঠত কবিতা ও গানে। এ বাড়িতে বসেই তিনি ‘সিন্ধু’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলি’, ‘মিলন মোহনায়’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘নবীনচন্দ্র’, ‘বাংলার আজিজ’সহ অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন। লিখেছেন শিশুতোষ কবিতা ‘শিশু যাদুকর’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’। নজরুল শামসুন নাহার মাহমুদের বাল্য-রচনা ‘পূণ্যময়ী’কে আশীর্বাদ করে লিখেছেন- ‘শত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ,/ তারই বুকে নারী বসে আছে জ্বালি বিপদ-বাতির সিন্ধুদীপ।’ হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহারকে এক কবিতাতেও বন্দি করেছেন ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ কাব্যের উৎসর্গপত্রে। এ গ্রন্থ উৎসর্গের মাধ্যমে তাদের প্রতি তিনি গভীর স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
নজরুল মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার মাহমুদের আম্মা ও নানি আম্মাকে তিনি স্নেহ মমতা ও শ্রদ্ধায় আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি তাদের বাড়িতে প্রথমবার গিয়েই পুরো পরিবারের আপনজন হয়ে ওঠেন। সেই বাড়িতে তখন তিন মাস বয়সের একটি শিশু ছিল। শিশুটির নাম মামুন মাহমুদ। শামসুন নাহার মাহমুদের সন্তান। শামসুন নাহার মাহমুদের আম্মা নজরুলকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘জানালার ধারের ঐ সুপারিগাছগুলো দেখতে সুন্দর, না এই শিশুটি?’ এ কথা যেদিন জিজ্ঞেস করলেন, তার আগের রাতে নজরুল ‘বাতায়ন পাশের গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটি রচনা করেন। নজরুল এ কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। বলেন, ‘আম্মার মনের কথা বুঝতে আর আমার বাকি নাই।’ সেদিন রাতেই তিনি লেখেন ‘শিশু যাদুকর’ বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতাটি- ‘পার হয়ে কত নদী, কত সে সাগর।/ এই পারে এলি তুই, শিশু যাদুকর।’ কবি এই শিশুটির ডাকনাম দিয়েছিলেন ‘শেলী’। তিনি শিশুটিকে আরও একটা নাম দিয়েছিলেন ‘সোহরাব’। কিন্তু ‘সোহরাব-রুস্তম’ বিয়োগান্তক কাহিনি হওয়ায় পরিবারে এ নামটি সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আস্তে আস্তে এ নামটি হারিয়ে যায়। নজরুলের ‘শিশু যাদুকর’ মামুন মাহমুদ ১৯২৬ সালের ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডা. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন তৎকালীন কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল কাম সুপারিনটেন্ডেন্ট। তিনি যখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতেন, সে সময় নজরুলের সঙ্গে তার আকস্মিক সাক্ষাৎ ঘটেছিল। মেডিকেল কলেজের সামনে ৩২নং স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিস ছিল। সেই অফিসে পড়ালেখা করার জন্য সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি ছিল। সেখানে গিয়ে প্রায়ই ওয়াহিদউদ্দির মাহমুদ পড়াশোনা করতেন। অনেক খ্যাতিমান কবি- সাহিত্যিকও সেখানে আসতেন- বিভিন্ন বই পড়তেন- আড্ডা দিতেন। একদিন হঠাৎ নজরুল ইসলামও সেখানে এসে হাজির হন এবং তার বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ পড়ে শোনান। তখনো এ কবিতাটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এর কয়েকদিন পর কবিতাটি প্রকাশিত হয় এবং তখন গোটা ভারতবর্ষে নতুন এক জাগরণ তৈরি করে। বাংলা সাহিত্যেও বিখ্যাত কবিতা হিসাবে ‘বিদ্রোহী’ স্বীকৃত ও নন্দিত হয়ে ওঠে।
নজরুলের ‘শিশু যাদুকর’ মামুন মাহমুদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও ব্যক্তিগত পত্র যোগাযোগ রাখতেন। তাকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি ১৯৪১ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ ছিল। শিশু বয়সে নজরুলের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে তারই চেতনা যেন ধারণ করেছিলেন তিনি।
নজরুল পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য বিপ্লবী কবিতা লিখে জেল-জুলুমের শিকার হন। আর তার ‘শিশু যাদুকর’ মামুন মাহমুদ রাজশাহীতে পুলিশের ডিআইজির দায়িত্ব পালন অবস্থায় নিজের দেশ-মাতৃকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।
নজরুলের ‘শিশু যাদুকর’-র সেই শিশু একদিন বড় হয়ে দেশ-মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করে এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, অমরত্ব লাভ করে আছেন বাঙালির মহান কবি নজরুল ইসলামের কবিতাতেও। নজরুল নিজেও ‘শিশু যাদুকর’ কবিতার শিশুটির মধ্যে বেঁচে থাকার বাসনা লালন করেছিলেন- ‘তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক,/ তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরুক।’ কবির সে বাসনা যে পূর্ণ হয়েছে, সে কথা তো বলা যেতেই পারে, কারণ তার ‘শিশু যাদুকর’ সাধারণ কোনো জাদুকর ছিলেন না, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে- দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দেওয়া মহান এক জাদুকর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। যার রক্তে লেখা আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
