Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

মৃতের সাথে সংলাপ

Icon

বিধান মিত্র

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খ্যাতিমান ব্যারিস্টার অম্লান দত্তের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তো অবাক; তার চোখে কান্না বা শোকের চিহ্নমাত্রও নেই। বরং আমার মনে হলো, তার চোখজুড়ে আছে স্বস্তির ছায়া। আনন্দের ঝিলিক। পিতৃ মৃত্যুর পর, পুত্রের এ-রকম নির্বিকার-চোখ এর আগে কখনো দেখিনি।

দু’সপ্তাহ আগের ঘটনা মনে পড়ল। জেলেপাড়ার অশীতিপর বৃদ্ধ অমল দাসের লাশ নিয়ে আমরা তখন শ্মশানে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে কে একজন মন্তব্য করেছিল, ‘বেচারা মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে; গোটা পরিবার-বিশেষত ছেলে অসিতকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে। কটা বছর কী যে কষ্ট করেছে ছেলেটা।’ শ্মশান যাত্রী অন্য একজন বলেছিল, ‘আসলে কী, বিছানায়-পড়া রোগী, এরা যতো দ্রুত মরে, ততোই মঙ্গল’; শয্যাশায়ী পিতার প্রত্যাশিত মৃত্যুর মধ্যে আমরা যখন পুত্রের ‘মঙ্গল-দ্যুতি’ দেখছিলাম, অসিতের মনে তখন ভিন্ন সুরের আলোড়ন। সে উচ্চস্বরে কাঁদছিল এবং বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। আমি ওই শোকার্ত কান্নার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম; শ্রদ্ধা-প্রেম-ভালোবাসা-ভক্তি-বিনে-সুতোর বন্ধন-ব্যতীত অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাইনি।

সেদিনের মতো আজও, একজন পিতার লাশ নিয়ে শ্মশানের কোনায় দাঁড়িয়ে আছি; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই বিনে-সুতোর বন্ধনের কথাই ভাবছি। কিন্তু ওই বন্ধন-দৃঢ়তা বা পিতৃভক্তি-এর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগল, অনিল দত্ত-পুত্রকে কেবল শিক্ষিত বানাতে পেরেছেন, ‘মানুষ’ বানাতে পারেননি? জেলে পাড়ার অক্ষর জ্ঞানহীন দরিদ্র অমল আর অসিত, এদের পাশে বিদ্বান ও বিত্তবান অনিল-অম্লানকে অনেক বেশি ম্লান মনে হলো; মনে হলো, এদের মধ্যে আর যা-ই থাকুক-প্রাণ ও প্রেমের ঝর্ণাধারা নেই।

শ্মশানের অনিবার্য-আলিঙ্গন-চিন্তায় আমার ভেতরে ‘বাউল’-ভাব জেগে উঠছিল। এই অনিল দত্ত-শ্বাস-নিশ্বাসের বিচারে-প্রয়াত হয়েছেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। এই দৃশ্যমান আপাত-সত্যের বাইরে অন্য একটা সত্য আছে; এ বিরল সত্যের সন্ধান পেয়েছিলাম মনোবিজ্ঞানী ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ‘বেঁচে’ছিলেন”; অর্থাৎ ‘বেঁচে থাকা’ আর ‘জীবন-কাটানো’-এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, খুব ছোট্ট কথায় তিনি সে গূঢ় তত্ত্বটি নির্দেশ করেছিলেন। শ্মশানে-দাঁড়ানো এ নগণ্য আমি-আমার মস্তিষ্কের করোটিতে ধীরেন্দ্রতত্ত্ব হঠাৎ জানিয়ে দিয়ে গেল, অমল বাবু সচল দেহে লম্বা জীবন কাটিয়েছেন মাত্র-জীবিত ছিলেন না একদিনও। সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের ধ্বজা ধরে প্রতিমুহূর্ত ‘সৃষ্টিশীল’-থাকা-এ যদি হয় ‘বেঁচে’ থাকার শর্ত-তা হলে এই আমি বা আমরা, আমাদের মধ্যে কতো জন ‘বেঁচে’ আছি-সে এক জটিল প্রশ্ন বটে।

দুই . অনিল দত্তলৌকিক-ঈশ্বরভক্তি আর দুর্বৃত্তপনা দিয়ে খিচুড়ি পাকিয়ে, সাত-পাঁচ চৌদ্দ বানিয়ে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। কারবারি-বুদ্ধিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী-যেখানেই হাত দিয়েছেন, মুনাফা এসেছে উচ্চহারে। এ অনুদার, আত্মকেন্দ্রিক লোকটি অবশ্য কিছু কিছু বিষয়ে মুক্ত হস্ত ছিলেন। মন্দির-নির্মাণ এবং পুত্রের বিদ্যাশিক্ষা-এ-দুই খাতে তিনি অঢেল অর্থ-ব্যয় করেছেন; তিনি কারবারি মানুষ, তাই ওই দুটি খাতকে ‘পরকালিক’ এবং ‘বার্ধক্যকালিক বিনিয়োগ’ হিসেবে গণ্য করেছিলেন কি না, কে জানে।

