প্রান্তছোঁয়া আকাশ
চাঁদপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি
চাঁদপুর জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষ আয়োজন
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সমৃদ্ধভূমি চাঁদপুর। হাজার বছরে অসংখ্য মানুষের কর্মে-শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে এ সুবর্ণ-অঞ্চল। ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে ছয় শতক থেকে সমতটকে স্বতন্ত্র জনপদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। প্রাচীনকালে চাঁদপুর ছিল সমতটের অধীনে। গুপ্ত, পাল ও সেন রাজারা এ অঞ্চল শাসন করেছেন। সম্রাট আকবরের আমলে ‘চান্দপুর’ নামক পরগনার উল্লেখ রয়েছে। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনো মধ্যযুগের পুরাকীর্তি ও স্থাপনা বিদ্যমান। নদীবন্দর হিসাবে সুখ্যাত চাঁদপুরকে এককালে ‘গেট ওয়ে অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ বলা হতো।
বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ মাটির সন্তানদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মধ্যযুগে মহাকবি আলাওলের আগে ‘কচুয়া’র সন্তান দোনাগাজী লিখেছেন ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’ কাব্য। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, বরেণ্য সংগীতজ্ঞ শান্তিদেব ঘোষ, দেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী, ‘দৃষ্টিপাত’-এর লেখক যাযাবর, ‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগম, জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুনতাসীর মামুন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, ফরিদা জামান, ঢালী আল মামুনসহ বহু মানুষের কর্ম ও কীর্তিতে রত্নগর্ভা হয়েছে চাঁদপুর। চাঁদপুরের পালবাজারের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাভাষার বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষ। এ জেলায় বিভিন্ন সময়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জসীমউদ্দীনের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরা।
দুই.
চাঁদপুর নদীবিধৌত বলে এ জেলার শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক রয়েছে। এখানকার লেখকদের লেখায় অনুষঙ্গ হিসাবে নদী, জল, ইলিশ, শস্য, অন্ত্যজ জীবন বিশেষ স্থান দখল করে আছে। চাঁদপুরের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ পুঁথিপাঠ। যুগ যুগ ধরে গ্রামে-গ্রঞ্জে পুঁথিপাঠের আসর বসত। পুঁথিপাঠের শ্রোতা ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এখনো জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে পুঁথিপাঠের আসর বসে। আঠারো শতকে চাঁদপুরে কবিগানের প্রচলনের কথা পাওয়া যায়। চাঁদপুরের কবিয়ালদের মধ্যে হরকুমার শীল, প্যারী মোহন আচার্য, জগবন্ধু দত্ত, কালী কুমার, চন্দ্রকুমার, কালশশী চক্রবর্তী ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
অসংখ্য লোককথা ও কাহিনি চাঁদপুরের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বেহুলা-লখিন্দর ও চাঁদ সওদাগরের কাহিনি। মধ্যযুগের এসব মিথ এখনো সগৌরবে টিকে আছে। এ জেলার নিজস্ব কিছু লোকসংগীত রয়েছে। লোকগবেষক প্রকৌঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেনের মতে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনোপখ্যানই এসব লোকসংগীতের উৎস। লোকসংগীতের অনুষঙ্গের মধ্যে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রাধান্য রয়েছে। যেমন : ক) ‘আমার কাংখের কলসি গিয়াছে ভাসি/মাঝিরে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়ারে।’ খ) ‘আমি বইসা রইলাম নদীর কূলে/আমায় কেবা পার করে।’ চাঁদপুরে বন্দনাগীত, জারিগান, আধ্যাতিক গান, মাজারের গান, মারফতি, বেহুলার গীত, হঁঅলা, গজল, বিয়ের গীতের প্রচলন রয়েছে।
চাঁদপুরের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কারের প্রচলন রয়েছে। যেমন : ক) ‘এ জেলার কোনো কোনো স্থানের মানুষ মনে করে, ভূত-প্রেত রয়েছে। তাদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের সোনা-রুপার পানিতে দিয়ে গোসল করানো হয়।’ খ) ‘চরের ধান কোনো ঋতুতে প্রথমবার কেটে কারও সঙ্গে কথা না বলে একগুচ্ছ সরাসরি বাড়িতে নিয়ে আসতে হয়।’ অন্যদিকে কোনো কোনো স্থানের মানুষ তন্ত্রমন্ত্রেও বিশ্বাস রাখে। যেমন : ‘ইল বিল, কুত্তার দাঁত খিল’। এই মন্ত্র পড়লে কুকুর কামড়াবে না।
চাঁদপুরে বিবাহের গানের প্রচলন শতবছরের প্রাচীন। কোনো কোনো গ্রামে এখনো বিয়ের গান হয়। শতবর্ষ আগে চাঁদপুর সদরের সাবেক নরসিংহপুর হাটে প্রতি বৈশাখে মেলা বসত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খেলনার পাশাপাশি মেলায় গানবাজনা হতো।
পূর্ববাংলার প্রথম যাত্রাদল ‘প্রাচ্যাভিনয় সম্প্রদায়’। ১৮৮০ সালে উমানাথ ঘোষাল চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে এ যাত্রাদলটির প্রতিষ্ঠা করেন। তাই এটি ‘ঘোষাল অপেরা’ নামে বহুল পরিচিত। চাঁদপুরে প্রথম মঞ্চ নাটক প্রদর্শিত হয় ১৯১০ সালে। প্রথম প্রদর্শিত নাটকটি ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘শাহজাহান’। ১৯২০-২১ সালে পুরানবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলার প্রথম স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ‘বীণাপাণি নাট্যমন্দির’। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুর টাউন হল। এর নির্মাণ ছিল শিল্পাঙ্গনের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ক্রমেই টাউন হল চাঁদপুরের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্রে রূপ নেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুরের প্রথম সংগীত-সংগঠন ‘চন্দ্রলোক সংগীত সম্প্রদায়’।
এ জেলার চিত্রকলার ইতিহাসও বহুদিনের। বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী (১৯১৩-১৯৯৯) চাঁদপুরের পুরানবাজারের মেয়ে। ১৯২৮ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, চাঁদপুরের নারীদের শিল্পচর্চার ইতিহাসও দীর্ঘ। অন্যদিকে আলপনাশিল্পী সুকুমারী দেবীর জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৎকালীন চাঁদপুরে আলপনা আঁকার প্রচলন ও কদর ছিল।
তিন.
জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে বহুকাল থেকে চাঁদপুরের শিল্পী-সাহিত্যিকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। চাঁদপুরে স্বদেশী আন্দোলনে কালীমোহন ঘোষ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবসহ অনেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ চাঁদপুরে প্রতিবাদ দিবস, মতলবে পূর্ণ হরতাল পালন, রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ ছাড়া ৬ মার্চ চাঁদপুরের শিক্ষক সমাজ ভাষা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেয়। স্থানীয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে চারণকবি সামছুল হক মোল্লার অর্থবহ ভূমিকা রয়েছে। শিল্পী হাশেম খান বাংলাভাষার দাবিতে হওয়া মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে ভাষা-আন্দোলনে চাঁদপুরের সন্তান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নূরজাহান বেগম প্রমুখ ভূমিকা রেখেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ভাষণের পর চাঁদপুরের নতুনবাজার থেকে বিশাল মিছিল বের হয়। এ মিছিলে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশ নেন। পরে চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরাও এতে যুক্ত হন।
চার.
২০১০ সাল থেকে চাঁদপুরের নবপর্যায়ে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় ছোটকাগজ ‘মৃত্তিকা’। এ ছাড়া সমৃদ্ধভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘চাষারু’, ‘ত্রিনদী’, ‘বক্ষবুলি’, ‘তরী’, ‘সময়ের ডাক’, ‘বাঁক’, ‘অনপেক্ষ’, ‘উছল’, ‘আঙন’, ‘বর্ণিল’, ‘জলপুষ্প’, ‘চন্দ্রদ্বীপ’, ‘শেকড়’ ইত্যাদি। গত ৭ বছরে চাঁদপুর থেকে বিভিন্ন ছোটকাগজের প্রায় ৫০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। গত ৫ বছরে স্থানীয় লেখকদের সৃজনশীল ও মননশীল অর্ধশত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয়ভাবেও চাঁদপুরের লেখকরা পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। এ সময়ে চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য সক্রিয় লেখক ও সাহিত্য সংগঠকরা হলেন : কাজী শাহাদাত, মঈনুদ্দিন লিটন ভূঁইয়া, তছলিম হোসেন হাওলাদার, পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, ইকবাল পারভেজ, জাহাঙ্গীর হোসেন, জসিম মেহেদী, ম. নূরে আলম পাটওয়ারী, রফিকুজ্জামান রণি, মাইনুল ইসলাম মানিক, কাদের পলাশ, শাহমুব জুয়েল, আশিক বিন রহিম, নূরুল ইসলাম ফরহাদ, কবির হোসেন মিজি, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান প্রমুখ।
চাঁদপুরের সন্তান, যারা চাঁদপুরের বাইরে অবস্থান করছেন-এমন সক্রিয় লেখকরা হলেন : সাইফুল আলম, ফারুক হোসেন, কবির বকুল, সরকার আবদুল মান্নান, মিলন খান, কামরুল হাসান শায়ক, হুমায়ূন কবির ঢালী, নাসিমা আনিস, মেসবাহউদ্দীন সরকার, তারিক টুকু, মনসুর আজিজ, মেহেদী উল্লাহ, নাহিদা নাহিদ, আহমেদ রিয়াজ, গাজী মুনছুর আজিজ, সৌম্য সালেক, গোলাম নবী পান্না, ফিরোজ আহমেদ বাবু, হাসান আলী, জামশেদ ওয়াজেদ, জব্বার আল নাঈম, ইলিয়াস ফারুকী, প্রণব মজুমদার, মিজান মালিক, কিশোর মাহমুদ, মোস্তফা হামেদী, শাহ বুলবুল, জাবেদ ইমন, রূপক রায়, ফারুক সুমন, সাম্মি ইসলাম নীলা, মাহফুজুর রহমান মানিক, সাদী শাশ্বত, মামুন অপু, সুজন আরিফ প্রমুখ।
এ ছাড়া স্থানীয়-জাতীয় ও প্রবাসে সাহিত্যচর্চা ও সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় আছেন : (বর্ণানুসারে) অমল সাহা, আইরিন সুলতানা লিমা, আবদুল হক মোল্লা, আদিত্য শঙ্কর, আনসারী মাহমুদ, আবু ইউসুফ, আবু ইউসুফ শিমুল, আবু তাহের মিয়াজী, আব্দুল্লাহিল কাফি, আরিফ বিল্লাহ, আসাদুল্লাহ কাহাফ, ইমরান নাহিদ, ইয়াছিন দেওয়ান, ইয়াহু তাফু, এ এম সাদ্দাম হোসেন, এইচ এম জাকির, এস এম জয়নাল আবেদীন, এস এম মিরাজ মুন্সী, কাউসার আলম রবি, কাজী সাইফ, খাদিজা মুন্নি, খান-ই-আজম, জয়নুল আবেদীন আজাদ, জমির হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়, জাহিদ নয়ন, জাবেদ আয়েন্দা, জীবন কানাই চক্রবর্তী, তৃপ্তি সাহা, দন্ত্যন ইসলাম, দুখাই মুহাম্মদ, নিঝুম খান, নুরুন্নাহার মুন্নী, পাটোয়ারী জ্যিশান, পাভেল আল ইমরান, পান্থ ফরিদ, ফতেউল বারী রাজা, ফয়সাল মৃধা, ফাতেমা আক্তার শিল্পী, বিজয় আহমেদ, মকবুল হামিদ, মনিরুজ্জামান প্রমউখ, মনিরুজ্জামান বাবলু, মানসুর মুজাম্মিল, মানিক দাস, মারিয়া ফারজানা, মাসুম কামাল, মিজান খান, মিজানুর রহমান রানা, মিরন নাজমুল, মিশকাত উজ্জ্বল, মুক্তা পীযূষ, মুখলেসুর রহমান মুকুল, মেহেরুন্নেছা, মোখলেসুর রহমান ভূঁইয়া, রনি জাবালি, রাসেল ইব্রাহিম, রুদ্র আরিফ, রেজাউল আহসান, রেজা শাহীন, শরীফ উল্লাহ, শাখাওয়াত শান্ত, শান্ত জাবালি, শামীম হাসনাইন, শাহাদাত মিয়াজি, শাহাদাত হোসেন শান্ত, শিমুল জাবালি, শ্রাবণ আহমেদ, শ্রাবণ রহমান, সঞ্জয় দেওয়ান, সজিব খান, সালাহ উদ্দীন, সুমন কুমার দত্ত, সাকিবুল ইসলাম, সাব্বির নোমান, সাদিয়া আফরোজ, সামীম আহমেদ খান, সীমান্ত মুরাদ, সোহানুর রহমান অনন্ত, হাসান মাহদী, হাসানুজ্জামান, হাসান মোস্তাফিজুর রহমান, হাশেম প্রধানিয়া, হুসাইন মিলন, হোসনে মোবারক প্রমুখ। সাংবাদিকতায় বাংলাদেশে চাঁদপুর জেলার মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম।
চাঁদপুরের নব পর্যায়ের সাহিত্য আন্দোলনে সাহিত্য একাডেমি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিমাসে নিয়মিত সাহিত্য আসরের আয়োজন করেছে। এ ছাড়া ছোটকাগজ ‘উছল’-এর দুটি সংখ্যা প্রকাশ, সাহিত্য সম্মেলন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে নিয়ে সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বর্তমানে চাঁদপুরের সক্রিয় সাহিত্য সংগঠনগুলো হলো : চাঁদপুর লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, শিল্পচূড়া, সাহিত্য মঞ্চ, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর সাহিত্য পরিষদ ইত্যাদি। চাঁদপুর শহরে অন্তত তিনটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি রয়েছে-পৌর পাঠাগার, গণগ্রন্থাগার ও চাঁদপুর সরকারি কলেজ গ্রন্থগার। এ তিনটি পাঠাগারে ৫০ হাজারের বেশি বই রয়েছে।
দিন যতই যাচ্ছে, ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে চাঁদপুরের শিল্প-সংস্কৃতি। আগামী দিনে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ জেলার শিল্পী-সাহিত্যিকরা জাতীয় পর্যায়ে আরও অর্থবহ ভূমিকা রাখবে-এ প্রত্যাশা করি।
চাঁদপুরে প্রচলিত কয়েকটি
প্রবাদ-প্রবচন
১. জাগিয়া না করে রাও/হগল কতার বুঝে ভাও।
২. ছেলে নষ্ট হাটে, ঝি নষ্ট চাটে/ বৌ নষ্ট পড়শিবাড়ির ঘাটে।
৩. গরুরে দিও না ভালা ঘাস/ বউরে দিও না পরবাস।
৪. যার লাগি নাই/মেজবানির বাইতও নাই।
৫. সুন্দরী পায় না বর/ ঘরণী পায় না ঘর।
৬. মেয়ে বিয়ে দেও ভাতে/ছেলে বিয়ে করাও জাতে।
৭. হস মাডিতে বিলাই খামসায়/টাইড মাডিতে শাবলও ডরায়।
৮. একে তো নাচুইন্না বুড়ি/আরও দিসে ঢোলে বাড়ি।
৯. পিঠা বলো, বিড়া বলো, ভাতের সমান নয়/ চাচি বলো জেঠি বলো মায়ের সমান নয়।
১০. বাপে পুতে ডাইকা ভাই/কোনো রকম দিন কাটাই।
সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলা চাঁদপুরে অবস্থানরত উল্লেখযোগ্য কয়েকজন
কাজী শাহাদাত
জন্ম ১৯৬২ সালে, পৈতৃক নিবাস হাজীগঞ্জ। আশির দশক থেকে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় সক্রিয় আছেন। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য মাসিক ‘নির্ভীক’ ও ‘নির্ঝর’। ২২ বছর ধরে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সাহিত্য একাডেমি চাঁদপুরের সঙ্গে যুক্ত এবং বর্তমানে মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালে তার নেতৃত্বে চাঁদপুরের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জাতীয় সাহিত্য পরিষদ পদক-২০১৫, চাঁদপুর শিল্পকলা একাডেমির সৃজনশীল সংগঠক সম্মাননা-২০১৮, চাঁদপুর প্রেস ক্লাবের আজীবন সম্মাননা-২০২০ সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
রূপালী চম্পক
সংগীতশিল্পী। জন্ম ১৯৬১ সালে, চাঁদপুরে। ১৯৬৭ সাল থেকে সংগীতাঙ্গনে সক্রিয় আছেন। তিনি সংগীত প্রশিক্ষকও। সপ্তসুর সংগীত একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু, কবি নজরুল ইসলামের মতো বরেণ্যদের সামনে সংগীত পরিবেশন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে জয়বাংলার শিল্পী হিসাবে তার গান ভারতে প্রশংসিত হয়েছে। রূপালী চম্পকের উল্লেখযোগ্য গান : টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল ছায়ায়, পঁচাত্তরের আগস্টে, কেমনে ভুলিব বল খুনে রাঙা দিন ইত্যাদি। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমি, ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল ইনস্টিটিউট, শচীন দেববর্মণ সম্মাননাসহ নানা পুরস্কার।
ইকবাল পারভেজ
কবি। জন্ম ১৯৬৫ সালে, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। কিশোরকাল থেকে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুটি। ২০১৮ সালে সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নদীপাঠ’। এ পাণ্ডুলিপিটির জন্য তিনি চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮ লাভ করেন। ২০২০ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমার যতো উচ্চারণ’ প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন। ইকবাল পারভেজ স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখেন। তার কবিতার অনুষঙ্গ দেশজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবহমান গ্রামবাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক অভিঘাত ইত্যাদি। সাংগঠিকভাবে ইকবাল পারভেজ চাঁদপুর সাহিত্য পরিষদ, পদক্ষেপ বাংলাদেশ, চাঁদপুর জেলা শাখার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
জসীম মেহেদী
কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ-অভিনেতা। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি নাট্যচর্চায় যুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে পত্রপত্রিকা ও ছোটকাগজে কবিতা লিখছেন। তার লেখা নাটকগুলো হলো : ভাঙন, তেশরা এপ্রিল ১৯৭১, একাত্তরের তারামন, তিনটি আপেল, দ্য ম্যাড, একটি ফুলের জন্য, সংকেত, সাগর ভাসার পালা ইত্যাদি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর; চতুরঙ্গ সাংস্কৃতিক সংগঠন, অনন্যা নাট্যগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে নাট্যকার হিসাবে জসীম মেহেদী পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। তার লেখা নাটক সরকারি অনুদান পেয়েছে।
রফিকুজ্জামান রণি
কবি ও গল্পকার। জন্ম ১৯৯২ সালে, কচুয়ার গোলবাহার দোঘর গ্রামে। একদশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪টি। কাব্যগ্রন্থ দুটি-‘ধোয়াশা তামাটে রঙ’ ও ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’। তার দুটি গল্পগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দুই শহরের জানালা’, অন্যটি ‘চৈতিরাতের কাশফুল’। রফিকুজ্জামান রণি লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার-২০১৯’, ‘দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮’, ‘এবং মানুষ তরুণ লেখক পুরস্কার-২০১৯’সহ বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেন। তার লেখায় পরাবাস্তবতা, মিথ, ঐতিহ্য, ব্যক্তিজীবনের ঘাত-প্রতিঘাত উপস্থাপিত হয়। সাংগঠনিকভাবে তিনি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে কাজ করছেন।
মাইনুল ইসলাম মানিক
কবি ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৪ সালে, শাহরাস্তিতে। তিনি এক দশকের বেশি সময় সাহিত্য চর্চায় সম্পৃক্ত রয়েছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ৩টি। কাব্যগ্রন্থ-‘স্বপ্নের শঙ্খচিল’ (২০১৪)। অনুবাদগ্রন্থ-‘দশ নোবেলজয়ী লেখকের সাক্ষাৎকার’ (পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, ২০১৮) ও ‘মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন গল্প’ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯)। তিনি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ৪০টি শিশুতোষ গ্রন্থের অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা’, ‘ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পদক’সহ নানা পুরস্কার। তিনি ২০১৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। সাংগঠনিকভাবে তিনি সাহিত্য মঞ্চ, চাঁদপুরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে কাজ করছেন।
কাদের পলাশ
কবিতা ও ছোটগল্প লিখেন। জন্ম ১৯৮৬ সালে, কচুয়ায়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সাহিত্যচর্চায় সম্পৃক্ত আছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ-‘দীর্ঘশ্বাসের শব্দ’ ও ‘ইচ্ছেরা উড়ে গেছে’। কাব্যগ্রন্থ-‘স্মৃতির স্লোগান’ (২০২১)। যৌথ সম্পাদিত গ্রন্থ তিনটি-যাপনে-উদ্যাপনে ইলিশ, বিরুদ্ধ স্রোতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (২০২০) ও ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর (২০২০)। তার লেখায় অন্ত্যজ শ্রেণির সুখ-দুঃখ বর্ণিত হয়। কাদের পলাশ সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘ত্রিনদী’। সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকা ‘শপথ’।
আশিক বিন রহিম
গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখেন। জন্ম ১৯৮৭ সালে, পুরানবাজারে। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪টি। কাব্যগ্রন্থ দুটি-অতৃপ্ত মন (২০০৯) ও পদ্মপ্রয়াণ (২০১৯)। গল্পগ্রন্থ- জাল ও জলের আখ্যান (২০২০)। গবেষণাগ্রন্থ-চাঁদপুরের চাঁদমুখ (২০২০)। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘তারুণ্যের সন্ধানে পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০২০’, ‘সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর পুরস্কার-২০১৪’, ‘নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা’সহ নানা পুরস্কার। তিনি ২০১৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। তার সাহিত্যকর্মে অন্ত্যজ শ্রেণির সুখ-দুঃখ, যাপিত জীবনের অভিঘাত প্রাধান্য পায়। আশিক বিন রহিম দীর্ঘদিন ধরে কবিতার কাগজ ‘তরী’ সম্পাদনা করেন। সাংগঠনিকভাবে তিনি সাহিত্য মঞ্চ, চাঁদপুরের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করছেন।
আবু বকর সিদ্দিক
আবৃত্তিকার ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক। জন্ম ১৯৯৭ সালে, চাঁদপুরের সাপদী গ্রামে। শৈশব থেকে আবৃত্তির চর্চায় নিবেদিত আছেন। তিনি ছায়ানট থেকে বাচিক শিল্প বিষয়ে ‘আবর্তন’ ও ‘প্রয়োগ’ কোর্স সম্পন্ন করেন। তার নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের শিল্পীরা বিটিভিতে কবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসিত হয়। আবু বকর সিদ্দিক শতাধিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেছেন। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানননা। সাংগঠনিকভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিদ, পদক্ষেপ বাংলাদেশ, চাঁদপুর শাখা ও আনন্দধ্বনি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