তার প্রথম বিনিয়োগের ফলাফল কী-সে খবর জানবার উপায় নেই; তবে দ্বিতীয় বিনিয়োগ যে নিষ্ফলা হয়েছে, সেটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। চিতার ওপর পিতার লাশ রেখে কী নির্বিকার ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে অম্লান দত্ত; যেন কিছুই হয়নি বা যা হয়েছে-সেটা ছিল আকাঙ্ক্ষিত। আমি অম্লান দত্তের নষ্ট মুখাবয়ব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চিতার দিকে তাকালাম। তখন হঠাৎ করে, আমার শরীর যেন বড় একটা ঝাঁকুনি খেল; অনুভব করলাম, আমার ভেতরে অপরিমেয়-আলোক শিখা জ্বলে উঠছে। আমি অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি; এমন কি মৃত অনিল দত্তের সঙ্গে কথা বলার অবিশ্বাস্য শক্তিও অর্জন করে ফেলেছি। আমার চারপাশে প্রচণ্ড ঘোর-লাগা, মায়া-আচ্ছন্নতা, স্বপ্ন-কল্পনার জাদুজাল। আমি উড়ছি, বিশেষ শক্তিবলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অবাধে চলাফেরা করতে পারছি।

মুখাগ্নির অপেক্ষায় থাকা লাশের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাল রাতে, যখন তার দেহে প্রাণ ছিল, তিনি বাড়ির বিছানায় শুয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা আগে তার প্রাণবিয়োগ ঘটেছে, প্রাণ-বিহনে এখন তিনি ‘লাশ’-এখন বাড়িতে তার স্থান নেই, তার স্থান চিতার ওপরে, একটু পরেই তার দেহ অগ্নিস্পর্শে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। তার সোনার দেহ ‘ছাই’ হয়ে মিশে যাবে মাটিতে; আমি øিগ্ধ-নিবিড় চোখ মেলে উপলব্ধি করলাম, ঘুমন্ত অনিল দত্ত আর চিতায়-শোয়া অনিল দত্ত-এ দুয়ের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল একটাই-‘প্রাণের উপস্থিতি’ বা ‘প্রাণের অনুপস্থিতি’; ‘প্রাণ’-কী সেই প্রপঞ্চ-যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না? এই ‘প্রাণ’ থাকলেই ‘বেঁচে আছি’, না-থাকলেই-‘মরে গেছি’। দেহের ভেতরেই প্রাণের অধিষ্ঠান, দেহকে ভিত্তি ধরেই বসবাস তার, তবু দেহ অপেক্ষা ‘প্রাণের’, আধার অপেক্ষা আধেয়র শক্তি এত বেশি কেন?

তিন. অনিল দত্তের কানে কানে বললাম, শ্মশান-আগত আপনার স্ত্রী এবং কন্যা অবিরাম কেঁদে চলেছে। আপনার বিয়োগ-ব্যথায় ওরা শোকে মূহ্যমান। কিন্তু আপনার পুত্র-যাকে সুশিক্ষিত করবার জন্য ইউরোপ-আমেরিকাতে পড়িয়েছেন, আপনার মৃত্যুতে তার কোনো বিকার নেই। তার এ নির্লিপ্তভাব-এর পেছনে কোনো রহস্যময় কারণ আছে কি?

ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিলেন দত্তবাবু, আপনি কেবল ওদের অভিব্যক্তিগুলোই দেখতে পাচ্ছেন; কিন্তু আমি ওদের মনের ভাষাও পড়তে পারছি। কয়েক বছর আগে আমার পুত্রটি বলেছিল, আমি যেন সম্পদের মানচিত্র ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলি। তার নামে দেশে এবং দেশের বাইরে কিছু যেন করে রাখি; আমি তার প্রস্তাবে সাড়া দেইনি। এতে খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিল সে; আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিল দীর্ঘদিন। এরপর কী জানি কি ভেবে, দেশে এসে চুপচাপ সময় কাটাচ্ছিল। আমার এই হঠাৎ মৃত্যু, তাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে; তবে বিপাকেও কম ফেলেনি; আমার বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তির দাগ-খতিয়ান সম্পর্কে কিছুই জানে না সে; তাই সম্পদপ্রাপ্তিতে খুশি হলেও, সম্পদ-রক্ষা নিয়ে সে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।

একটুখানি থেমে তিনি আবার কথায় ফিরলেন, ‘আর ওই যে আমার স্ত্রী, যিনি অবিশ্রান্তভাবে কেঁদে চলেছেন, ক’দিন আগে আমায় বলেছিলেন, তার পুত্রের মধ্যে তিনি নাকি ‘নির্ভরতার’ ছায়া দেখতে পান না। তাই অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন সম্পদের কিছু অংশ তার নামে লিখে দিই-যাতে ভবিষ্যতে পুত্রের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। আমি তার আবদার পূরণ করে যেতে পারিনি; ধারণা করছি, তার কান্নার পেছনে ‘স্বামী’র মৃত্যুশোক অপেক্ষা নিজের ‘ভবিষ্যৎ-বিষয়ে অনিশ্চয়তা’, কাজ করছে বেশি।

মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ও আমাকে ভালোবাসত খুব। আমিও খুব আদর করতাম তাকে। আমি নিশ্চিত, ওর কান্নার মধ্যে পিতৃ-বিয়োগের শোক আছে। যন্ত্রণা আছে। বেচারা মেয়ে আমার, মৃত্যুর আগে তাকে পাত্রস্থ করে যেতে পারলাম না।

আমি স্বর নিচু করে বললাম, এর মানে হচ্ছে-আপনার স্ত্রী এবং পুত্র, আপনার মৃত্যু-নিয়ে ওরা মোটেও শোকার্ত নয়। শ্মশানে এসেও, তারা কেবল নিজেদের নিয়েই ভাবছে।

অনিল বাবু আমার কথার উত্তর দিলেন না। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলেন শূন্য আকাশের দিকে। আমি ফিসফিস করে বললাম, আপনার তো অনেক টাকা; লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকা। অথচ কী নিদারুণ ব্যাপার, আপনাকে শূন্য হাতে নতুন জগতে যেতে হচ্ছে।

এবার তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, আমার সঙ্গে অর্থও নেই, পরমার্থও নেই। আমি ভিখেরি, আমি নিঃস্ব।

আমি আলাপের মোড় ঘুরিয়ে বললাম, কিছুদিন আগে এ-শ্মশানেই রঘু চণ্ডাল, বিপিন চৌহান, হিরেন বাশফোরকে দাহ করা হয়েছে। তাদের অস্থি-মজ্জা-রক্ত-মাংস মিশে আছে এ-মাটিতে; কিছুক্ষণ পর এ-মাটিতে আপনিও মিশে যাবেন। ছোট জাত, অস্পৃশ্য হিসাবে যাদেরকে জীবনভর ঘৃণা করেছেন, এখন ওদের সঙ্গে একাকার হলে নিজেকে অপবিত্র মনে হবে না?

-তা হবে কেন? মৃত্যুর পর তো মানুষে-মানুষে বিভেদ থাকে না। সেখানে চণ্ডীচরণ মুখুজ্যে আর হরিরাম চণ্ডাল-সবাই এক হয়ে যায়।

-মরার পর জাতপাত থাকে না, জাতের বিচার কেবল কি জীবিতকালেই সীমাবদ্ধ?

উত্তর না দিয়ে অনিলবাবু উল্টো আমার দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন, আপনি নিজে কি আপনার চারপাশের মানুষকে ‘এক’ ও ‘অভেদাত্মা’ হিসাবে গণ্য করতে পারেন?’

এমন অপ্রিয়-আক্রমণাত্মক প্রশ্ন-কল্পনাও করিনি আমি; আমরা অন্যকে প্রভাবিত করবার জন্য উপদেশ দিয়ে বেড়াই, অনেক নীতিকথা তত্ত্বকথা বলি। বিপরীত দিক থেকে কোনো রকম ‘ঝাপ্টা’ আসতে পারে, এ-কথা তেমন ভাবি না। বস্তুত অনিল দত্তের কথায় শোচনীয় ধাক্কা খেয়ে চুপ করে গেলাম; আমার অধীত-বিদ্যালোক ঘেঁটে এমন কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যা দিয়ে তাকে ‘কাবু’ করতে পারি।

 

চার . আমি নিজের বোধকে প্রশ্ন করলাম, ‘চিতায়-তোলা’ লাশের সঙ্গে এত কথা কেন বললাম? আমি, আমি কি স্বাভাবিক আছি?

লাশ থেকে দূরে সরবার জন্য এক পা, দু’পা করে পেছাতে লাগলাম। হঠাৎ করে, বরফ-শীতল কিছুর স্পর্শ পেলাম যেন। বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম, অনিল দত্ত আমার হাত টেনে ধরেছেন এবং মৃদু হেসে বলছেন, ‘চলে যাচ্ছেন যে? আরও খানিকটা সময় বসুন, কিংবা শুয়ে পড়ুন আমার পাশে।’

আমি যন্ত্রের মতো বললাম, ‘ওরা তো এক্ষুণি আগুন দেবে মৃতদেহে।’

-আগুন দিক না, দিক; আপনি আমার সাথেই থাকুন;

-কিন্তু আমি-আমি তো ‘মৃত’ নই, আমি ‘জীবিত’?

-ও আচ্ছা, আপনি জীবিত? আমি তো ভেবেছিলাম, আপনিও মৃত।

আমি নিজের হাতে চিমটি কেটে অনিল বাবুর কথার সত্যাসত্য যাচাই করে নিলাম। এরই মধ্যে, আকাশে-বাতাসে দীপ্তি ছড়িয়ে অনিলের চিতা জ্বলে উঠল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম